ছিনতাই – তিন গোয়েন্দা – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ – জুলাই, ১৯৮৮
সবাই প্রশংসা করছে মুসাকে।
রবিন বলল, তোমার বই-পড়া কাজে লাগছে। মনে হচ্ছে শিকারী হিসেবে নাম কামাবে। জানোয়ারের ব্যবসার সব দায়দায়িত্ব শেষে না তোমার ঘাড়েই চাপে।
জবাবে হাসল মুসা। বলল, কতবড় দানব, দেখলে! এগুলোকেই ধরে ধরে খায় ইনডিয়ানরা। ওরা আরও বড় দানব।
হেসে উঠল ক্যাসাডো। স্বাদ কিন্তু ভালই। আমি খেয়ে দেখছি। ছোটগুলোর চেয়ে বড়গুলো অনেক বেশি টেস্ট। খাবে নাকি?
মুসা হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। বোঝা গেল খুব একটা অমত নেই। কিন্তু জিনা তাড়াতাড়ি দু-হাত নেড়ে বলল, না, বাবা, না, আমি নেই। সাপের গোস্ত! ওয়াক থুহ!
মুসা, তোমার ইচ্ছে আছে মনে হচ্ছে? রবিন জিজ্ঞেস করল।
জন্তু-জানোয়ার ধরতে গেলে কখন কি খেতে হবে কে জানে? মুসা বলল। সব সময় সঙ্গে খাবার না-ও থাকতে পারে। তখন তো জানটা বাঁচাতে হবে কোনমতে।
কিশোর বলল, হারাম…
আরে ধ্যাত্তোর, হারাম। জান বাঁচানো ফরজ।
এ-তো দেখছি জাত অ্যানিমেল ক্যাচার হয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করল জিনা।
পাল্টা জবাব দিল মুসা, ফাঁকি দিলে কোন কাজেই উন্নতি হয় না।
হাসাহাসি করছে ছেলেরা, এই সময় হামুকে দেখা গেল। যোদ্ধাদের কারও কাছে কোন শিকার নেই। উদ্বিগ্ন, চোখেমুখে ভয়।
তাড়াহুড়ো করে মুখোশ পরে ফেলেছে ক্যাসাডো। সোজা তার কাছে এসে থামল হামু। প্রচুর হাত নেড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে নিচু গলায় বলল কিছু। বেশির ভাগ শব্দই বুঝল না ছেলেরা।
ইংরেজিতে তাদেরকে জানাল ক্যাসাডো, হামু বলছে, শিকার মেলেনি। তার বদলে জঙ্গলের ভেতর দেখে এসেছে তাদের চিরশত্রু ট্র্যাকো ইনডিয়ানদের পায়ের ছাপ। ভয়াবহ যোদ্ধা ওরা। সুযোগ পেলেই অন্য গোত্রের ইনডিয়ানদের আক্রমণ। করে বসে। সব সময় একটা যুদ্ধংদেহী ভাব। কাজেই একেবারে চুপ, টু শব্দ করবে না। হামু বলছে, এখন থেকে নড়াও উচিত হবে না, তাহলে টের পেয়ে যাবে ট্রাকোরা। ওরা নাকি একটা জায়ারের পিছু নিয়েছে।
কিন্তু ট্রাকোরা যে টের পেয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, বুঝতে পারেনি হাম। জিভারোদের পায়ের ছাপ দেখে ফেলেছে একজন ট্রাকো যোদ্ধা। হামুর দলের পিছু নিয়ে চলে এসেছে। বনের ভেতর তাদের সতর্ক নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে রাফিয়ানের। চাপা গলায় গাউ করে উঠল।
চুপ। তার কানের কাছে ধমক দিল জিনা নিচু স্বরে। চুপ থাক!
ইশারায় কুলিদের চুপ থাকতে বলল হামু।
যোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি। উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে সবাই কুলিদের হাতেও লাঠি, বল্লম কিংবা তীর-ধনু।
চায় কি ব্যাটারা? কথা না বলে থাকতে পারল না মুসা।
ওরা হয়তো ভাবছে, হামু কোন বড় শিকার পেয়েছে, প্রায় শোনা যায় না, এমন ভাবে বলল ওঝা। ওটা ছিনিয়ে নিতে চায়। যখন দেখবে শিকার নেই, আমাদের সঙ্গে যা খাবার আছে লুট করে নিয়ে যাবে।
অবশ্যই যদি জিততে পারে, রহস্যময় শোনাল কিশোরের কণ্ঠ।
তাদের যথাসর্বস্ব লুট করে নিয়ে যাবে ট্রাকোরা, আর তারা এই গহন বনে না খেয়ে মরবে, এটা ভাবতেই ভাল লাগছে না কিশোরের। ফন্দি আঁটছে সে মনে। মনে। ফিফটি-ফিফটি চান্স যখন, ঝুঁকিটা নিতেই হবে।
জিনার মুখ সাদা হয়ে গেছে। পুমকার আতঙ্কিত চেহারা দেখেই আন্দাজ করতে পারছে ট্র্যাকোরা কতটা ভয়ঙ্কর। মূসার দিকে তাকাল রবিন। দুজনের। চোখেই ভয়। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে।
মিস্টার ক্যাসাডো, হাত বাড়াল কিশোর, আপনার মুখোশটা দিন। আ যোদ্ধাদের বলন, ওদের মাথা থেকে কিছু পালক খুলে দিতে। জলদি!
কেন চাইছে ওগুলো, বুঝতে পারল না ক্যাসাডো। কিন্তু বিনা প্রতিবাদে মুখোশটা খুলে দিল। যোদ্ধাদেরকে বলতেই ওরাও পালক খুলে দিল।
তাদের কাছ থেকে কয়েকটা বিচিত্র মালা নিয়ে রাফিয়ানের গলায় পেঁচিয়ে বাঁধল কিশোর। মাথায় আটকে দিল জিভারোদের মাথার একটা বন্ধনী, তাতে কয়েকটা পালক লাগানো। নিজে পড়ল মুখোশটা। মাথায় পালক গুজল।
অবাক হয়ে দেখছে সবাই। সর্দার হামুও এই বিচিত্র সাজ দেখে স্তম্ভিত। করছে। কি দেবতার ছেলে?
রাফিয়ানকে নিয়ে সামনে ছুটে গেল কিশোর, জঙ্গলের দিকে।
ঠিক ওই মুহূর্তে ঝোপ দু-হাতে ফাঁক করে বেরিয়ে এল দশ-বারোজন ট্র্যাকো, জিভারোদের আক্রমণ করার জন্যে। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারল না। কিশোর আর কুকুরটার দিকে চোখ পড়তেই পাথরের মত জমে গেল ট্র্যাকো-নেতা। লড়াইয়ের আগে চিৎকার করে যোদ্ধারা, একে বলে যুদ্ধ-চিৎকার। নেতাও ওরকম চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল, থেমে গেল মাঝপথেই। এমন অদ্ভুত দৃশ্য জীবনে, দেখেনি সে।
মুখোশটা ভীষণ ভারি, মাথা সোজা রাখতেই কষ্ট হচ্ছে কিশোরের, দম আটকে যাবে যেন। কিন্তু সে-সব পরোয়া না করে গলা ফাটিয়ে বিকট চিৎকার করে উঠল। সেই সঙ্গে হাত-পা নেড়ে নাচতে শুরু করল। নাচ মানে টারজান ছবিতে দেখা জংলী মানুষখেকোদের লাফঝাপের অবিকল নকল। মুখোশটা এক ধরনের অ্যামপ্লিফায়ারের কাজ করছে, ফলে কয়েক গুণ জোরাল শোনাল চিৎকার। সঙ্গে গলা মেলাল রাফিয়ান। তুমূল ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিল, সেই সঙ্গে তার বিশেষ নাচ–এক লাফে তিন হাত উঠে বাকা হয়ে আবার মাটিতে নামা। শুধু ইনডিয়ানরা কেন, এমন যুগল-নৃত্য জিনা, মুসা রবিন আর ক্যাসাডোও দেখেনি আর।
জিভারোরা চোখের পাতা ফেলতেও যেন ভুলে গেছে। তাদের চেয়ে বেশি চেঁচাতে পারে দেবতার বাচ্চা, এই প্রথম জানল।
নাচতে নাচতে ট্রাকো-নেতার দিকে এগোল কিশোর। বার বার হাত ছুঁড়ছে তার দিকে। আঙুল নির্দেশ করছে, যেন কোন সাংঘাতিক বান মারতে যাচ্ছে। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, রাফি, যা ধর! দে ব্যাটাকে কামড়ে!
এ-রকম অনুমতি কালেভদ্রে পাওয়া যায়, আর কি ছাড়ে রাফিয়ান? ঘেউ ঘেউয়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে দুই লাফে গিয়ে পড়ল নেতার সামনে। বিশাল হাঁ করে কামড় মারতে গেল তার পায়ের গোছায়।
চোখের পলকে ঘুরে গেল নেতা! কাণ্ড দেখে পিলে চমকে গেছে তার। রাফির কামড় খাওয়ার জন্যে দাঁড়াল না। লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল ঝোঁপের ধারে। তারপর দৌড়, লেজ তুলেই বলা যায়–কারণ, বিশেষ ওই অঙ্গটা থাকলে সত্যি সত্যি এখন খাড়া হয়ে যেত এক ছুটে হারিয়ে গেল বনের ভেতরে।
নেতারই এই অবস্থা, দলের অন্য যোদ্ধাদের আর দোষ কি। পড়িমড়ি করে দৌড় দিল ওরা নেতার পেছনে, যে যেদিক দিয়ে পারল। ঝোপঝাড় ভেঙে গিয়ে। পড়ল বনের ভেতরে।
বেদম হাসিতে ফেটে পড়ল মুসা। তার সঙ্গে যোগ দিল রবিন আর জিনা। ক্যাসাডোও হাসছে।
জিভারোরা হাসল না। দেবতার বাচ্চার ক্ষমতা দেখে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে যেন। এক বিন্দু রক্তপাত না, কিছু না, তাড়িয়ে দিল ট্রাকোদের। খুব জোরাল কোন মন্ত্র নিশ্চয় পড়েছে, নইলে ট্রাকোদের মত হারামী মানুষ এভাবে পালায়?
এগিয়ে এসে কিশোরের সামনে দাঁড়াল হামু। শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে প্রণাম করল। তারপর নাচতে শুরু করল তার চারপাশে। দেখাদেখি অন্য যোদ্ধারাও এসে কিশোর আর রাফিয়ানকে ঘিরে নাচতে লাগল। তালে তালে নাড়ছে হাতের বল্লম। আর তীর-ধনু। পুমকা নাচছে হাততালি দিয়ে দিয়ে।
নাচ থামল। মুখোশটা ক্যাসাডোকে ফিরিয়ে দিল কিশোর।
ক্যাসাডোও এমন ভঙ্গিতে হাতে নিল, যেন মুখোশটাতে মন্ত্র ভরে দিয়েছিল। সে। কাজ শেষ হওয়ার পর ছুঁড়ে দেয়া মন্ত্র বাতাস থেকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে মুখোশে ভরে তারপর মুখে লাগল।
জিভারোদের আর কোন সন্দেহ রইল না, ক্যাসাডোর মুখোশের মন্ত্রের জোরেই তাড়ানো হয়েছে ট্র্যাকোদের।
এবার সম্মান দেখানোর পালা।
জাগুয়ারের দাঁত গেঁথে তৈরি বিশেষ মালাটা গলা থেকে খুলে কিশোরের গলায় পরিয়ে দিল হামু। তারপর তার সামনে হাটু গেড়ে বসে লাল-হলুদ আলখেল্লার। এটা কোণা সাবধানে ছোঁয়াল কপালে।
এই বার বিপদে পড়ল কিশোর। এই সম্মানের একটা জবাব দেয়া দরকার, জিভারোদের কায়দায়। দেবতার বাচ্চা এই রীতি জানে না, এটা হতেই পারে না, মানবে না ইনডিয়ানরা। কিন্তু সেই রীতিটা কি? ভুল হলে কি খারাপ ভাবে নেবে ওরা? ভাবার সময়ও নেই। আস্তে করে হাত রাখল হামুর মাথায়। রেখেই বুঝল, ঠিক কাজটি করে ফেলেছে।
আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল জিভারোরা। সর্দারকে আপন করে নেয়া মানেই তাদের সবাইকে আপন করা। দেবতার ছেলে তা-ই করেছে।
ইনডিয়ানদের উচ্ছাস শেষ হলে এগিয়ে এল মুসা, রবিন আর জিনা। কিশোরের বুদ্ধির জন্যে তাকে ধন্যবাদ জানাল। রাফিয়ানকে জড়িয়ে ধরে আদর করল জিনা।
আর ওখানে থাকা নিরাপদ নয়। সাহস সঞ্চয় করে আবার ফিরে আসতে পারে ট্রাকোরা। তল্পিতল্পা গুছিয়ে রওনা দিল দলটা। অনেক ঘুরপথে পার হয়ে এল ট্র্যাকোদের এলাকা।
এতে, চিন্তিত হয়ে বলল রবিন, একটা অসুবিধে হতে পারে। আসল জায়গা পার হয়ে যদি চলে আসি?
আসতেও পারি, কিশোর বলল। তবে পাহাড়-টাহার কিছু দেখিনি ওদিকে। পাহাড় না থাকলে উপত্যকা থাকবে না।
হ্যাঁ, তা-ও তো বটে।
আসল কথা হলো, মুসা বলল, ভাগ্যের ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হবে। আমাদের। কপাল ভাল হলে জায়গাটা পাব, খারাপ হলে পাব না।
আরও কত বিপদ আছে সামনে কে জানে। জিনা বলল, জাগুয়ার গেল, সাপ গেল, ট্র্যাকো গেল। আর কি কি আছে এই জঙ্গলে?
ও-ধরনের আর কোন বিপদের মুখোমুখি হলো না ওরা। তবে অসুবিধে অনেক হলো। শিকার খুবই সামান্য, ফলে খাবারে টান পড়ল। ইনডিয়ানদের বিশেষ অসুবিধে হলো না, তাদের সঙ্গে জাগুয়ারের মাংস রয়েছে। তবে নদীর ধার থেকে সরে আসার পর পানির কষ্ট দেখা দিল সকলেরই। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। চলেছে, পানি নেই, অথচ পরিশ্রম করতে হচ্ছে বেশি।
হাঁপিয়ে উঠেছে ছেলেরা, শরীর আর পারছে না। রাফিয়ান সারাক্ষণই জিভ বের করে হাঁপায়। তার ওপর আরও কষ্ট বেচারার–জোঁক আর রক্তচোষা কীট পতঙ্গে ছেয়ে ফেলেছে শরীর। বেছে দেয় জিনা, তিন গোয়েন্দাও হাত লাগায়। কিন্তু কটা আর বাছা যায়।
রাতে ঘুমাবার সময় ওরা কড়া পাহারার ব্যবস্থা করল।
এতই পরিশ্রান্ত, শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেল অভিযাত্রীরা। মনে হলো ফুরুত করে শেষ হয়ে গেল রাতটা। তবে ভোরে চোখ মেলে পালকের মত হালকা মনে হলো সবার শরীর। বেশ ভাল বিশ্রাম হয়েছে।
নাস্তা খেয়ে রওনা হলো দলটা।
রোদ যত চড়ছে, গরম বাড়ছে। পানি নেই। পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল সবাই।
ওঝার পরামর্শ চাইল হামু।
বিটলাঙগোরগা বলল, চিন্তা নেই। আরেকটু এগিয়েই পানি পাওয়া যাবে। বলেছে সে আন্দাজে। সামনে উঁচু পর্বত দেখা যাচ্ছে, মাথায় বরফ। উপত্যকায় হ্রদ-টদ কিছু থাকতে পারে, এই ভরসাতেই বলেছে। জানে, ভুল হলে সর্বনাশ হবে। তার জাদু-ক্ষমতার ওপর ইনডিয়ানরা বিশ্বাস হারালে ভীষণ বিপদ হতে পারে।
তবে আপাতত বিপদ কেটে গেল।
পর্বতের তলায় একটা হ্রদ দেখা গেল দুপুর নাগাদ। রোদে ঝকমক করছে স্বচ্ছ পরিষ্কার পানি।
ছুটে গিয়ে জানোয়ারের মত উপুড় হয়ে পানিতে মুখ ডুবিয়ে দিল ইনডিয়ানরা। পেটভরে পানি খেয়ে, গায়ে মাথায় ছিটিয়ে উঠে এল।
ছেলেরা আর ক্যাসাডো খেল আঁজলা ভরে। খুব মিষ্টি। বোধহয় পর্বতের ওপরের বরফ গলা পানি ঝর্না বেয়ে এসে পড়ে এই হ্রদে।
হ্রদটা বেশি বড় না। বড় দিঘির সমান। কিশোরের মনে হলো, এটাই বোধহয়। সেই জলাশয়, যেটার কথা বলা হয়েছে ধাঁধায়।
ঠিক দুপুর। সূর্য মাথার ওপরে।
ব্যাপারটা আগে চোখে পড়ল মুসার, তার দৃষ্টিশক্তি খুব জোরাল। দেখো দেখো! একেবারে মাঝখানে দেখা যাচ্ছে সূর্যটা। অদ্ভুত, না?
অন্য ছেলেরাও দেখল।
বোধহয় উঁচু জায়গায় রয়েছি বলেই দেখতে পাচ্ছি, কিশোর বলল। ভৌগোলিক আরেকটা ধাঁধা। যাকগে, ওটা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। পশ্চিমে দেখো এখন, চাঁদ দেখা যায় কিনা?
অনেকক্ষণ ধরে খুজল মুসা। মাথা নাড়ল, নাহ চাঁদ নেই।
পকেট থেকে কম্পাস বের করল কিশোর। পশ্চিম কোনদিকে, দেখল। তার কাছে ঘেঁষে এসেছে জিভারোরা। চোখে কৌতূহল নিয়ে দেখছে।
পশ্চিম ওদিকে, হ্রদের অন্য পাড়ের ঘন জঙ্গলের দিকে হাত তুলে দেখাল কিশোর। এই দিনের বেলায় চাঁদ ওঠার তো প্রশ্নই ওঠে না। যদি উঠতও, ওই জঙ্গলের জন্যে দেখা যেত না।
আমিও তাই ভাবছি, রবিন বলল।
দাঁড়াও দাঁড়াও, এক মিনিট! বলে উঠল জিনা। ওই যে দেখো, ওইই যে, ওদিকে।
ক্যাসাডোও দেখেছে ওটা। হাত তুলে দেখাল।
উল্লাসে চিৎকার করে উঠল জিভারোরা, ওরাও দেখেছে। ঘন জঙ্গলের দিকে এতক্ষণ চেয়ে ছিল বলে দেখতে পায়নি।
তিন গোয়েন্দা দেখল, পশ্চিমে এক জায়গায় প্রায় পানির ভেতর থেকে উঠে গেছে হালকা ঝোপঝাড়। তার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে মিটার চারেক উঁচু বাসনের মত গোল একটা বস্তু। মুক্তোর মত দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সবুজ বনের মাঝে বিশাল এক মুক্তোর থালা যেন। দাঁড়িয়ে আছে লালচে পাথরের মঞ্চের ওপর।
গোল জিনিসটা কী, কি দিয়ে তৈরি, বুঝতে পারল না ছেলেরা।
ক্যাসাডোও পারল না।
তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর, ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, বুঝেছি। সূর্যের আলো।
সূর্যের আলো? মুসা বুঝতে পারল না।
বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছোট ছোট, আয়না বসানো রয়েছে চাকাটায়। সূর্যরশ্মি পানিতে প্রতিফলিত হয়ে গিয়ে পড়ছে আয়নাগুলোতে। তাতেই সৃষ্টি হয়েছে ওই কৃত্রিম চাঁদ। আশ্চর্য! এত শত বছর আগেও জানত?
কারা জানত? কী?মুসার প্রশ্ন।
যারা ওই চক্র বানিয়েছে। সূর্যের আলোতে যে চাঁদ আলোকিত হয়, জানত একথা?
হয়তো জানত, রবিন বলল। হাজার হাজার বছর আগেই নাকি মানুষ। জ্যোতির্বিদ্যায় উঁচু পর্যায়ের জ্ঞান অর্জন করেছিল। মিশরের পিরামিড, ইনকা পিরামিড, স্টোনহেঞ্জ নাকি তারই স্বাক্ষর:..
বুদ্ধি ছিল মানতেই হবে, চক্রটার দিকে হাত তুলল মুসা। শুধু কাঁচ দিয়ে এত সুন্দর একটা জিনিস তৈরি করে ফেলল।
আমাদের দ্বিতীয় ধাঁধারও জবাব পেয়ে গেলাম।
হ্যাঁ, রবিনের সঙ্গে একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। এখন আইডল্টা খুঁজে বের করতে পারলেই…
কেল্লা ফতে! তুড়ি বাজাল মুসা।
দ্রুত জ্যোতি হারাচ্ছে কৃত্রিম চাঁদ। কারণ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে সূর্য, হেলে পড়ছে বলে বিশেষ অ্যাঙ্গেলটা আর থাকছে না। খানিক পরে কোন জ্যোতিই রইল না আর চক্রটায়, অতি সাধারণ একটা পাথরের বাসন।
জিভারোদের দিকে ফিরে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিল ক্যাসাডো।
খুশিতে হুল্লোড় করে উঠল ইনডিয়ানরা।
ক্যাসাডোর ওপর শ্রদ্ধা, ভক্তিতে গদগদ। হবেই। মুখোশের ক্ষমতায় শত্রু তাড়াতে পারে যে ওঝা, পানির হ্রদ হাজির করে দিতে পারে, যে গুপ্তধন এত বছরেও কেউ পায়নি, সেটা পাওয়ারও ব্যবস্থা করতে পারে, তাকে ভক্তি না করে উপায় আছে।
ছেলেদের ওপরও ভক্তি বেড়েছে ওদের।
কাছে থেকে চাঁদটা দেখতে চলল কিশোর। সঙ্গে চলল মুসা, রবিন জিনা ও রাফিয়ান। পেছনে ক্যাসাডো, হামু আর তার দলবল।, তারও পরে রয়েছে হলুদ, দেবী, বিড়বিড় করল কিশোর। তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে সবুজ চোখে।
শুরুতে হালকা ঝোপঝাড়। কিন্তু খানিক পরে জঙ্গল এত ঘন হলো, পথ করে এগোনোর সাধ্য হলো না ছেলেদের। বাধ্য হয়ে পিছিয়ে এল। আগে বাড়ল কয়েকজন যোদ্ধা। পথ কেটে কেটে এগোল।
তিনশো মিটার মত এগিয়ে হঠাৎ থেমে গেল ওরা। ক্যাসাডো আর ছেলেরা বুঝতে পারল, অবশেষে দেখা পাওয়া গেছে চন্দ্রমন্দিরের।
সামনে অদ্ভুত একটা বিল্ডিং। সাদা রঙ করা। সামনের দিকটা বিচিত্র তৃতীয়ার চাঁদের আকার। চাঁদের ঠিক পেটের কাছে গোল বিরাট এক দরজা, ঢোকার জন্যে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে অভিযাত্রীদের।
মন্দির দর্শনেই কুঁকড়ে গেল জিভারোদের মন। ভক্তিভরে মাথা নুইয়ে প্রণাম করল ওরা, এগোতে সাহস করল না আর।
ছেলেদেরও বুক কাঁপছে। ঘন বনের ভেতরে ওই নির্জন এলাকায় এত পুরানো, একটা বাড়ি দেখলে অতি বড় সাহসীরও গা ছমছম করবে।
মাথা ঝাড়া দিয়ে অস্বস্তি তাড়াল যেন কিশোর। এসো, যাই। নিশ্চয় আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন সবুজ-চোখো চন্দ্রদেবী।
আরেকটু ভদ্রভাবে সম্মানের সঙ্গে বলো, নিচু স্বরে বলল মুসা, যেন দেবী সত্যিই শুনতে পাবে।
এগোতে যাবে ওরা, ডেকে থামাল ক্যাসাডো।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কি?
ওই যে, দেখো।
তিনটে ব্যাগ। প্রায় নতুন। মন্দিরের দরজার কাছেই মাটিতে পড়ে আছে।
ইয়াল্লা! চোখ বড় বড় করে ফেলল মুসা। এ-তো সভ্য মানুষ! এখানে এসে ঢুকল কারা?
কি জানি? হাত নাড়ল ক্যাসাডো। আমাদের হুশিয়ার থাকতে হবে…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘাউ করে উঠে দৌড় দিল রাফিয়ান। এক ছুটে ঢুকে গেল গোল দরজা দিয়ে। স্তম্ভিত ভাবটা কাটতে সময় লাগল জিনার। ডাকতে দেরি হয়ে গেল।
রাফির হলো কি? মুসা অবাক।
অবাক ক্যাসাডোও হয়েছে। ভয় পেল বলে তো মনে হলো না।
না, পায়নি, জিনা বলল। চেনা কারও গন্ধ পেয়েছে।
অসম্ভব। রবিন মাথা নাড়ল। হতেই পারে না। এখানে চেনা-জানা কে আসতে যাবে?
আন্দাজে কথা না বলে চলো না দেখি, কিশোর বলল।
হাত তুলে জিভারোদের ডাকল ক্যাসাডো। ওরা কাছে এলে বলল, কাছাকাছি থেকো। আমরা ভেতরে যাচ্ছি। দরকার হলেই ডাকব। সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়বে। ভয় পেয়ে পালিও না যেন।
এবার নেতৃত্ব নিল ক্যাসাডো। খুব সাবধানে আগে আগে চলল সে, ছেলেরা পেছনে। দরজার কাছে পৌঁছে মুখোশটা খুলে হাতে নিল, একবার দ্বিধা করেই পা রাখল ভেতরে। অদৃশ্য হয়ে গেল।
দ্বিধা করল কিশোরও। চলো, আমরাও যাই। ওঁকে একা যেতে দেয়া ঠিক হবে না।
ছেলেরাও ঢুকল মন্দিরে।
আলো খুব কম। ক্যাসাডোর গায়ে ধাক্কা লাগল মুসার। চোখে আলো সইয়ে নেয়ার জন্যে দরজার সামান্য ভেতরেই দাঁড়িয়ে গেছে বৈমানিক।
মন্দিরের দেয়ালের অসংখ্য ফুটো দিয়ে ম্লান আলো আসছে। আবছা আলো চোখে সয়ে এলে দেখল ওরা, বিশাল এক হলরুমে ঢুকেছে। অনেকটা জাহাজের খোলের মত লাগছে ঘরটা। এক সারি বিভিন্ন আকারের শুভ : ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়েছে, ঠিক মাঝের স্তম্ভটার পর থেকে আবার ছোট হওয়া শুরু হয়েছে। কাস্তের মত বাকা মেঝেতে দাঁড়িয়ে ছাত ঠেকা দিয়েছে স্তম্ভগুলো। দু-দিকে দুটো। সিঁড়ি। একটা উঠে গেছে চাঁদের বাঁ প্রান্তের কাছে, আরেকটা ডান প্রান্তে। দুটো সিঁড়ির শেষ ধাপের ওপরে হাতে গোল দুটো ফোকর।
বাঁ সিঁড়িটা দিয়ে ওপরে উঠে বাইরে মাথা বের করে দেখল কিশোর, ফোকরের বাইরে মস্ত বড় একটা চ্যাপ্টা পাথর ফেলে রাখা হয়েছে বলির পাথর। নিশ্চয় নরবলি দেয়া হত ওখানে। পাশেই একটা মঞ্চ, পুরোহিত কিংবা ওঝা। দাঁড়াতো হয়তো।
শশশ! হুঁশিয়ার করল ক্যাসাডো। ডান সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, নেমে এল তাড়াতাড়ি। ওপরে শব্দ।
লুকিয়ে পড়ার আগেই উজ্জ্বল আলো এসে পড়ল নিচে। ইংরেজিতে বলল। কেউ, হলো তাহলে ঠিক। আমি তো ভাবলাম গেল টর্চটা।
.
ওরটেগা! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কণ্ঠস্বর চিনে ফেলেছে।
দ্রুত নড়ল আলোটা। একে একে পড়ল পাঁচজনের ওপর।
আরি, কাণ্ড দেখো! বিশ্বাস করতে পারছে না ওরটেগা, ছেলেগুলো। সঙ্গে আরেকজন লোকও আছে।
ডানের সিঁড়ি দিয়ে আরও দু-জন নেমে এল, চ্যাকো এবং জিম।
ক্যাসাডোই ওঝা বিটলাঙগোরগা শুনে হেসেই বাঁচে না তিন হাইজ্যাকার।
ভাল আছ, জিনা? জিজ্ঞেস করল জিম। এসেছ, ভালই হলো। এক সঙ্গে যেতে পারব।
তারমানে যাননি আপনারা এখনও? মুসা বলল। আমি তো ভাবছিলাম, আপনারা আমাদের উদ্ধার করতে ফিরে এসেছেন।
না, যেতেই পারিনি এখনও. বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল জিম। জিভারোদের গা থেকে পালিয়ে প্লেনে ফিরে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়ো করে তিনটে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। পথ হারিয়েছি পরের দিনই। চলে এসেছি এদিকে। মন্দিরটা দেখে ঢুকলাম। জানো, কি আবিষ্কার করেছি? এসো, দেখাই।
ডানের ফোকর দিয়ে ছাতে বেরিয়ে এল ছেলেরা।
খাইছে! চিৎকার করে উঠল মুসা।
একটা বেদীর ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বিরাট দেবী-মূর্তি, নিরেট সোনায় তৈরি। মাথায় সোনার মুকুটের সামনের দিকে রূপালী বাকা চাঁদ, রূপা দিয়ে বানিয়ে পরে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে মুকুটে। কাঁধে রূপার চাঁদরের শাল জড়ানো। আশ্চর্য দুটো চোখ, সবুজ দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
পান্না, ওরটেগা বলল। খুলে নেব। ভাল দাম পাওয়া যাবে রিওতে।
একটা ছুরি বের করে মুর্তিটার দিকে এগোল সে।
আর তাকে থামাল কাসাডো। এক মিনিট। আমরা এখানে কি করে এলাম, জিজ্ঞেস করেননি। আগে শুনুন, তারপর পান্না খুলবেন।
খুলে বলল সব ক্যাসাডো। মূর্তিটা হামুকে দিয়ে দিলে, কথা শেষ করল সে, আমাদের মুক্তি দেবে। সবাই আমরা দেশে ফিরে যেতে পারব।
হেসে উঠল চ্যাকো, বিশ্রী শোনাল হাসিটা। জিভারোরা জানছে কি করে মৃতিটা ছিল এখানে? পেছনে আরেকটা ছোট দরজা আছে, চোখ দুটো নিয়ে বেরিয়ে যাব আমরা, ঢুকে পড়ব জঙ্গলে। ওরা দেখবেও না, জানবেও না কিছু।
কিন্তু দরজার বাইরে যে ব্যাগ পড়ে আছে? রবিন প্রশ্ন তুলল।
জাহান্নামে যাক ব্যাগ। ওগুলোর মধ্যে তেমন কিছু নেই। ওরটেগা, জলদি খোলা।
ওরটেগার হাত চেপে ধরল ক্যাসাডো। পাগল হয়েছেন। শুনুন, মূর্তিটা অক্ষত। অবস্থায় হামুকে দিতে হবে। নইলে সে কোনদিনই আমাদের যেতে দেবে না।
আপনাদের কথা কে ভাবছে? ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে উঠল চ্যাকো। আমি চাই টাকা।
চুপ করে ছিল জিম। বলল, চ্যাকো, জিভারোদের হাত থেকে পালাতে পারবে না। সহজেই ওরা ধরে ফেলবে। এই জঙ্গল থেকে বেরোতেই যদি না পারো, টাকা পাবে কিভাবে? তার চেয়ে ক্যাসাডো যা বলছে শোনো। আমাদের সবারই মঙ্গল তাতে।
কিন্তু চ্যাকো তখন অন্ধ। তার পক্ষ নিল ওরটেগা। মহামূল্যবান পান্না দুটো তাদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। কতখানি বিপদে রয়েছে, আরও কতখানি। বাড়বে, বুঝতেই চাইছে না।
ক্যাসাডোও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই পান্না খুলতে দেবে না।
কথা কাটাকাটি, শেষে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। ক্যালাডোকে ঘুসি মেরে বসল চ্যাকো।
ওকে এমনিতেই পছন্দ করে না রাফিয়ান। তার ওপর ক্যাসাডোকে মারায়। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। ঝাঁপিয়ে পড়ল চ্যাকোর ওপর। টুটি কামড়ে ধরতে গেল।
বিকট চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল চ্যাকো। কুকুরটা উঠে এল তার বুকের ওপর।
চেঁচিয়ে থামতে বলছে জিনা, কিন্তু কানেও ঢুকছে না রাফিয়ানের। রোখ চেপে গেছে তার। চ্যাকোর রক্ত না দেখে ছাড়বে না।
চেঁচামেচি শুনে জিভারোরা ভাবল, তাদেরকে ডাকা হচ্ছে। হুড়মুড় করে এসে ঢুকল ভেতরে। দুপদাপ করে উঠে এল ছাতে।
হামু বোকা নয়। কুসংস্কারে বিশ্বাসী বটে, কিন্তু মগজটা তার পরিষ্কার। সোনার দেবী-মূর্তি, ওরটেগার হাতে ছুরি, দেবীর চোখের কাছে আঁচড়, কিছুই চোখ এড়াল না তার। বুঝে ফেলল, কি হচ্ছে।
সর্দারের নির্দেশে নিমেষে তিন হাইজ্যাকারকে কাবু করে ফেলল জিভারোরা। হাত পিছমোড়া করে শক্ত করে বাধল বুনো লতা দিয়ে।
জিমকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করেও লাভ হলো না। এত রেগে গেছে। হামু, কারও কথাই শুনল না, এমনকি ওঝার কথাও নয়। সাংঘাতিক অপরাধ করেছে তিন বন্দী। গ্রাম থেকে পালিয়েছে, তারপর এখানে এসে দেবীর চোখ চুরি করতে চেয়েছে। ওদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। সেখানেই ঘোষণা করল হামু গায়ে নিয়ে গিয়ে আগামী পূর্ণিমাতেই তিনজনকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হবে। এটাই ওদের যোগ্য শাস্তি।
যে জিনিসের জন্যে এসেছিল, পাওয়া গেছে, গায়ে ফেরার জন্যে তৈরি হলো দলটা। ছেলেদেরকে আর ক্যাসাডোকে মুক্তি দেয়া হয়েছে, কথা রেখেছে হামু। বলল, যখন যেখান থেকে খুশি স্বর্গে ফিরে যেতে পারে। বাধা দেয়া হবে না।
কিন্তু তিন হাইজ্যাকার আবার ধরা পড়ায় আনন্দ মাটি হলো ছেলেদের। তিনজনকে জিভারোদের হাতে রেখে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারল না ওরা।
আমাদেরও গাঁয়ে ফিরে যেতে হবে, বলল ক্যাসাডো। কিছু দিন বিশ্রাম দরকার। নইলে আবার জঙ্গল পাড়ি দিতে পারব না। তাছাড়া সমস্যায় ফেলে দিয়েছে ওই তিন ব্যাটা। ছাড়ানোর কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী পূর্ণিমার দিন বলি দেবে ওদেরকে হামু, মাঝে বেশ কিছুদিন সময় আছে। আশা করি একটা উপায় করে ফেলতে পারব।
গাঁয়ে ফিরে চলল সবাই।
সোনার মূর্তিটা পালা করে বইল দুজন যোদ্ধা, মহা-সম্মানের কাজ মনে করল এটাকে ওরা।
গাঁয়ে ফিরে তিন হাইজ্যাকারকে কুঁড়েতে ভরল জিভারোরা। অনেক পাহারাদার রাখা হলো, আর যাতে পালাতে না পারে। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখার ব্যবস্থা হলো।
ছেলেদের ওপর কেউ আর চোখ রাখছে না এখন। যখন যেখানে খুশি যেতে পারে তারা। ক্যাসাডো ও মুক্ত। আলাদা আলাদা কুঁড়েতে না শুয়ে একই কুঁড়েতে। রাত কাটায় এখন। ফলে আলাপ-আলোচনার সুবিধে হলো।
কিন্তু উপায়টা কি এখন? প্রশ্ন করল জিনা।
আমারও তাই জিজ্ঞাসা, জবাব দিল বৈমানিক। ভাবতে ভাবতে তো মগজ ঘোলা করে ফেললাম, কোন উপায় দেখছি না। ব্যাটাদের ছাড়াই কি করে?
চুপ করে রইল সবাই।
দেখি, কি করা যায়। আবার বলল ক্যাসাডো। তবে আগে প্লেনে যেতে হবে একবার। এস ও এস পাঠাতে। জবাব না পাওয়া পর্যন্ত পাঠিয়েই যাব। এখন। আর ভয় নেই, আমি দিনের পর দিন না থাকলেও কেউ খোঁজ করবে না।
ভাগ্য যখন ভাল হতে শুরু করে, সব দিক থেকেই হয়। সেদিন দ্বিতীয়বারের চেষ্টায়ই জবাব পেয়ে গেল ক্যাসাডো। খুশিতে লাফাতে লাফাতে গায়ে ফিরে এল সে।
ঘুম থেকে ছেলেদের ডেকে তুলে জানাল খবরটা। পেয়েছি। কাঠ-ব্যবসায়ী। কোম্পানির এক দল লোক কাজ করছে বনে। তারাই ধরেছে সিগন্যাল। বলেছে, ব্রাজিল পুলিশকে জানাবে, যত তাড়াতাড়ি পারে। দশ-বারো ঘন্টা পরে আবার যাব প্লেনে। খবর নেব, কদর কি হলো। যাক, দুঃস্বপ্ন শেষ হতে চলেছে এতদিনে।
সময় মত সাহায্য এলেই হয় এখন, কিশোর বলল। পূণির্মার আর মাত্র ছয় দিন বাকি।
সে-কথা ক্যাসাডোর মনে আছে কিন্তু উপায় এখনও বের করতে পারেনি।
ভাল ঘুম হলো সে রাতে। ঝরঝরে শরীর মন নিয়ে পরদিন সকালে উঠল অভিযাত্রীরা।
নাস্তা সেরেই প্লেনে চলে গেল ক্যাসাডো।
ছ-দিনের মধ্যে কি সাহায্য আসবে? রবিনের প্রশ্ন। কিশোর?
জানি না।
না এলে লোকগুলোকে বাঁচানো যাবে না, মুসা বলল।
অনেক মাথা ঘামাল ওরা, কিন্তু কোন উপায় বেরোল না। তিন হাইজ্যাকারের। কপালে বলিই লেখা আছে বোধহয়।
সন্ধ্যায় ফিরে এল ক্যাসাডো। মুখ উজ্জ্বল। এতক্ষণে সারা দুনিয়া জেনে গেছে আমাদের খবর।
চকচকে চোখে সমস্ত, শুনল ছেলেরা।
চার দিনের মধ্যেই আর্মি হেলিকপ্টার আসবে আমাদের নিতে, বলল। ক্যাসাডো। কপ্টার নামার জন্যে একটা ল্যাণ্ডিং প্যাড বানিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের। সেটা কোন ব্যাপারই না। জিভারোদের দেখিয়ে দিলেই বানিয়ে ফেলতে পারবে। দেবতার ক্যান নামবে শুনলে খুব আগ্রহ করে কাজ করবে।,,
তা-তো হলো, জিনা বলল। তিন হাইজ্যাকারের কি হবে?
হাসি হাসি মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল ক্যাসাডোর। সরি, জিনা, ওদের জন্যে কিছু করতে পারছি না। মিলিটারিকে বললে বল প্রয়োগ করবে, তাতে জিভারোদের সঙ্গে লড়াই অনিবার্য। তখন তোমরাও আহত হতে পারো। তিনটে আসামীর। জন্যে সে রিস্ক আমি নিতে পারব না।
আমাদের নামিয়ে দিয়ে তো ফিরে আসতে পারবে?
মনে হয় না। আমাদের যেতেই অনেক সময় লাগবে। তার পর ফিরে আসতে আসতে বলি শেষ হয়ে যাবে। আরও একটা ব্যাপার আছে। ব্রাজিলিয়ান কর্তৃপক্ষ সহজে উপজাতীয়দের সঙ্গে বিরোধে যাবে না। এমনিতেই বশ্যতা মানতে চায় না ওরা, তার ওপর গোলাগুলি চললে আরও খেপে যাবে। ভাল মানুষ হলে কথা ছিল, তিনটে ক্রিমিন্যালের জন্যে কেন ওদের খেপাতে যাবে সরকার?
সবাই বিষণ্ণ। রাফিয়ানও বুঝতে পারছে, আনন্দের সময় নয় এটা। লেজ নিচু করে রেখেছে সে, কান ঝুলে পড়েছে। চুপচাপ বসে এর-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
কিন্তু এভাবে তিনটে মানুষকে জবাই করে ফেলবে, কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না জিনা, আর আমরা কিছুই করতে পারব না?
সে-রাতে কেউ ঠিক মত ঘুমাতে পারল না।
শুয়ে শুয়ে অনেক ভাল কিলোর। কি যেন একটা মনে আসি আসি করেও আসছে না, ধরতে পারছে না সে। ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল, ভেঙে গেল খানিক পরেই। লাফিয়ে উঠে বসল সে। বাইরে তখন ভোরের আলো। ডাকল। সবাইকে।
কি ব্যাপার, কিশোর? চোখ রগড়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
পথ পেয়ে গেছি।
কিসের পথ?
ওদের বাঁচানোর।
ঘুম দূর হয়ে গেল মুসার চোখ থেকে। অন্যেরাও সতর্ক। কিশোর কি বলে শোনার জন্যে অধীর।
কাজটা সহজ হবে না, কিশোর বলল। মিস্টার ক্যাসাডো, আপনার সহায়তা দরকার। ওরটেগাকেও খাটতে হবে।
ওরটেগা? ক্যাসাডো অবাক।
হ্যাঁ। সে ভেনট্রিলোকুইজম জানে।
তাতে কি? ক্যাসাডোর বিস্ময় বাড়ল। কিছুই বুঝতে পারছে না। খুলে বলো।
বুঝতে পারছেন না? ধরুন আরেকবার কথা ছুঁড়ে দিল ওরটেগা। কথাটা বেরোল চন্দ্রদেবীর মুখ দিয়ে…
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল ক্যাসাডো৷ ঠিক বলেছ! ঠিক! সহজেই বোঝাতে পারব হামুকে। দেবীকে অপমান করছে যারা তাদের বিচার দেবীই করুক, রায় দিক। তারপর তারপর আমি মূর্তিটাকে প্রশ্ন করব, সে জবাব দেবে.. চমৎকার! কিশোর, তুমি একটা জিনিয়াস।
এখনই এত শিওর হবেন না, মাথা নাড়ল কিশোর। জিভারোরা ইংরেজি জানে না। ওরটেগাও এদের ভাষা জানে না। কথা হবে কোন ভাষায়?
ওটা এমন কিছু কঠিন না, ক্যাসাডো বলল। জিভারো ভাষায় শব্দ খুবই কম, উচ্চারণও খুব সহজ, তা এতদিনে নিশ্চই বুঝেছ। তাছাড়া প্রশ্ন ঠিক করব আমি, জবাবও। সেই জবাবই মুখস্থ করাব তাকে।
খুশি হলো সবাই। যত শত্রুতাই করুক, তিনজন মানুষকে বলি দেয়া হবে– চোখের সামনে, এটা সহ্য করা যায় না।
সময় নষ্ট করল না ক্যাসাডো। তখুনি গেল হামুর কাছে।
সহজভাবেই মেনে নিল হামু। দেবতা কালুম-কালুম তার দেবীর অপমান হতো। দেখেছে, প্রতিশোধ তো নিতেই চাইবে। আর দেবীর বিচার দেবীই করুক, এটা চাওয়াটাও যুক্তিসঙ্গত। হামু.কেন মাঝখান থেকে উল্টোপাল্টা বিচার করে দেবতার কুনজরে পড়তে যাবে?
এক সঙ্গে দুটো কাজ করার হুকুম দিল সে তার লোকজনকে।
দেবতাদের উড়ুক্কু-নৌকা নামার জন্যে মঞ্চ বানানোর নির্দেশ দিল। আরেকটা উঁচু ছোট মঞ্চ বানাতে বলল তার কুড়ের সামনে, ওটাতে দেবীকে রাখা হবে। ওখান থেকেই বিচার করবে দেবী।
দেবীর মঞ্চ বানাতে বেশি সময় লাগল না।
খুব ধুমধাম করে নানারকম আচার-অনুষ্ঠান সেরে দেবীকে মঞ্চে তুলল ওঝা বিটলাঙগোরগা। গায়ের সবাই এসে ভক্তিভরে প্রণাম করে গেল দেবীকে।
এরপর অপেক্ষার পালা। কবে আসবে সেই শুভক্ষণ, যখন তিন বন্দির বিচার করবে দেবী। সময়টা ওঝা ঠিক করবে।
খুব বেশি সময় নেয়া যাবে না। ওরটেগাকে ভাষা শেখাতে শুরু করল, ক্যাসাডো। তবে জিভারোদের অলক্ষে। সে ওঝা। বন্দিদের কুঁড়েতে তার যাতায়াত কেউ সন্দেহের চোখে দেখল না।
অবশেষে এল সেই দিন।
সকাল থেকেই খুব উত্তেজনা। বিভিন্ন কারণে সবাই উত্তেজিত। গায়ের লোক, তিন গোয়েন্দা, জিনা, বন্দিরা, সবাই।
মঞ্চের সামনে এসে জড় হলো সব লোক। সকালের সোনালী রোদে ঝকঝক করে জ্বলছে চন্দ্রদেবী। নিজের কিরণ ছড়িয়ে দিয়ে স্ত্রীর ঝলমলে রূপকে শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, যেন তার স্বামী সূর্যদেবতা। ভক্তিভরে বার বার প্রণাম করতে লাগল ইনডিয়ানরা।
মঞ্চে দেবীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল ওঝা। যতরকম মালা আর সাজপোশাক। আছে, সব আজ গায়ে চাপিয়েছে। সব চেয়ে বিকট চেহারার মুখোশটা পরেছে। অপার্থিব লাগছে তাকে, ভয়ঙ্কর।
ঢিবঢিব করছে ছেলেদের বুক। হবে তো? কাজ হবে?
মঞ্চের পাশে বিশেষ আসনে বসেছে হামু, দু-পাশে আর সামনে বসেছে তার পরিবারের লোকজন। তাদের কাছেই সম্মানজনক দূরতে সম্মানিত আসনে বসেছে। তিন গোয়েন্দা আর জিনা। জিনার পাশে রাফিয়ান, গম্ভীর হয়ে আছে। বুঝতে পেরেছে, এটা ঘেউ ঘেউ কিংবা হালকা কিছু করার সময় নয়। ফিসফাস কানাঘুষা। করছে গায়ের লোকর স্বর্গের কুকুর তো, দেখো, কেমন ভাবভঙ্গি! দেবতার চেয়ে কম কি?
হাত তুলে ইশারা করল হামু।
পলকে থেমে গেল সমস্ত শব্দ।
আবার ইশারা করল সর্দার।
কয়েকজন যোদ্ধা গিয়ে বন্দিদের নিয়ে এল।
চ্যাকোর চেহারা ধসে গেছে। জিম আর ওরটেগা মোটামুটি ঠিকই আছে।
তিন বন্দিকে উদ্দেশ্য করে লম্বা বক্তৃতা দিল ওঝা। ওরটেগা কিছু কিছু বুঝল, অন্য দু-জন কিছুই বুঝল না। তবে ছেলেরা বুঝল বেশির ভাগই।
ঘন ঘন হাততালিতে ফেটে পড়ল জনতা। আরেকবার দেবীকে প্রণামের ধুম পড়ে গেল।
হাত তুলল বিটলাঙগোরগা।
নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেল কোলাহল।
বন্দিদের আরও কাছে আসার ইশারা করল ওঝা।
সময় উপস্থিত। সবাই উত্তেজিত। চোখ মঞ্চের দিকে।
জনতা যাতে শুনতে পায় সে জন্যে চেঁচিয়ে বলল ওঝা, হে সম্মানিত দেবী, শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?
ছেলেদের বুকের কাঁপুনি বেড়ে গেল। ঠিকমত বলতে পারবে তো ওরটেগা? পণ্ড করে দেবে না তো সব?
হঠাৎ শোনা গেল কথা, কাঁপা কাঁপা কথা। পুরুষ কণ্ঠ, না মহিলা, বোঝা গেল না। মনে হলো, দেবীর অনড় ঠোঁটের কাছ থেকেই এল কথাগুলো, হ্যাঁ, শুনছি।
অস্ফুট শব্দ করে উঠল জনতা, শব্দের একটা শিহরণ বয়ে গেল যেন। শ্রদ্ধায় আপনাআপনি মাথা নিচু হয়ে গেল জিভারোদের।
হে সম্মানিত দেবী, আবার বলল ওঝা, ওই তিনজন মানুষকে চিনতে পারছেন?
জবাব এলঃ নিশ্চয় পারছি! রাগান্বিত মনে হলো দেবীর কণ্ঠ।
পরস্পরের দিকে তাকাল ছেলেরা। ভালই অভিনয় করছে ওরটেগা। উতরে। যাবে মনে হচ্ছে।
ওঝা বলল, সর্দার হামু তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চায়। আপনিও কি তাই চান?
জবাব ও নিশ্চয়। মৃত্যুদণ্ডই তাদের একমাত্র শাস্তি।
চমকে উঠল ছেলেরা। বলে কি ওরটেগা? দিল নাকি সব গড়বড় করে?
ভাবার সময় পেল না, তার আগেই শোনা গেল আবার ওঝার প্রশ্ন, মৃত্যু কিভাবে হবে তাদের বলুন, হে সম্মানিত দেবী।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবতা। মনস্থির করে নিচ্ছে যেন দেবী। জিভারোদের উত্তেজনা চরমে, নিশ্বাস ফেলতে যেন ভুলে গেছে তারা।
অবশেষে শোনা গেল দেবীর রায়ঃ
স্বর্গে গিয়ে হবে তাদের মৃত্যু। দেবতা কালম-কালুম নিজের হাতে বলি দেবেন তাদের। প্রচণ্ড ঝড় বইবে তখন সমস্ত পৃথিবী জুড়ে। পাপীরা ধ্বংস হবে, দেবতার পূজারিরা হবে পুরস্কৃত। তিন বন্দিকে সঙ্গে করে স্বর্গে নিয়ে যাবেন ওঝা বিটলাঙগোরগা।
রায় শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল ইনডিয়ানরা। কি সাংঘাতিক পাপী ওই তিনজন। দেবতা নিজের হাতে বলি দেবেন, তার মানে মৃত্যুর পরেও তাদের পাপ মোচন। হবে না, নরকে জ্বলেপুড়ে মরবে। হাজার রকম শাস্তি পাবে।
তাছাড়া দেবী বলেছেন, সেদিন পাপীরা ধ্বংস হবে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল জিভারোরা। দেবীকে বার বার প্রণাম করল। বাঁচাও দেবী, তোমার পাপী বান্দাকে ছেড়ে দাও কালুম-কালুম, এমনি নানারকম গুঞ্জন।
হাত তুলল ওঝা।
চুপ হয়ে গেল গুঞ্জন।
রায় দিয়েছেন দেবী, বলল ওঝা। সবাই শুনেছ?
চিৎকার করে জানাল সবাই, শুনেছে।
হামু বলল, সম্মানিত বিটলাঙগোরগা, কালুম-কালুমের আদেশ তো শুনলে। বন্দিদেরকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে?
নিশ্চয়, বলল ওঝা। দেবতার আদেশ অমান্য করতে পারি? সর্দার হামু, তোমার দেবভক্তির কথা সব আমি বলব কালুম-কালুমকে।
খুব খুশি হলো সর্দার। বলল, আমার গায়ের কথাও বোলো, বিটলাঙগোরগা। আমি কথা দিচ্ছি, যারা এখনও খারাপ আছে, তারা ভাল হয়ে যাবে। কালুম-কালুম যেন শাস্তি না দেন।
ওঝা বলল, বলব।
সর্দার আর ওঝার বদান্যতায় খুশি হলো জনতা। শতমুখে তারিফ করতে লাগল দু-জনের।
আরও বিমর্ষ মনে হলো তিন বন্দিকে। ভেতরে ভেতরে আসলে পুলকে ফেটে পড়ছে, কিন্তু সেটা প্রকাশ হতে দিল না।
উল্লাস ঢেকে রাখতে খুব কষ্ট হলো ছেলেদের।
আবার অপেক্ষার পালা। কবে আসে হেলিকপ্টার? জিভারোরা অপেক্ষায়। রয়েছে কবে নামবে দেবতার উড়ুকু-নৌকা?
অবশেষে এল সেই দিন।
ছেলেরা সবে নাস্তা শেষ করেছে, এই সময় শোনা গেল এঞ্জিনের শব্দ। কপ্টারের শব্দ তাদের কানে এত মধুর শোনায়নি আর কখনও। তাড়াহুড়ো করে, বাইরে বেরিয়ে এল ওরা।
একের পর এক নামতে লাগল হেলিকপ্টার।
জিভারোদের চোখে ভয় মেশানো কৌতূহল। এমন আজব নৌকা এই প্রথম। দেখছে। অতি দুঃসাহসী দু-একজন কাছে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু রোটর ব্লেডের জোরাল বাতাস গায়ে লাগতেই পিছিয়ে গেল, যতখানি না ধাক্কায়, তার চেয়ে অনেক বেশি, ভয়ে ভক্তিতে। এই বাতাস তাদের বিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিল শতগুণ। ধরেই নিল, কালুম-কালুম অদৃশ্য ভাবে কাছেই রয়েছেন। তিনি বাতাসের দেবতা, শরীর অদৃশ্য রেখেছেন বটে, কিন্তু বাতাস সেটা প্রকাশ করে দিচ্ছেই। হেলিকপ্টারগুলোকে এক দফা প্রণাম করে নিল জিভারোরা।
এক সারিতে এগিয়ে গেল স্বর্গবাসীরা, তাদের পেছনে জিভারোদের দীর্ঘ মিছিল.। একে একে কপ্টারে উঠল ছেলেরা। আরেকটা কপ্টারে তোলা হলো তিন বন্দিকে। ওঠার সময় এমন ভান করল ওরা, যেন যেতে চায় না।
চাইবে কেন? ভাবল জিভারোরা। বলির শুয়োর হতে কে যেতে চায়?
বাকি রইল বিটলাঙগোরগা।
হামুকে কাছে আসার ইশারা করল সে।
এল সর্দার। চোখ ছলছল। ওঝাকে ভালবেসে ফেলেছিল।
মুখোশ খুলে বাড়িয়ে দিল ক্যাসাডো, নাও, এটা তোমাকে উপহার দিলাম। এটা দেখে আমাকে মনে কোরো।
চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারল না সর্দার। পাল বেয়ে গড়িয়ে নামল। ওঝার একটা হাত আলগোছে তুলে নিয়ে উল্টো পিঠে চুমু খেল। ধরা গলায় বলল, স্বর্গে গিয়ে আমাকে ভুলে যেও না, বিলাঙগোরগা।
কপ্টারে উঠল ক্যাসাডো।
এক এক করে আকাশে উঠতে লাগল কপ্টারগুলো।
বকের মত গলা লম্বা করে তাকিয়ে আছে জিভারোরা।
খোলা দরজা দিয়ে হাত বের করে নাড়ল কিশোর। ঠিকই চিনতে পারল পুমকা। জবাবে সে-ও নাড়ল। জিভারোরা বুঝল, এটা স্বর্গবাসীদের বিদায় সঙ্কেত। তারাও হাত নাড়তে শুরু করল।
খারাপ লাগল কিশোরের, সহজ-সরল মানুষগুলোকে এভাবে ধোঁকা দিয়ে। এসেছে বলে। কিন্তু এছাড়া আর করারই বা কি ছিল?
রোদে ঝকমক করছে সোনার মূর্তিটা, ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল এক সময়।
সবুজ বনের উপর দিয়ে উড়ে চলল হেলিকপ্টার।
ইস, কি একখান অ্যাডভেঞ্চারই না করে এলাম, বলল মুসা।
কিশোর আর রবিন জবাব দিল না, জিভারোদের কথা ভাবছে।
জিনা বলল, হ্যাঁ, অনেক দিন মনে থাকবে।
হউ! করে সায় জানাল রাফিয়ান।
.
একটা সামরিক বিমানক্ষেত্রে নামল হেলিকপ্টার।
কপ্টার বদল করল অভিযাত্রীরা। আরেকটা বেসামরিক বিমান বন্দরে নিয়ে গেল তারেদকে বেসামরিক হেলিকপ্টার! ওখান থেকে ছোট বিমানে করে ম্যানাও। ম্যানাও থেকে যাত্রীবাহী বড় বিমানে করে পৌঁছল রিও ডি জেনিরোতে।
সঙ্গে সঙ্গে বিমানটাকে ঘিরে ফেলল পুলিশ। তিন গোয়েন্দা আর জিনা নামল রাফিয়ানকে নিয়ে, ক্যাসাডো নামল। তিন হাইজ্যাকারকে সারা পথ পাহারা দিয়ে। এনেছে মিলিটারি পুলিশ। রিও ডি জেনিরোর পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে ফিরে গেল তারা।
ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরতে ছুটে এলেন চার জোড়া দম্পতি। কিশোরের চাচা-চাচা, রবিন, মুসা আর জিনার বাবা-মা, সবাই এসেছেন। যেদিন শুনেছেন ছেলেদের খবর পাওয়া গেছে, সেদিনই ছুটে এসেছেন ব্রাজিলে।
ক্যাসাডোর জন্যেও অপেক্ষা করছে উষ্ণ সম্বর্ধনা। অ্যাভিয়েশন ক্লাবের লোক, তার কিছু কলিগ আর বন্ধুবান্ধব এসেছে তাকে স্বাগত জানাতে। মৃত ধরে নিয়েছিল। যাকে, জ্যান্ত হয়ে সে আবার ফিরে এসেছে, আবেগে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল কেউ কেউ।
বিমান বন্দরের লাউঞ্জে ঢুকতেই ছেকে ধরল রিপোর্টাররা। ছবির পর ছবি তোলা হলো। প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো অভিযাত্রীদের। শেষে পুলিশকে এসে উদ্ধার করতে হলো।
আরও দিন কয়েক রিও ডি জেনিরোতেই থাকতে হলো ওদের।
তিন হাইজ্যাকারের বিচার শুরু হয়েছে। সাক্ষি দিতে হবে।
ছেলেদের সাক্ষ্যে শাস্তি হালকা হয়ে গেল জিমের। তাকে অল্প কিছুদিনের জেল দিলেন বিচারক। লম্বা জেল হলো ওরটেগা আর চ্যাকোর।
কিন্তু ওরা কিছু মনে করল না। অপরাধ করেছে, শাস্তি পেয়েছে। তিনজনেই দেখা করতে চাইল তিন গোয়েন্দা আর জিনার সঙ্গে।
দেখা করল ওরা।
জিভারোদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে বার বার ওদের ধন্যবাদ দিল। হাইজ্যাকাররা।
জিম কথা দিল, জেল থেকে বেরিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করবে। ভাল হয়ে যাবে। অপরাধের পথে পা বাড়াবে না আর কোনও দিন।
জেলখানা থেকে ফেরার পথে মুসা বলল, কিশোর, আবার বোধহয় আমাদের জঙ্গলে যেতে হবে। আমাজনের জঙ্গলে?
মাথা নাড়ল কিশোর, বোধহয়।