৫. গতি বাড়ছে নৌকার, সোজা এগিয়ে আসছে

0 Comments

কাছে এগিয়ে আসছে নৌকা। দাঁড় তুলে নিয়েছে টিকসি, দুই-তিনটা চিহ্নের ওপর একা চোখ রাখতে হচ্ছে তাকে। খালি মাথা ঘোরাচ্ছে এপাশ-ওপাশ।

ঘেউ ঘেউ করেই চলেছে রাফিয়ান।

তার মাথায় হাত রেখে শান্ত হতে বলল জিনা।

দুই ডাকাতের অবস্থা দেখে হাসি পেল অভিযাত্রীদের। ওরা চারজন চারটে চিহ্নের ওপর চোখ রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল, আর দুজনের কতখানি অসুবিধে হবে সে তো বোঝাই যায়।

নির্দেশ দিচ্ছে টিকসি, এদিকে আরেকটু বাঁয়ে…এহহে, বেশি হয়ে গেল… ডানে-ডানে-ডানে…

কিছু বলল ডারটি।

ঝট করে মুখ ফিরিয়ে তাকাল টিকসি। ভেলাটা দেখে রাগে জ্বলে উঠল। পরক্ষণেই আবার ফিরল চিহ্নগুলোর দিকে। নিচু গলায় বলল কিছু ডারটিকে। মাথা ঝাঁকাল-ডারটি। ভীষণ হয়ে উঠেছে দুজনেরই চেহারা।

গতি বাড়ছে নৌকার, সোজা এগিয়ে আসছে।

আরে, ধাক্কা মারো। বলে উঠল রবিন।

ধাক্কা খেয়ে দুলে উঠল ভেলা, আরেকটু হলেই পানিতে উল্টে পড়ে যাচ্ছিল রবিন, খপ করে তার হাত চেপে ধরল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, এই চোখের মাথা খেয়েছ! শয়তান কোথাকার! ভেবেছ কি?

তোরা কেন এসেছিস এখানে? গর্জে উঠল ডারটি।

রেগে গেল রাফিয়ান, দাঁতমুখ খিচিয়ে চেঁচাতে শুরু করল।

তোর বাপের জায়গা… দাড়টা তুলে নিল মুসা, রাগে কথা সরছে না।

কাঁধে হাত দিয়ে তাকে চুপ কুরুতে বুলল কিশোর। ডারটির দিকে ফিরল, রাফিয়ানের ভয়ে ধীরে ধীরে নৌকা পিছিয়ে নিচ্ছে ডাকাতটা।

দেখো, শান্তকণ্ঠে বলল গোয়েন্দাপ্রধান, তোমরা বেশি বাড়াবাড়ি করছ। হ্রদে অনেক জায়গা, আমাদের কাছে তোমাদের না এলেও চলে। খামোকা এসব করছ কেন?

পুলিশের কাছে যাচ্ছি, রাগে লাল হয়ে গেছে টিকসির মুখ, তোমরাও বাড়াবাড়ি কম করছ না। না বলে অন্যের ভেলা নিয়ে এসেছ, অন্যের বাড়িতে জোর করে ঘুমাছে, আমাদের খাবার চুরি করেছ।

আবার সেই এক কথা, হতাশ ভঙ্গিতে দু-হাত নাড়ল কিশোর। তোমরা কি করেছ? নৌকা বলে এনেছ? আমরা খাবার চুরি করেছি না তোমরা আমাদের খাবার চুরি করেছ? একটু আগে কি করলে? ধাক্কা মেরে ভেলা ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে। যাও না পুলিশের কাছে, বলো গিয়ে। আমাদেরও মুখ আছে।

ফুঁসছে ডারটি। দাঁড় তুলে নিল, ছুঁড়ে মারবে।

খবরদার, আঙুল তুলল কিশোর। অনেক সহ্য করেছি, আর না। এবার কুকুর লেলিয়ে দেব। তোমাকে ছেড়ার জন্যে অস্থির হয়ে আছে রাফি।

গরররর! কিশোরের কথায় সায় দিয়ে একসারি চমৎকার দাঁত ডারটিকে দেখিয়ে দিল রাফিয়ান।

দ্বিধায় পড়ে গেল দুই ডাকাত। নিচু গলায় কিছু আলোচনা করল। তারপর মুখ ফিরিয়ে গলার স্বর নরম করে টিকসি বলল, দেখো ছেলেরা, আমরা শান্তিতে ছুটি কাটাতে এসেছি, উইক-এণ্ডে। কিন্তু আমরা যেখানেই যাই দেখি তোমরা আছ, এটা আমাদের ভাল লাগে না। আসলে, আশেপাশে কেউ না থাকুক এটাই চাইছি আমরা। ঠিক আছে, একটা রফা করা যাক। তোমরা চলে যাও, আমরা তাহলে পুলিশকে কিছু বলব না। খাবার যে চুরি করেছ, একথাও না।

পুলিশের কাছে যেতে কে মানা করছে? যাও না, বলল কিশোর। রফাটফা কিছু হবে না। আমাদের যখন খুশি তখন যাব।

জ্বলে উঠল টিকসির চোখ। সামলে নিল। আবার আলোচনা করল ডারটির সঙ্গে। ফিরে জিজ্ঞেস করল, ছুটি কদিন তোমাদের? কবে যাচ্ছ?

আগামীকাল, বলল কিশোর।

আবার কিছু আলোচনা করল দুজনে।

আস্তে করে নৌকাটা কয়েক ফুট সরিয়ে নিল ডারটি। উঁকি দিয়ে পানির নিচে তাকাল টিকসি। মুখ তুলে ডারটির দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকাল।

ছেলেদের সঙ্গে আর একটাও কথা না বলে নৌকা নিয়ে চলে গেল ওরা।

কি করবে বুঝেছি, হাসিমুখে বলল কিশোর। কাল আমাদের চলে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকবে। তারপর আসবে. নিরাপদে লুটের মাল তুলে নেয়ার জন্যে। টিকসি পানির দিকে তাকিয়েছিল, খেয়াল করেছ? নৌকাটা দেখেছে। আমাদের মার্কারও দেখেছে।

তাহলে এত খুশি হয়েছ কেন? জিনা বুঝতে পারছে না। নৌকাটা আমরা তুলতে পারছি না। আর আগামীকাল চলে যেতেই হচ্ছে। স্কুল মিস করা চলবে না।

দূরে চলে গেছে নৌকা, সেদিকে চেয়ে বলল কিশোর, কাল যে যাব, এটা ইচ্ছে করেই বলেছি, ওদের সরানোর জন্যে। লুটের মাল তুলে নিতে পারব আমরা।

কিভাবে? একসঙ্গে বলল অন্য তিনজন। রাফিয়ানও মুখ বাড়াল সামনে, যেন সে-ও জানতে চায়।

নৌকা তো চাই না আমরা, কিশোর বলল, চাই মালগুলো। তাহলে নৌকাটা তোলার দরকার কি? ডুব দিয়ে গিয়ে ওগুলো তুলে নিয়ে এলেই হলো। মনে হয় কোন বস্তা বা বাক্সের মধ্যে রেখেছে। ভারি না হলে এমনিতেই তোলা যাবে, আর ভারি হলে দড়ি বেঁধে টেনে তুলতে হবে।

শুনতে তো ভালই লাগছে, কিন্তু যাচ্ছে কে? হ্রদের কালো পানির দিকে চেয়ে বলল রবিন। আমার ভাই ভয় লাগে।

আমি যাব, মুসা বলল। সেদিন থেকেই তো খালি ভেলায় করে ঘুরছি। একবারও সাঁতার কাটতে পারিনি। রথ দেখা কলা বেচা দুইই হবে। – ভালমত ভেবে দেখো, কিশোর সাবধান করল। যা ঠাণ্ডা, শেষে না নিউমোনিয়া বাধাও।

আরে দূর, পাত্তাই দিল না মুসা। পানিতে বরফ গুলে দিলেও ঠাণ্ডা লাগবে আমার।

বিশ্বাস করল সবাই। এই হ্রদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকলেও কিছু হবে না তার।

তিন-চার টানে জামাকাপড় সব খুলে ফেলল মুসা। খালি হাফপ্যান্টটা রাখল পরনে। এতই নিখুত ভাবে ডাইভ দিয়ে নেমে গেল, ঢেউ প্রায় উঠলই না। বকের মত গলা বাড়িয়ে ভেলার কিনারে ঝুঁকে এল অন্য তিনজন। দেখছে, হাত-পা নেড়ে নেমে যাচ্ছে একটা আবছা মূর্তি। কালো পানিতে কেমন যেন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে।

সময় কাটছে।

এতক্ষণ থাকে কি করে? উদ্বিগ্ন হলো রবিন। বিপদ-টিপদ…

না, বলল কিশোর। ওকে তো চেনই। অনেকক্ষণ দম রাখতে পারে। সেই যে সেবার…

হুসস করে ভেলার পাশে ভেসে উঠল মুসার মাথা। জোরে জোরে কয়েকবার শাস টেনে বলল, আছে!

কি কি দেখলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ভেলার কিনার খামচে ধরে ভেসে রইল মুসা। দম নিয়ে বলল, এক ডুবে সোজা গিয়ে নামলাম নৌকায়। ভাঙা, পুরানো। তুলতে গেলে খুলে যাবে জোড়ায়, পচে গেছে। পলিথিনের একটা ব্যাগে রয়েছে মালগুলো। বেজায় ভারি। টানাটানি করেছি, তুলতে পারলাম না।

নড়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না, নড়েনি।

তাহলে বেঁধে রেখেছে হয়তো। কিংবা অন্য কোনভাবে আটকে রেখেছে। দুড়ি বেঁধে দিয়ে আসতে হবে। তারপর সবাই মিলে টেনে তুলব। তবে তার আগে কিসে আটকানো রয়েছে, সেটাও খুলে দিয়ে আসতে হবে।

পানিতে বিচিত্র শিরশিরানি তুলে বয়ে গেল একঝলক বাতাস। সামান্য কাঁটা দিয়ে উঠল মুসার গা।

বাহ, ব্যায়ামবীরেরও কাঁপুনি ওঠে দেখি, হেসে বলল জিনা। বুঝলাম, তলায় কেমন ঠাণ্ডা। আমিও নামব ভাবছিলাম।

তাহলে এসো।

কাপড় আনিনি তো…ওঠো। গা মোছো।

দাঁড়াও, খানিকক্ষণ সাঁতার কেটে নিই।

না না, উঠে পড়ো, বাধা দিল কিশোর। পরে আরও ডোবাডুবি করতে হবে। বোটহাউস থেকে গিয়ে দড়ি আনতে হবে আগে। তীরের দিকে তাকাল সে।

নৌকা তীরের কাছে একটা শেকড়ে বেঁধে ওপরে উঠে গেছে দুই ডাকাত। দেখা যাচ্ছে না ওদেরকে। হঠাৎ আলোর ঝিলিক দেখতে পেল কিশোর, রোদে লেগে ঝিক করে উঠেছে কিছু।

আরেকবার দেখা গেল ঝিলিক। রবিনও দেখল এবার। কি ব্যাপার? সপ্রশ্ন চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন।

বুঝতে পারছ না? দূরবীণ। ব্যাটারা লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ রেখেছে আমাদের ওপর। মুসা যে ডুব দিয়ে এসেছে, তা-ও দেখেছে।

তাহলে? জিনার প্রশ্ন।

তাহলে আর কি? এখন আর ডুব দেয়া চলবে না।

এখন ডুব দিতে যাচ্ছেও না। আগে বোটহাউস থেকে দড়ি আনতে হবে, তারপর…

তারপরও হবে না। ওরা আজ সারাদিন নড়বে না ওখান থেকে।

তাহলে? আবার একই প্রশ্ন করল জিনা।

রাতে চাঁদ থাকবে, বলল কিশোর। ভেরি গুড আইডিয়া, ভেলায় চাপড় মারল জিনা।

লুটের মাল নিয়ে চলে যাব আমরা সকালে। তারপর আসবে সাহেবরা, পাবে ঠনঠন। বুড়ো আঙুল দেখাল সে।

এখন সরে যাচ্ছি আমরা? মুসা জিজ্ঞেস করল।

মোটেই না, মাথা নাড়ল কিশোর। আমরা চলে গেলে ওরা এসে তুলে নিয়ে যেতে পারে। সারাদিন লেকে থাকব আমরা, ঘুরব-ঘারব। ওদের পাহারা দেব আমরা, আমাদেরকে দেবে ওরা।

দুপুরে না খেয়ে থাকব?

না। রাফিয়ানকে নিয়ে তুমি আর জিনা থাকবে ভেলায়। আমি আর রবিন গিয়ে নিয়ে আসব খাবার।

যদি আবার খাবার চুরি করে?

পারবে না। ভাড়ারের আলমারির পেছনে আরেকটা ছোট ঘর আছে, দেখেছি। আলমারির ভেতর দিয়ে ঢুকতে হয়। খুব ভালমত না দেখলে বোঝা যায় না কোন্‌দিক দিয়ে কিভাবে ঢুকতে হয়। ওখানে রেখে আসব।

তুমি যখন দেখেছ, ওরাও তো দেখে ফেলতে পারে, রবিন বলল।

তা পারে, সেটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে। আর কি করার আছে বলো? তবে ওরা আমাদের চেয়ে বেশি উত্তেজিত, সেটা করতে যাবে বলে মনে হয় না। কাল চলে যাব বলেছি আমরা, খাবার চুরি করে রাগিয়ে দিতে চাইবে না।

যদি পিস্তল জোগাড় করে আনে? জিনার প্রশ্ন।

তাহলে আর কিছু করার থাকবে না আমাদের। দেখা ফ্রক, কি হয়।

হেসে খেলে কেটে গেল সারাটা দিন।

পশ্চিম দিগন্তে নেমে যাচ্ছে সূর্য। ডুবে গেল এক সময়। আকাশের লালিমা ঢেকে দিল এক টুকরো কালো মেঘ। শঙ্কা ফুটল জিনার চেহারায়।

ও কিছু না, সরে যাবে, আশ্বস্ত করল কিশোর।

ভেলা লুকিয়ে রেখে পাড়ে নামল ওরা। আস্তানায় ফেরার পথে চট করে একবার বোটহাউসে ঢুকে এক বাণ্ডিল দড়ি বের করে আনল মুসা।

ঠিকই অনুমান করেছে কিশোর, বৃষ্টি এল না। ঘণ্টাখানেক বাদেই পাতলা হয়ে গেল মেঘ, তারা দেখা দিল। পরিষ্কার আকাশ।

সিঁড়িমুখের কাছে রাফিয়ানকে পাহারায় রেখে অন্ধকার ভাঁড়ারে নামল ওরা। গোটা দুই মোম জ্বালল কিশোর।

না, কেউ ঢোকেনি ঘরে।

খাবার বের করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল ওরা।

শুয়ে পড়ো সবাই, বলল কিশোর। দশটা এগারোটার দিকে বেরোতে হবে।

একটা অ্যালার্ম-কুক থাকলে ভাল হত, বলল মুসা। রবিন ঠিকই বলেছিল।

আমার ঘুম আসবে না, রবিন বলল। ঠিক আছে, জেগে থাকি, সময়মত তুলে দেব তোমাদের।

ঘুম না আসুক, শুয়ে থাকো, বলল কিশোর। বিশ্রাম হবে।

শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা।.জিনার দেরি হলো।

চিত হয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছে রবিন। পাতালকক্ষে বাতাস ঢুকতে পারছে না ঠিকমত, তবু যা আসছে সিঁড়িমুখ দিয়ে, তাতেই কাঁপছে মোমের শিখা, ঘরের দেয়ালে ছায়ার নাচন। সত্যি, তাদের এই অভিযানের তুলনা হয় না। আর সে দেখেছে, যতবারই জিনা সঙ্গে থাকে, অ্যাডভেঞ্চার যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তার মনে পড়ল সেই প্রেতসাধকের কথা, সাগর সৈকতে গুপ্তধন উদ্ধারের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা, মৃত্যুখনির সেই বুক-কাঁপানো মৃত্যুহা…আর এবারকার অভিযানটাই বা কম কি? এক কাজ করবে-ভাবল সে, রকি বীচে ফিরেই কিশোরকে পটিয়ে-পাটিয়ে জিনাকেও গোয়েন্দাদের একজন করে নেবার কথা বলবে। জানে, সহজে রাজি হবে না কিশোর। আদৌ রাজি হবে কিনা, তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে রবিনের, তবু বলে দেখবে। এখন আর অসুবিধে নেই। রকি বীচেই স্কুলে ভরতি হয়েছে জিনা, ইচ্ছে করলে চার গোয়েন্দা করা যায়…

এগোরোটা বাজার দশ মিনিট আগে সবাইকে তুলে দিল রবিন।

সারাদিন পরিশ্রমের পর এত আরামে ঘুমিয়েছিল, উঠতে কষ্ট হলো তিনজনেরই।

তৈরি হয়ে নিল।

বেরিয়ে এল বাইরে।

যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনি শুয়ে আছে রাফিয়ান, কিন্তু সতর্ক। সাড়া পেয়ে উঠে বসল।

আকাশে অনেকখানি উঠে এসেছে চাঁদ। উজ্জল জ্যোৎস্না। সারা আকাশ জুড়ে সাঁতার কাটছে ছোট-বড় মেঘের ভেলা। কখনও চাঁদ ঢেকে দিচ্ছে, আবছা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে বনভূমি, চাঁদ বেরিয়ে এলেই হেসে উঠছে আবার হলুদ আলোয়।

তঁাবুর কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে বলল মুসা।

না যাক, কিশোর বলল। তবু সাবধানের মার নেই। কোন রকম শব্দ করবে। এসো যাই।

গাছপালা আর ঝোপের ছায়ার পাঁচ মিনিট হাঁটল ওরা হ্রদের পাড় ধরে। চাঁদের আলোয় চকচকে বিশাল এক আয়নার মত দেখাচ্ছে হ্রদটাকে। গুনগুন করে গান ধরল মুসা, জিনাও তার সঙ্গে গলা মেলাতে যাচ্ছিল, বেরসিকের মত বাধা দিয়ে বসল কিশোর। এই চুপ চুপ, গান গাওয়ার সময় নয় এটা। ব্যাটারা শুনলে…

ভেলায় চড়ল ওরা।

সবাই উত্তেজিত, রোমাঞ্চিত। সেটা সংক্রামিত হয়েছে রাফিয়ানের মাঝেও। চঞ্চল। কি করবে যেন বুঝে উঠতে পারছে না। রাতের এই অভিযান দারুণ লাগছে তার কাছে। আর কিছু করতে না পেরে এক এক করে গাল, হাত, চেটে দিতে লাগল সবার।

এক রত্তি বাতাস নেই। বড় বেশি নীরব। দাঁড়ের মৃদু ছপছপ শব্দও বেশি হয়ে কানে বাজছে। পানির ছোট ছোট ঢেউ আর বুদবুদ উঠে সরে যাচ্ছে ভেলার গা ঘেঁষে, রূপালি খুদে ফানুসের মত ফাটছে বুদবুদ্রগুলো।

এত সুন্দর রা খুব কমই দেখেছি, তীরের নীরব গাছপালার দিকে চেয়ে আছে রবিন। এত শান্তি। এত নীরব।

তাকে ব্যঙ্গ করার জন্যেই যেন কর্কশ চিৎকার করে উঠল একটা পেঁচা। চমকে গেল রবিন।

যাও, গেল তোমার নীরবতা, হাসতে হাসতে বলল মুসা।

রবিন ঠিকই বলেছে, কিশোর বলল, এত সুন্দর রাত আমিও কম দেখেছি। ইয়ার্ডে কাজ না থাকলে, এমনি জ্যোৎস্না রাতে ছাতে উঠে বসে থাকে রাশেদচাচা, অনেকদিন দেখেছি। আকাশের দিকে, চাদের দিকে চেয়ে চেয়ে কি যেন ভাবে। জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন। বিশ্বাস করবে? কেঁদে ফেলেছিল চাচা, দেশের কথা, তার ছেলেবেলার কথা বলতে বলতে। বাংলাদেশে নাকি এর চেয়েও সুন্দর চাঁদ ওঠে। ফসল কাটা শেষ হলে ধু-ধু করে নাকি ফসলের মাঠ, ধবধবে সাদা। শিশির ঝরে। চাঁদনি রাতে শেয়ালের মেলা বসে সেই মাঠে, বৈঠক বসে, চাচা নাকি দেখেছে। চাচা প্রায়ই বলে, কোনমতে ইয়ার্ডের ভারটা আমার কাধে গছাতে পারলেই চাচীকে নিয়ে দেশে চলে যাবে…

আরে, এই রাফি, আমার কান খেয়ে ফেলবি নাবি? বেরসিকের মত মুসার গান তখন থামিয়ে দিয়েছিল কিশোর, সেই শোধটা নিল যেন এখন।

ওই যে, বাক্সটা না? হাত তুলে বলল জিনা।

হ্যাঁ, বাক্সটাই মারকার। চাদের আলো চিকচিক করছে ওটার ভেজা পিঠে।

কাছে এসে ভেলা থামাল।

কাপড় খুলতে শুরু করল মুসা। জিনা সাঁতারের পোশাক পরে এসেছে।

রিঙের মত করে পেঁচানো দড়ির বাণ্ডিলের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা। ডাইভ দিয়ে পড়ল পানিতে। জিনা নামল তার পর পরই।

দম কেউ কারও চেয়ে কম রাখতে পারে না।

প্রথমে ভাসল জিনার মাথা।

তার কিছুক্ষণ পর মুসার। দম নিয়ে বলল, বাঁধন কেটে দিয়েছি পোটলাটার। আবার যেতে হবে, দড়ি বাঁধব।

জিনাকে নিয়ে আবার ডুব দিল মুসা।

দুজনে মিলে শক্ত করে ব্যাগের মুখে পেঁচিয়ে বাঁধল দড়ি। হ্যাঁচকা টান দিয়ে দেখল মুসা, খোলে কিনা। খুলল না। ওপর থেকে টেনে তোলা যাবে, বাঁধন খুলে পড়ে যাবে না ব্যাগে।

দড়ির আরেক মাথা হাতে নিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল মুসা। পাশে জিনা।

হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা ঝাঁকাল দুজনে।

দম নিয়ে ভেলায় উঠে এল জিনা আর মুসা।

তোয়ালেটা কোথায়? কাঁপতে কাঁপতে বলল জিনা। ইস, পানি তো না, বরফ।

তাদের দিকে নজর নেই এখন রবিন আর কিশোরের। দড়ি ধরে টেনে ব্যাগটা তুলতে শুরু করেছে। ভারের জন্যে একপাশে কাত হয়ে গেছে ভেলা। আরেকটু টান পড়লেই পানি উঠবে।

উল্টোধারে সরে গেল জিনা আর মুসা, রাফিয়ানকেও টেনে সরাল নিজেদের দিকে। সোজা হলো আবার ভেলা।

তীরের দিকে চেয়ে হঠাৎ ঘাউ ঘাউ করে উঠল রাফিয়ান।

তাড়াতাড়ি তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ধমক দিল জিনা, চুপ! চুপ! শঙ্কিত চোখে তাকাল কুকুরটা যেদিকে চেয়ে আছে সেদিকে। টিকসিরা আসছে না তো?

কাউকে দেখা গেল না। বোধহয় শেয়াল-টেয়াল দেখেছে রাফিয়ান।

ব্যাগটা তুলে আনা হয়েছে।

আর এখানে থাকার কোন মানে নেই। তীরের দিকে রওনা হলো ওরা।

ভালয় ভালয় আস্তানায় ফিরে যেতে পারলেই বাঁচে এখন।

ভেলা আগের মতই লুকিয়ে রাখা হলো। বোটহাউসে রাখলে আর ডারটি দেখে ফেললে সন্দেহ করবে। কি ঘটেছে বুঝেও যেতে পারে।

খাড়া পাড়, শেকড় বেয়ে উঠতেই কষ্ট হয়। ভারি একটা বোঝা নিয়ে ওঠা যাবে না। ব্যাগটা নিচে রেখে, দড়িটা দাঁতে কামড়ে ধরে আগে উঠে গেল মুসা। তার পেছনে রবিন আর জিনা। কিশোর নিচে রয়েছে। দড়ি ধরে ব্যাগটা টেনে তুলতে বলল ওদেরকে।

ব্যাগটা উঠে যেতেই সে-ও উঠে এল ওপরে।

চুপ করে আছে রাফিয়ান। তারমানে ঝোপের ভেতর ঘাপটি মেরে নেই কেউ, আচমকা ঘাড়ে এসে লাফিয়ে পড়বে না।

গাছের ছায়ায় ছায়ায় আস্তানায় ফিরে এল ওরা। রাফিয়ানকে সিঁড়িমুখের কাছে পাহারায় বসিয়ে অন্যেরা নেমে এল ভাড়ারে।

মোম জালল কিশোর।

আগে কিছু খেয়ে নিলে কেমন হয়? প্রস্তাব দিল মুসা।

ভালই হয়, জিনাও রাজি।

স্যাণ্ডউইচ বের করে খেতে শুরু করল তিনজনে, কিশোর বাদে। সে ব্যাগ। খোলায় ব্যস্ত।

যা বাঁধা বেঁধেছ, ভেজা গিট কিছুঁতেই খুলতে পারল না গোয়েন্দাপ্রধান, কাটতে হবে। ছুরি বের করল সে।

বাঁধন কাটার পরেও ব্যাগের মুখ দিয়ে ভেতরের বাক্সমত জিনিসটা বের করা গেল না। দীর্ঘ পানিতে থেকে থেকে বাক্সের গায়ে আঠা হয়ে লেগে গেছে প্লাসটিকের চাদর। কেটে, ছিড়ে তারপর বের করতে হবে।

দাও তো, আমাকেও একটা দাও, হাত বাড়াল কিশোর।

একটা স্যাণ্ডউইচ দিল জিনা।

খেয়ে নিয়ে আবার চাদর কাটায় মন দিল কিশোর। ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সবাই।

স্টীলের একটা ট্রাংক বেরোল, ফাঁকগুলো রবারের লাইনিং দিয়ে এমন ভাবে বন্ধ, পানি ঢোকার পথ নেই।

তালা লাগানো নেই, নইলে আরেক ফ্যাকড়া বাধত।

ডালা তুলতে শুরু করল কিশোর। দুরুদুরু করছে সবার বুক। ঝুঁকে এসেছে ট্রাংকের চারপাশ থেকে।

ডালা তোলা হলো। ভেতরে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্লাসটিকের অসংখ্য ছোট বাক্স। সব এক সাইজের।

গহনার বাক্স! হাত বাড়িয়ে একটা বাক্স তুলে নিল জিনা। ঢাকনা খুলে স্থির হয়ে গেল।

সবার চোখেই বিস্ময়।

কালো মখমলের শয্যায় শুয়ে আছে একটা অপূর্ব সুন্দর নেকলেস। মোমের আলোয় জ্বলছে যেন পাথরগুলো। নিশ্চয় কোন রানী-মহারানীর।

এটার ছবি দেখেছি আমি, বিড়বিড় করল জিনা। ফেলোনিয়ার রানীর গলায়।। তিনি পরে তার এক ভাস্তিকে জন্মদিনে প্রেজেন্ট করে দেন। ভাস্তির বর হলিউডের

নামকরা অভিনেতা, বিরাট বড়লোক।

হীরা, না? মুসা বলল। দাম কত হবে? একশো পাউণ্ড?

মাঝে মাঝে এত বোকার মত কথা বলো না তুমি। একশো হাজার পাউণ্ডেও দেবে না।

থাকগে তাহলে, আমার ওসব কোনদিনই লাগবে না, হাত নাড়ল মুসা।

তুমি হার দিয়ে কি করবে? ব্যাটাচ্ছেলে হার পরে? জিনা বলল।

কে বলল পরে না? হিপ্পি মার্কা গায়কগুলোর গলায় তো প্রায়ই দেখি।

আরও কয়েকটা বাক্স খুলে দেখল ওরা। প্রতিটা গহনা দামী। হীরা-পান্না-চুনিমুক্তা, সবই রয়েছে। হার, কানের দুল, চুরি, আঙটি, প্রায় সব ধরনের অলঙ্কার আছে। রাজার সম্পদ।

একসঙ্গে এত গহনা কোন মিউজিয়ামেও দেখিনি, বলল রবিন।

যাক, ভালই হলো, ফোঁস করে চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল কিশোর, চোরের হাতে পড়ল না। ভাগ্যিস আমরা এসে পড়েছিলাম। নইলে পুলিশ জানতই না, অখ্যাত এক হ্রদের তলায় লুকানো ছিল এগুলো।

নেব কি করে? মুসার প্রশ্ন।

সেটাই ভাবছি। ট্রাংক নিয়ে ডারটি আর টিকসির সামনে দিয়ে যাওয়া যাবে। এক কাজ করো, যার যার ব্যাগে ভরে ফেল, যতটা পারা যায়। বাকিগুলোর বাক্স ফেলে দিয়ে রুমালে পোটলা বাঁধব।

ভাগাভাগি করে ব্যাগে ভরার পরও অনেক জিনিস রয়ে গেল। বাক্স থেকে খুলে ওগুলো রুমালে বাঁধতে হলো, তাতেও লাগল চারটে রুমাল। চারজনের কাছ থাকবে চারটে, ঠিক হলো।

সকালে উঠে প্রথমে কোথায় যাব? রবিন জিজ্ঞেস করল। পুলিশ?

এখানকার পুলিশের যা সুরত দেখে এলাম, মুখ বকাল কিশোর। হবে না। পোস্ট অফিস থেকে মিস্টার নরিসকে ফোন করব। তিনি কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন। তাঁকে বিশ্বাস করা যায়।

আমার ঘুম পাচ্ছে, বড় করে হাই তুলল মুসা, মুখের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে আঙুলগুলো কলার মোচার মত বানিয়ে নাড়ল বিচিত্র ভঙ্গিতে, ঢুকিয়ে দেবে যেন মুখের ভেতর।

শুয়ে পড়ল সবাই। কিন্তু ঘুম কি আর আসে? বিপদ কাটেনি এখনও।

রাফিয়ানের চেঁচামেচিতে সকালে ঘুম ভাঙল ওদের। সিঁড়িমুখ দিয়ে রোদ ঢুকছে।

লাফিয়ে উঠে বসল কিশোর। অন্যদের ঘুমও ভেঙে গেছে।

কি হয়েছে দেখার জন্যে ওপরে উঠে এল গোয়েন্দাপ্রধান।

টিকসি দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে ভাব জমাতে চাইল, তোমাদের কুকুরটা কিন্তু খুব ভাল। ধারেকাছে ঘেষতে দেয় না কাউকে।

ধন্যবাদ, নিরস গলায় বলল কিশোর।

দেখতে এলাম, খাবার-টাবার কিছু আছে কিনা, হাসল টিকসি। লাগবে কিছু?

হঠাৎ দরদ এমন উথলে উঠল কেন? কেন, সেটা খুব ভালমতই বুঝতে পারছে কিশোর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের হাত থেকে নিস্তার পেতে চায় দুই ডাকাত।

খাবার তাহলে লাগবে? কিশোরের তীব্র খোঁচাটা কোনমতে হজম করল টিকসি। তাছাড়া তাকে ভয়ও পেতে আরম্ভ করেছে। বড় বেশি ধার ছেলেটার জিভে। চাঁচাছোলা কথা। কাউকে পরোয়া করে বলে না।

নো, থ্যাংকস, আবার বলল কিশোর। অনেক খাবার বেঁচে গেছে। কারও লাগলে বরং দিতে পারি।

ও……তা, আমতা আমতা করছে টিকসি। কি বলতে গিয়ে আবার কি জবাব শুনতে হবে কে জানে! যাচ্ছ কখন?

যাব। আজ স্কুলে হাজিরা দিতেই হবে।

তাড়াতাড়ি করো তাহলে। বৃষ্টি আসবে।

আকাশের দিকে তাকাল কিশোর। কই, মেঘের নামগন্ধও তো দেখছি না।

অন্যদিকে চোখ ফেরাল টিকসি।

মুচকি হেসে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে। টিকসি যেমন চাইছে ওরা চলে যাক, কিশোরও চাইছে সে চলে যাক। মহিলা দাঁড়িয়ে থাকলে ওদেরও বেরোতে অসুবিধে।

দশ মিনিটেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে এল চারজনে।

টিকসি চলে যাচ্ছে, ঝোপের ওপর দিয়ে মাথা দেখা যাচ্ছে তার। ফিরে তাকাল একবার, এক মুহূর্ত থেমে দেখল, তারপর ঘুরে আবার হাটতে লাগল।

জলার ধার দিয়ে যেতে ভালই লাগবে, রবিন বলল।

সেদিন আসার সময় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, ভালমত দেখতে পারিনি। আজ দেখব।

কথা বলতে বলতে চলেছে ওরা। জোরে পা চালাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি পোড়া বাড়ির কাছ থেকে সরে যাওয়া যায়, ভাল।

সময়ের হিসেব রাখছে না ওরা, দরকার মনে করছে না। মুসার একটা কথায় হেসে উঠল সবাই। এই সময় হঠাৎ পেছনে চেয়ে গলা ফাটিয়ে ঘেউঘেউ জুড়ে দিল রাফিয়ান।

ফিরে তাকাল সবাই। চমকে উঠল। দৌড়ে আসছে দুই ডাকাত।

আরে, জলা ভেঙেই আসছে। গাধা নাকি? রবিন বলল

শর্ট-কাট, কিশোর বলল। চোরাকাদায় পড়লে ঠেলা বুঝবে। মরুকগে ব্যাটারা। হাঁটো। পথ ধরে। আমরা জলায় নামছি না।

চলার গতি বাড়িয়ে দিল ওরা।

পাগল হয়ে গেছে, ফিরে চেয়ে বলল জিনা।

হবারই কথা, কিশোর বলল। এভাবে নাকের ডগা দিয়ে লাখ লাখ ডলার চলে যাচ্ছে। নৌকায় মাল না পেয়ে নিশ্চয় আমাদের ভাড়ারে ঢুকেছিল। ট্রাংক আর বাক্সগুলো ওভাবে রেখে আসা উচিত হয়নি। জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এলে হত।

আসুক না, কি হবে? মুসা বলল। রাফি আছে। তাছাড়া আমরা চারজন। দুজনের সঙ্গে পারব না? পিস্তল নেই ওদের কাছে।

তা-ও কথা ঠিক। দেখি কি হয়।

ছপছপ করে কাদাপানি ভেঙে আসছে ডারটি। তার পেছনে টিকসি। কোথায় পা ফেলছে, খেয়ালই করছে না।

অনেক কাছে এসে পড়ল দুজনে।

গোয়েন্দাদের সঙ্গে বোঝা, দৌড়ানোর উপায় নেই। হাঁপিয়ে পড়ল।

এভাবে হবে না, মাথা নাড়ল কিশোর। ধরে ফেলবে। তার চেয়ে দাঁড়াই। দেখা যাক কি করে।

ফিরে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে শুরু করল রাফিয়ান। ভয়ানক হয়ে উঠেছে চেহারা। কিন্তু কেয়ার করছে না ডারটি। বাঘা কুকুরের সঙ্গে লাগতেও যেন আপত্তি নেই আর

এখন। যে করেই হোক, গহনাগুলো তার চাই।

আর বেশি বাকি নেই, ধরে ফেলবে ছেলেদের, এই সময় বিপদে পড়ল ডারটি। আঠাল কাদায় আধ হাত ডুবে গেল পা। কোনমতে টেনে তুলে আরেক জায়গায় ফেলল, ভাবল ওখানটায়ও নরম কাদা। কিন্তু তলায় পাথর বা শক্ত অন্য কিছু রয়েছে, যেটাতে জোরে পা পড়ায় বেকায়দা রকম কাত হয়ে গেল পা, গোড়ালি গেল মচকে। চেঁচিয়ে উঠল, বাবারে, গেছি। আমার পা গেল! উফ! আধহাত কাদার মধ্যেই বসে পড়ল সে।

তাকে ভোলার জন্যে লাফিয়ে এগিয়ে আসতে গিয়ে টিকসিরও দুই পা দেবে গেল কাদায়, একেবারে হাঁটু পর্যন্ত। টেনে তোলার জন্যে জোরাজুড়ি কররতেই আরও ডুবে গেল পা। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে, ভাবল চোরা কাদায় ডুবে যাচ্ছে।

ভালমত আটকেছে দুজন। এমন এক জায়গায়, কেউ গিয়ে সাহায্য না করলে বেরিয়েই আসতে পারবে না। সাহায্যের জন্যে অনুনয় শুরু করল।

মায়া হলো রবিনের। যাব নাকি?

পাগল হয়েছ, বলল মুসা।

থাক, কিশোর বলল, শিক্ষা হোক কিছুটা। আমরা গিয়ে তোক পাঠিয়ে দেব। চোরাকাদায় পড়েনি, মরবে না। তুলতে গিয়ে আমরাই শেষে পড়ব বিপদে।

ওদেরকে দেখে খুশি হলো পোস্টম্যান। কেমন কেটেছে, অ্যাঁ? টু-ট্রীজে?

খুব ভাল, বলে অন্যদের রেখে টেলিফোনের দিকে এগোল কিশোর।

বাড়িতেই পাওয়া গেল মিস্টার নরিসকে। শুনে তো প্রথমে চমকে উঠলেন। বললেন, তোমরা ওখানেই থাকো। আমি আসছি।

ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেলেন নরিস। ছেলেদের গাড়িতে তুলে নিলেন। গ্রামরক্ষীর কাছে গিয়ে কিছুই হবে না, সোজা চললেন শেরিফের কাছে। জেলখানাটার কাছেই শেরিফের অফিস।

শেরিফ লোক ভাল, বুদ্ধিমান। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, লিকলিকে শরীর। সব শুনে শিস দিয়ে উঠলেন। পোটলা খুলে প্রথমেই তুলে নিলেন ফেললানিয়া নেকলেসটা।

এটা যে কত খোঁজা খুঁজেছে পুলিশ, বললেন তিনি। বেল বাজিয়ে সহকারীকে ডেকে সংক্ষেপে সব জানিয়ে বললেন হ্যারি, তিনজন লোক নিয়ে যাও। ডাকাতদুটোকে তুলে আনোগে।

অবাক হয়ে শুনল হ্যারি। ছেলেদের দিকে চেয়ে সামান্য মাথা ঝাঁকাল। হেসে বলল, তোমরা বাহাদুর। যাই, নিয়ে আসিগে পাজিগুলোকে।

গহনাগুলো শেরিফের দায়িত্বে দিয়ে দিল ছেলেরা। তবে প্রতিটি জিনিসের একটা লিস্ট করে তাতে রিসিভড লিখিয়ে শেরিফের স্বাক্ষর নিয়ে নিল। সাক্ষী রইলেন মিস্টার নরিস। কাগজটা ভাঁজ করে সযত্নে পকেটে রেখে দিল কিশোর।

পাখোয়াজ ছেলে, তারিফ করলেন শেরিফ। বড় হয়ে কি হওয়ার ইচ্ছে?

হয়তো গোয়েন্দাই থেকে যাব, বলল কিশোর। জানি না এখনও।

শেরিফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরোল ওরা। খামারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেক চাপাচাপি করলেন মিস্টার নরিস, কিন্তু রাজি হলো না ছেলেরা। স্কুল কামাই করবে না।

শেষে তাদেরকে বাস স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন মিস্টার নরিস।

বিদায় নেয়ার আগে একে একে সবাই হাত মেলাল তাঁর সঙ্গে। গম্ভীর মুখে রাফিয়ানও একটা পা বাড়িয়ে দিল।

হেসে উঠলেন মিস্টার নরিস। তুই একটা কুকুর বটে, রাফি।তোর মত একটা কুকুর যদি আমার থাকত।

গোঁ গোঁ করে কুকুরে-ভাষায় কিছু বলল রাফিয়ান, বোধহয় বলেছে, ঠিক আছে, যান। জিনা তাড়িয়ে দিলেই চলে আসব আপনার কাছে।

তার কথা যেন বুঝতে পারল জিনা, তাড়াতাড়ি গলার বেল্ট ধরে রাফিয়ানকে কাছে সরিয়ে নিল।

হাসল সবাই।

আবার এদিকে কখনও বেড়াতে এলে যেন তার বাড়িতে ওঠে, বার বার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিলেন মিস্টার নরিস। .

বাস আসতে বোধহয় দেরি আছে। মুসা বলল, কিছু খেয়ে নিলে কেমন হয়?

খুব ভাল, বলল কিশোর। আমিও একথাই ভাবছিলাম। খাবারের দোকানটা দেখিয়ে বলল, চলো, ডিকের মায়ের সঙ্গেও দেখা হবে। বলেছিলেন ফেরার পথে দেখা করে যেতে। –

ছেলেদের দেখে খুব খুশি হলেন বৃদ্ধা। তবে আগের বারের মতই রাফিয়ানকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন না, দরজার বাইরে রাখলেন। আদর-অভ্যর্থনার পর টুকটাক আরও কিছু কথা, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আজ কটা স্যাণ্ডউইচ লাগবে?

আজ বেশি লাগবে না, বাড়ি ফিরছি তো, বলল কিশোর। তাছাড়া পথে খিদে পেলে খাবার পাওয়া যাবে। হিসেব করে বলল, চার-পাঁচে বিশটা।

ঠিক আছে, ঘুরে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন বৃদ্ধা। দরজার কাছে গিয়ে ফিরলেন। হ্যাঁ, কেউ এলে ডেকো।

চলে গেলেন দরজার ওপাশে।

Categories: