১. বাস থেকে নেমেই কুকুরটার ওপর চোখ পড়ল তিন গোয়েন্দার

0 Comments

জিনার সেই দ্বীপ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ: জুলাই, ১৯৯৪

বাস থেকে নেমেই কুকুরটার ওপর চোখ পড়ল তিন গোয়েন্দার। কিংবা বলা যায় কুকুরটাই ওদেরকে তার দিকে তাকাতে বাধ্য করল, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে একনাগাড়ে ঘেউ ঘেউ করছে।

ওই যে রাফি, মুসা বলল। জিনা কোথায়?

কেন, রাফির পাশে দেখতে পাচ্ছ না? হেসে বলল কিশোর।

কই?…ও, আবার ছেলে সাজার ভূত চেপেছে মাথায়।

মালপত্রগুলো ভাগাভাগি করে হাতে তুলে নিয়ে সেদিকে এগোল তিনজনে। কাছে গিয়ে মুসা বলল, আর গম্ভীর হয়ে থাকার ভান করে লাভ নেই, জিনা, চিনে ফেলেছি।

ম্লান হাসল জিনা। তোমরা এলে তাহলে। খুব খুশি হয়েছি।

তুমি অমন মুখ গোমড়া করে রেখেছ কেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

আম্মার শরীরটা ভাল না।

কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল তিন গোয়েন্দা। কেরিআন্টিকে খুব ভালবাসে ওরা।

কি জানি, গরমটা বোধহয় সহ্য করতে পারেনি।

 হু, গম্ভীর হয়ে মাথা দোলাল কিশোর। হতে পারে। যা গরম পড়েছে।

 রবিন জানতে চাইল, আংকেলের কি খবর?

— কি আর হবে, জবাব দিল জিনা। আম্মার শরীর খারাপ হলে যা হয়। দুশ্চিন্তা করে করে মেজাজ আরও চড়ে গেছে। কাউকে দেখলেই খেঁকিয়ে ওঠে।

খাইছে! শঙ্কিত হয়ে পড়েছে মুসা, ও-বাড়িতে থাকব কি করে তাহলে?

অত ভাবছ কেন? হেসে আশ্বাস দিল জিনা, থাকার কি আর জায়গা নেই? বাড়িতে থাকতে না পারলে আমার দ্বীপটায় চলে যাব। ছুটি কাটাতে কোন অসুবিধে হবে না।

গরমের লম্বা ছুটি শুরু হয়েছে। ছুটি কাটাতে গোবেল বীচে জিনাদের বাড়িতে এসেছে তিন গোয়েন্দা। এখানে এলে খুব আনন্দে সময় কাটে ওদের। কিন্তু আসার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা দুঃসংবাদ শুনবে এবার, ভাবেনি। শুরুতেই কেমন গড়বড় হয়ে গেল।

কিশোর বলল, তা নাহয় গেলাম। কিন্তু আন্টির শরীর খারাপ থাকলে আমাদের আনন্দ জমবে না।

চলো আগে, বাড়ি তো যাই। তারপর দেখা যাবে।

জোরে জোরে লেজ নাড়ছে রাফি। তার দিকে কারও নজর নেই বলে খ করে অভিযোগ করল। এই

মুসা হেসে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস রে, রাফি?

 রাফি জবাব দিল, ঘউ, অর্থাৎ, ভাল।

ট্যাক্সি নিল ওরা।

গোবেল ভিলায় পৌঁছল। দরজা খুলে দিল এক মাঝবয়েসী গোমড়ামুখো মহিলা। চেহারা দেখে মনে হয়, হাসতে শেখেনি। এমন দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকাল যেন, ওরা একেকটা শুঁয়াপোকা।

দরজা খুলে দিয়েই চলে গেল সে।

বাপরে বাপ, কি ভঙ্গি! কে? নিচু গলায় জিনাকে জিজ্ঞেস করল মুসা।

আমাদের নতুন রাঁধুনী।

কেন আইলিন কোথায়?

ওর মায়ের পা ভেঙেছে। মাকে দেখতে গেছে। কদিনের জন্যে মিসেস টোডকে রেখেছে আম্মা।

যেমন নাম তেমন চেহারা! হুহ। বেঙই বটে! বেশিদিন থাকবে না তো? আইলিন কবে আসবে?

ঠিক নেই।

ট্যাক্সি বিদেয় করে দিয়ে মালপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকল ওরা। বসার ঘরে সোফায় শুয়ে আছেন মিসেস পারকার। ওদের দেখে হাসলেন।

চেহারা দেখে চমকে গেল কিশোর। এ-কি হাল হয়েছে! চোখ বসা, মুখ শুকনো, ফ্যাকাসে, এক ছটাক রক্ত নেই যেন শরীরে।

কি হয়েছে, আন্টি? এ-অবস্থা হলো কি করে?

 ও কিছু না, সেরে যাবে। তোমরা কেমন আছ?

ভাল…

ওপরে যাও। ব্যাগট্যাগগুলো রেখে, হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমি চা দিতে বলছি।

– আব্বা কোথায়? জানতে চাইল জিনা।

হাঁটতে বেরিয়েছে। গুহা ছেড়ে কি আর যেতে চায়। জোর করে পাঠালাম।

গুহা হলো জিনার বাবার স্টাডি, যেখানে ঢুকলে আর বেরোতে চান না তিনি, গবেষণা করে কাঁটান–জানা আছে তিন গোয়েন্দার।..

ওপরে উঠে পরিচিত সেই পুরানো শোবার ঘরে ঢুকল ওরা। জানালা দিয়ে সাগর চোখে পড়ে। অতি মনোরম দৃশ্য। কিন্তু এ-মুহূর্তে সাগর ওদেরকে খুশি করতে পারল না। কেরিআন্টির অসুখ মন খারাপ করে দিয়েছে।

*

পরদিন সকাল। কিশোরের ঘুম ভাঙল সবার আগে। জানালা দিয়ে রোদ। এসে পড়েছে। কানে আসছে সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একটানা ছলাৎ ছল, ছলাৎছল। বিছানা থেকে উঠে জানালায় এসে দাঁড়াল সে। ঘন নীল আকাশের ছায়া সাগরকেও নীল করে দিয়েছে। প্রণালীর মুখে যেন ফুটে রয়েছে জিনার সেই দ্বীপটা; গোবেল আইল্যান্ড।

খুব সুন্দর, না? পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মুসা। আমি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি।

নাস্তা না করেই?

এসে করব।

তিনজনে এসে দাঁড়াল জিনার ঘরের সামনে। একবার ডাকতেই সাড়া এল। দরজা খুলল জিনা। সে আগেই উঠেছে। ওদের অপেক্ষাতেই ছিল।

কিশোর বলল, চলো, আন্টিকে দেখে যাই।

উঠেই দেখতে গেছি আমি, জিনা বলল। দরজা খোলেনি। ঘুমাচ্ছে।

ও, তাহলে থাক। ঘুম ভাঙানো ঠিক না।

বাড়ির পেছন দিয়ে একটা পথ আছে সৈকতে যাওয়ার। সেটা ধরে চলল। চারজনে। পেছনে লেজ নাড়তে নাড়তে চলল রাফি। লম্বা জিভ বের করে দিয়েছে খুশিতে। সে জানে, মজা হবে এখন।

প্রচুর সাঁতার-টাতার কেটে বাড়ি ফিরল ওরা। খুব খিদে পেয়েছে। বাগানের কোণে বসা ছেলেটাকে নজরে পড়ল রবিনের। বোকা বোকা চেহারা। তেরো-চোদ্দ বছর বয়েস।

ও কে?

বেঙাচি, জবাব দিল জিনা।

মানে!

বেঙের পোনা তো বেঙাচিই হয়, নাকি?

মিসেস টোডের ছেলে? জানতে চাইল কিশোর।

 হ্যাঁ। টেরি।

 খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। আবার টেরি! শুঁটকি টেরির মত শয়তান না তো?

তার চেয়ে খারাপ। আমাকে দেখলেই ভেঙচি কাটে, আজেবাজে ছড়া বলে খেপায়।

মারছে রে! শুঁটকি থেকে শেষে বেঙাচি টেরির পাল্লায় এসে পড়লাম…

মুসার কথা শেষ হতে না হতেই সুর করে বলে উঠল ছেলেটা:

জিনা, ঘিনা; জিনার মুখে ছাই,
দাঁড়কাকে ঠুকরে দিলে আর রক্ষা নাই!

রাগে লাল হয়ে গেল জিনার মুখ। তিন গোয়েন্দা মনে করল, ছুটে গিয়ে ঠাস করে এখন ছেলেটার গালে চড় কষাবে সে। কিন্তু ওদেরকে অবাক করে দিয়ে কিছুই করল না। বরং রাফির কলার ধরে আটকাল, ছেলেটার কাছে। যেতে দিল না। করুণ কণ্ঠে বলল, আমাকে দেখলেই এই ছড়া বলে! আর সহ্য হয় না।

মুসা ধমক দিয়ে বলল, এই ছেলে, খেপাও কেন?

টকটকে লাল মুখ ছেলেটার। মুসার কথায় মুখ বাঁকিয়ে হাসল। আবার শুরু করল, জিনা, ঘিনা…

দেখো, ভাল হবে না কিন্তু! এগিয়ে গেল মুসা।

কিন্তু মুসা তার কাছে পৌঁছার আগেই একছুটে রান্নাঘরে ঢুকে গেল ছেলেটা।

জিনার দিকে ফিরে বলল বিস্মিত মুসা, জিনা, ওর অত্যাচার সহ্য করো! এখনও কিছু করোনি!

চড়িয়ে সবগুলো দাঁতই তো ফেলে দিতে ইচ্ছে করে, নিতান্ত অসহায় ভঙ্গিতে হাত ডলল জিনা, কিন্তু উপায় নেই। আম্মার শরীর খারাপ। টেরিকে কিছু করলে ওর মা যদি কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে আম্মা। সেজন্যেই কিছু করতে পারি না।

জিনা, সত্যি অবাক করলে, কিশোর বলল। তোমার যে এতটা সহ্যশক্তি, জানতাম না।

আম্মা নিশ্চয় উঠে পড়েছে এতক্ষণে। বিছানায় নাস্তা দিয়ে আসতে হবে। তোমরা দাঁড়াও এখানে, আমি আসছি। রাফিকে আটকে রাখো, টেরিকে দেখলেই কামড়াতে যাবে।

 জিনা ঘরে ঢুকে যেতেই অস্থির হয়ে উঠল রাফি। নাক তুলে কি যেন শুঁকছে।

রান্নাঘরের দরজায় বেরিয়ে এল একটা ছোট কুকুর। সাদা রঙ, ময়লা, যেন বহুদিন ধোঁয়া হয়নি। মাঝে মাঝে বাদামী ছোপ। দেখতে একটুও ভাল না। রাফিকে দেখেই দু-পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে ফেলল।

ওটাকে দেখেই গলা ফাটিয়ে ঘাউ ঘাউ করে উঠল রাফি। কিশোরের হাত থেকে হ্যাঁচকা টানে কলার ছুটিয়ে নিয়ে দিল দৌড়।

রাফি, রাফি, আয় বলছি! চিৎকার করতে করতে তার পেছনে ছুটল কিশোর।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। কুকুরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাফি। ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে কুকুরটা। চার পা শূন্যে তুলে দিয়ে কেউ কেউ করছে। তার কান কামড়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল রাফি।

কুকুরটার চিৎকারে রান্নাঘরের দরজায় বেরিয়ে এল মিসেস টোড। হাতে একটা সসপ্যান।

হেই কুত্তা, হেই! বলে লাফ দিয়ে নামল নিচে। সসপ্যান দিয়ে বাড়ি মারল রাফিকে।

ঝট করে সরে গেল রাফি। বাড়িটা তার গায়ে না লেগে লাগল অন্য কুকুরটার গায়ে। আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল ওটা।

টেরিও বেরিয়ে এল। একটা পাথর তুলে নিয়ে রাফিকে ছুঁড়ে মারার সুযোগ খুঁজতে লাগল।

চেঁচিয়ে উঠল মুসা, খবরদার! মেরে দেখো খালি! শয়তান ছেলে কোথাকার!

ভীষণ চেঁচামেচি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন পারকার আংকেল। ধমক দিলেন, অ্যাই, কি হচ্ছে! হচ্ছে কি এসব!

দমকা বাতাসের মত যেন ঘর থেকে উড়ে বেরোল জিনা। ছুটে গেল রাফির দিকে।

আবার কুকুরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাফি। কান না ছিঁড়ে আর ছাড়বে না।

অ্যাই, সরাও, সরাও কুত্তাটাকে! ধমকে উঠলেন মিস্টার পারকার।

কাছেই একটা কল আছে। পাইপ লাগানো। বাগানে পানি দেয়া হয়। ছুটে গিয়ে পাইপটা তুলে নিয়ে কুকুর দুটোর ওপর পানি ছিটাতে শুরু করল রবিন। হঠাৎ এভাবে গায়ে পানি পড়ায় চমকে গিয়ে লাফিয়ে সরে দাঁড়াল রাফি। এই সুযোগে উঠে সোজা রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিল অন্য কুকুরটা।

ইচ্ছে করেই পাইপের মুখ সামান্য সরিয়ে টেরিকেও ভিজিয়ে দিল রবিন। ছেলেটাও চেঁচিয়ে উঠে দৌড় দিল তার কুকুরের পেছনে।

কড়া চোখে রবিনের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে ধমক লাগালেন আংকেল, ওকে ভেজালে কেন?…জিনা, তোকে না কতবার বলেছি। কুত্তাটাকে বেঁধে রাখতে!…মিসেস টোড, তুমিও বাপু কথা শোনে না। রান্নাঘর থেকে বেরোতে দাও কেন কুত্তাটাকে? বেঁধে রাখলেই হয়। সবাইকে শাসিয়ে বললেন, আর যেন এমন না হয়।

চুপ করে আছে সবাই।

মিসেস টোডের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নাস্তা হয়েছে? বেলা তো দুপুর হয়ে গেল। রোজই এক অবস্থা!

গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেল মিসেস টোড।

পারকারও ঘরে চলে গেলেন।

রাফির গলায় শেকল বাঁধতে বাঁধতে খেঁকিয়ে উঠল জিনা, কতবার মানা করেছি ওটার সঙ্গে লাগতে যাবি না। তা-ও যাস। আটকে থেকে এখন মজা বোঝ…বাবাকে রাগিয়েছিস, সারাটা দিনই আজ রেগে থাকবে। বুড়িটাকেও খেপিয়েছিস। চায়ের জন্যে কেক-টেক কিছু বানাবে না আর।

বেচারা রাফি। খুব লজ্জা পেয়েছে। মাথা নিচু করে, লেজ গুটিয়ে মৃদু কুঁই কুঁই করল। থুক করে কয়েকটা লোম ফেলল দাঁতের আগা থেকে। কুকুরটার কান ছিঁড়তে পারেনি, তবে কানের ডগার লোম ছিঁড়তে পেরেছে। আপাতত তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

পুরো ঘটনাটার জন্যেই নিজেকে দায়ী মনে করছে কিশোর। বলল, কি করে যে ছুটে গেল…আসলে অনেক জোর ওর, ধরে রাখতে পারলাম না…

ওর গায়ে বাঘের জোর, খুশি হয়ে বলল জিনা। বেঙাচির কুকুরটাকে দুই কামড়ে খেয়ে ফেলতে পারে ও।

নাস্তা দেয়া হলো। কেরিআন্টি নেই টেবিলে। তার বদলে রয়েছেন পারকার আংকেল, যেটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছেলেমেয়েদের জন্যে। এমনিতেই তাঁর সঙ্গে খেতে বসতে চায় না কেউ, আজ তো মেজাজ আরও সপ্তমে চড়ে রয়েছে। কি যে করে বসবেন ঠিক নেই। শুরুতেই কয়েকটা বকা দিলেন। জিনাকে। কড়া নজর বুলিয়ে আনলেন সবার ওপর একবার। কুঁকড়ে গেল রবিন। এখানে বেড়াতে এসেছে বলে এবার আফসোসই হতে লাগল তার।

পরিজের প্লেট এনে ঠকাস করে টেবিলে ফেলল মিসেস টোড।

এটা কি রকম হলো? ধমকে উঠলেন আংকেল, আস্তে রাখতে পারো না!

তাঁকে ভয় পায় মহিলা। তাড়াতাড়ি চলে গেল। এরপর অন্যান্য প্লেট এনে যতটা সম্ভব ভদ্রভাবে শব্দ না করে রাখল।

কয়েক মিনিট নীরবে খাওয়ার পর ছেলেমেয়েদের বিষণ্ণ মুখগুলো দেখে মায়া হলো পারকারের। কণ্ঠস্বর কোমল করে জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাদের কি কি করার প্ল্যান?

ভাবছি কোথাও পিকনিকে চলে যাব, জবাব দিল জিনা।

যাও না, মন্দ কি। বাড়িটা শান্ত থাকবে।

 যাব যে, খাব কি? মিসেস টোড কি স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেবে?

দেবে না কেন, নিশ্চয় দেবে। তাকে রাখাই হয়েছে খাবার তৈরির জন্যে। না দিলে আমার কথা বলবে।

চুপ হয়ে গেল জিনা। মিসেস টোডকে স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেয়ার কথা বলার সাহস বা মানসিকতা কোনটাই নেই তার। মহিলার সামনে যেতেই ইচ্ছে করে না তার।

কুত্তাটাকে কিছু কোরো না, তাহলেই আর রাগবে না তোমাদের ওপর, পারকার বললেন।

ডার্টিটাকে যে কেন আনতে গেল…

ডার্টি! ভুরু কোঁচকালেন পারকার, ছেলেটার নাম বুঝি? এটা একটা নাম হলো।

ছেলে নয়, কুত্তাটার নাম। ওরা ডাকে ডারবি। এক্কেবারে নোংরা তো; গোসল করায় না, গায়ের গন্ধে ভূত পালায়, উকুনে ভরা, তাই আমি রেখেছি ডার্টি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন পারকার। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন। মাঝপথেই হাসি থামিয়ে আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। খবরদার, মিসেস টোডের সামনে ডার্টি বলবে না। আর যেন ঝগড়াঝাটি না শুনি। আমি কাজ করতে চললাম।

নিজে বলতে গেল না জিনা, স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেয়ার কথা মাকে দিয়ে বলাল।

মুখ কালো করে মিসেস টোড বলল, আরও তিনজনের খাবার রান্না করার কথা কিন্তু ছিল না আমার।

ছিল না, তো কি হয়েছে, জিনার আম্মা বললেন। এসেছে ওরা, তাড়িয়ে দেব নাকি? তোমাকে যা করতে বলা হয়েছে করো, বেতন দেয়ার সময় বিবেচনা করব আমি। আমার শরীর ঠিক হয়ে গেলে তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। ওদের যেন কোন অসুবিধে না হয়।

খাবারের প্যাকেট নিয়ে বেরোল গোয়েন্দারা।

বাগানে টেরির সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?

তাতে তোমার কি দরকার! ঝাঁঝাল জবাব দিল জিনা।

 আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে, খাতির করতে চাইছে ছেলেটা। চলো না, ওই দ্বীপটায় যাই?

না! চাবুকের মত শপাং করে উঠল জিনার কণ্ঠ। ওটা আমার দ্বীপ তোমার মত ছেলেকে ওখানে নিয়ে যাব ভাবলে কি করে…

কে তোমার দ্বীপ? হি-হি! গুল মারার আর জায়গা পাও না! উনার দ্বীপ, ছাগল পেয়েছে আমাকে।

ছাগল না, বেঙাচি। এই চলো, এটার সঙ্গে কে কথা বলে…

তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে গেটের দিকে এগোল জিনা।

পেছনে সুর করে গেয়ে উঠল টেরি, জিনা, ঘিনা… ঘুরে দাঁড়াল মুসা।

খপ করে তার হাত চেপে ধরল জিনা, না না, মুসা, যেয়ো না। কিছু করলেই ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে, আর ওর মা এসে হাউকাউ শুরু করবে।

এত্তবড় ছেলে কাঁদে! রবিন অবাক।

এই বেঙাচিটা কাঁদে।

অ্যাই, এভাবে কথা বলবে না… রেগে উঠল ছেলেটা।

তুমিও তাহলে খেপাবে না, মুসা বলল।

কি করবে?

খেপিয়েই দেখো! গেয়ে উঠল টেরি, জিনা, ঘিনা…

তাকে শেষ করারই সুযোগ দিল না মুসা। সুর করে পাল্টা জবাব দিল,

ব্যাঙাচি করে ঘ্যানর-ঘ্যান
চাইরডা পয়সা ভিক্ষা দ্যান!

হেসে ফেলল জিনা।

রবিন আর কিশোরও হাসতে লাগল।

লাল মুখ আরও লাল হয়ে গেল টেরির, চিৎকার করে মাকে ডাকল, মা, দেখো, কেমন করে! জিনার সেই দ্বীপ।

ভুরু নাচাল মুসা, এখন কেমন লাগে? অন্যকে যে খেপাও?

বেশি বেশি করলে তোমাকেও খেপাব।

আমি অত সহজে খেপি না।

এই, চলো চলো, এটার পেছনে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, গেটের দিকে পা বাড়াল কিশোর।

পেছনে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করল টেরি,

মুসা, ঘুসা, রামছাগলের ডিম...

 চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে গেল মুসা। তবে রে, শয়তান ছেলে…

একটা মুহূর্ত দেরি করল না আর টেরি। লাফিয়ে উঠে. একদৌড়ে একেবারে রান্নাঘরে, মায়ের কাছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে ভেঙচাল।

ঘুসি তুলে শাসাল মুসা, ধরতে পারব তো একবার না একবার, হাড্ডি গুড়ো করে দেব তখন!

আবার মুখ ভেঙুচাল টেরি।

 গর্জে উঠল মুসা, কান ছিঁড়ে ফেলব কিন্তু বলে দিলাম!

আহ, কি শুরু করলে! ওর হাত ধরে টান দিল কিশোর, তুমি নাকি সহজে খেপো না?

কিন্তু ওটা একটা শয়তান! বিতিকিচ্ছি জন্তু! ইঁদুর, বিড়াল, বেঙ, ছুঁচো, হনুমান…

.

কোথায় যাবে ঠিক করলে? বাগান থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল রবিন।

রাগ এখনও পড়েনি মুসার। ফোঁস ফোঁস করছে।

কিশোর প্রস্তাব দিল, চলো, দ্বীপে চলে যাই।

আমার নৌকাটা রঙ করতে দিয়েছি, জিনা বলল। হলো নাকি দেখি। হলে যাওয়া যাবে।

নৌকা মেরামতের কারখানায় এসে দেখা গেল রঙ করা হয়েছে। লাল রঙ। দাঁড়গুলোর রঙও লাল।.

যে লোকটা মেরামত করে তার নাম ডক হুফার। জিনাকে দেখে বলল, ও, জর্জ, এসে গেছ। কেমন লাগছে রঙ?

জিনা যে ছেলে সেজে থাকতে পছন্দ করে, হুফার একথা জানে। জর্জ বলে ডাকলে যে খুশি হয় তা-ও জানে।

খুব সুন্দর হয়েছে, আংকেল, মাথা দুলিয়ে জিনা বলল। নিতে পারব?

মাথা নাড়ল হুফার। রঙ তো শুকায়নি। কাল নাগাদ হয়ে যাবে।

আজ বিকেলেও হবে না?

না। পানিতে নামালেই নষ্ট হবে।

কি আর করা। সৈকতে হাঁটতে লাগল ওরা।

মুসা বলল, সকালেই বুঝেছি, আজ দিনটা ভাল যাবে না। শুরুতেই গণ্ডগোল।

হাঁটতে হাঁটতে উঁচু একটা পাড়ের কাছে চলে এল। বড় বড় ঘাস বাতাসে দোল খাচ্ছে। পাড়ের নিচের ঝকঝকে সাদা বালিতে পা ছড়িয়ে বসল সবাই। ও, না, ভুল হয়ে গেছে, সবাই না; রাফি বসল লেজ ছড়িয়ে।

মুসা জিজ্ঞেস করল, তোমাদের খিদে পেয়েছে?

মোটামুটি হ্যাঁ-ই করল সবাই।

খাবারের প্যাকেট খোলা হলো। কিন্তু স্যান্ডউইচে কামড় দিয়েই মুখ বাকাল কিশোর, এহহে, বাসি রুটি দিয়েছে!

ইচ্ছে করে শয়তানিটা করেছে মিসেস টোড, বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও। বাসি রুটি, গন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরে মাখন দেয়নি বললেই চলে। ফেলে দিল কিশোর, খেতে পারল না।

জিনা আর রবিনও খেল না।

জোরজার করে দুটো স্যান্ডউইচ গিলল কোনমতে মুসা।

কেবল রাফির কোন ভাবান্তর নেই। সে এসব পচা-বাসি সবই খেতে পারে। গপগপ করে গিলতে লাগল। নিজের ভাগেরগুলো তো খেলই, অন্যদেরগুলোও খেয়ে চলল।

মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে সকলের।

খানিকক্ষণ ঝিম মেরে থাকার পর মুসা বলল, দূর, এভাবে বসে থাকতে ভাল্লাগছে না! ওঠো।

কোথায় যাব? রবিনের প্রশ্ন।

ওই টিলাটার চূড়ায় গিয়ে বসি। দ্বীপে যখন যেতে পারলামই না, বসে বসে দেখিই এখান থেকে।

হু, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিলোর, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আরকি। চলো।

টিলার মাথায় এসে বসল ওরা। চারপাশে অনেক দূর দেখা যায় এখান থেকে। চমৎকার বাতাস।

জিনার দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবিন জিজ্ঞেস করল, জিনা, সেই ভাঙা জাহাজটা এখনও আছে?

কোন জাহাজের কথা বলছে, বুঝতে পারল জিনা। সেই যে সেবার, প্রথম যখন তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল তিন গোয়েন্দা, তখন এক সাংঘাতিক অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়েছিল ওরা। দ্বীপে গিয়েছিল বেড়াতে। প্রচণ্ড ঝড় হলো। ঝড়ে সাগরের নিচ থেকে উঠে এল পুরানো আমলের একটা ভাঙা কাঠের জাহাজ ম্যাপ পাওয়া গিয়েছিল। সোনার বার পেয়েছিল।

আছে, জানাল জিনা।

চকচক করে উঠল কিশোরের চোখ, আছে! আমি তো ভেবেছি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে তলিয়ে গেছে এদ্দিনে।

না যায়নি। পাথরের মধ্যে তেমনি আটকে আছে। বড় বড় ঢেউও ছাড়িয়ে নিতে পারেনি। দ্বীপে গেলেই দেখতে পাবে।

একেবারেই ভাঙেনি?

একেবারে ভাঙেনি তা নয়। খুলে খুলে পড়ছে তক্তা। দু-চারটে ঝড়ের বেশি আর হজম করতে পারবে বলে মনে হয় না।

দ্বীপের পুরানো ভাঙা দুৰ্গটার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। দাঁড়কাকের বাসা ছিল যে টাওয়ারটাতে সেটা এখনও তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।

জিজ্ঞেস করল, কাকগুলো এখনও আছে, না?

আছে, জানাল জিনা। প্রতি বছরই বাসা বানায়। কমেতেনিই, আরও বেড়েছে।

এই দেখো, দেখো, ধোঁয়া, মুসা বলল। দ্বীপে কেউ উঠেছে।

না, কে উঠতে যাবে। স্টীমারের ধোঁয়া হবে। দ্বীপের ওপাশে আছে, তাই দেখতে পাচ্ছি না আমরা।

 ওরকম স্টীমার এখনও আছে নাকি এ-অঞ্চলে? জিজ্ঞেস করল রবিন। ফকফক করে ধোঁয়া ছাড়ে যেগুলো?

তার চেয়ে প্রাগৈতিহাসিকগুলোও আছে। জেলেরা মাছ ধরতে যায় ওসব নিয়ে।

পুরানো জলযান নিয়ে আলোচনা চলল।

ঘড়ি দেখল কিশোর। এবার ওঠা যাক। চায়ের সময় হয়ে এসেছে। গিয়ে যদি দেখতাম আন্টি ভাল হয়ে গেছে, একটা চিন্তা যেত।

হ্যাঁ, মাথা দুলিয়ে মুসা বলল, আন্টি খাবার টেবিলে না থাকলে সবই বিস্বাদ।

উঠল ওরা।

কিছুদূর এসে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দ্বীপটার দিকে তাকাল কিশোর। ঘুরে ঘুরে উড়ছে কয়েকটা সীগাল। ধোঁয়া মিলিয়ে গেছে। ঠিকই বলেছে বোধহয় জিনা, স্টীমারই। সরে চলে গেছে, ফলে আর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু একটা খুঁতখুঁতানি থেকেই গেল তার সন্দেহপ্রবণ মনে।

ব্যাপারটা লক্ষ করল জিনা। কি হলো? ধোঁয়াতে রহস্য খুঁজে পেলে নাকি?

নাক চুলকাল কিশোর। কি জানি!

ভেবো না, কালই চলে যাব। স্টীমারের ধোঁয়া ছিল, না কেউ দ্বীপে উঠে। আগুন জ্বেলেছে, জানাটা কঠিন হবে না।

বাড়ি ফিরে এল ওরা। বসার ঘরে ঢুকে দেখে মহাআরামে সোফায় বসে জিনার একটা বই পড়ছে আর পা নাচাচ্ছে টেরি।

এই ছেলে, এখানে কি? ধমক দিল জিনা। আমার বই ধরলে কেন?

তাতে ক্ষতিটা কি হলো? বইই তো পড়ছি, নষ্ট তো আর করছি না কিছু।

না বলে তুমি ধরলে কেন? সাহস তো তোমার কম না! আমার ঘরে ঢোকো…

ঘরে ঢোকা কি অন্যায়?

নিশ্চয় অন্যায়। না বলে যে অন্যের ঘরে ঢুকতে নেই এই শিক্ষাটাও দেয়নি তোমাকে কেউ? যা করেছ, করেছ। আব্বার স্টাডিতে যেন ঢুকতে যেয়ো না, পিঠের ছাল ছাড়াবে তাহলে

ওখানেও ঢুকেছি, নির্দ্বিধায় স্বীকার করল ছেলেটা। কি সব বিচ্ছিরি যন্ত্রপাতি। ওসব দিয়ে কি করে?

রাগে ক্ষণিকের জন্যে কথা হারিয়ে ফেলল জিনা। চেঁচিয়ে উঠল, বলো কি! ওখানেও…আমরাই যেখানে সাহস পাই না…আব্বা কিছু বলেনি?

না।

ঘরে ছিল না বোধহয়, তাই বেঁচে গেছ। বলবে না আবার! দাঁড়াও গিয়ে বলছি, তারপর বুঝবে মজা…

 বলোগে, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল টেরি। পাবে কোথায় তাকে? জিনাকে আরও রাগানোর জন্যে সামনে-পেছনে শরীর দোলাতে লাগল। বইটা চোখের সামনে এনে গভীর মনযোগে পড়ার ভান করল।

ওর এই বেপরোয়া ভাবভঙ্গি সন্দেহ জাগাল জিনার মনে। পাব কোথায় মানে?

পাব কোথায় মানে, পাবে না।

হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে উঠল জিনা। আম্মা কোথায়?

ডাকো না। থাকলে তো সাড়াই দেবে, একই রকম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে জবাব দিল ছেলেটা।

ভয় পেয়ে গেল সবাই। টেরি এমন করে কথা বলছে কেন?

আম্মা, আম্মা! বলে ডাকতে ডাকতে ওপরতলায় দৌড় দিল জিনা। কিন্তু মায়ের বিছানা খালি। সব কটা বেডরুমে ছুটে বেড়াতে লাগল সে। কোথাও পাওয়া গেল না মাকে। সাড়াও দিলেন না মিসেস পারকার।

সিঁড়ি বেয়ে লাফাতে লাফাতে নিচে নামল জিনা। রক্ত সরে গেছে মুখ। থেকে।

দাঁত বের করে হাসল টেরি। চোখ নাচিয়ে বলল, কি, বলেছিলাম না? যত খুশি চিল্লাও এখন, কেউ আসবে না।

টেরির কাছে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল জিনা। কোথায় ওরা? জবাব দাও, কোথায়!

নিজেই খুঁজে বের করো।

ঠাস করে চড় মারল জিনা। যতটা জোরে পারল।

 লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল টেরি। গাল চেপে ধরেছে। বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল জিনার দিকে। তারপর সে-ও চড় তুলল।

চোখের পলকে সামনে চলে এল মুসা, আড়াল করে দাঁড়াল জিনাকে। মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা করে না? মারতেই যদি হয়, আমাকে মারো, দেখি কেমন জোর?

টেনে তাকে সরানোর চেষ্টা করল জিনা। চিৎকার করে বলল, সরো তুমি, মুসা, সরো! অনেক সহ্য করেছি! পেয়েছে কি! আজ আমি ওর বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব!

কিন্তু সরল না মুসা।

তার গায়ে হাত তোলার সাহস করল না টেরি। পিছিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে।

পথ আটকাল কিশোর। দাঁড়াও। আন্টি কোথায়, বলো।

এই সময় টেরির বিপদ বাড়াতেই যেন ঘরে ঢুকল রাফি। এতক্ষণ বাগানে ছিল। ঢুকেই আঁচ করে ফেলল কিছু একটা ঘটেছে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গরগর করতে করতে এগোল।

আরে, ধরো না কুত্তাটাকে! কাঁপতে শুরু করল টেরি। কামড়ে দেবে তো!

রাফির মাথায় হাত রাখল কিশোর। চুপ থাক্।-হ্যাঁ, টেরি, এবার বলল, আন্টি কোথায়?

রাফির ওপর থেকে চোখ সরাল না টেরি। জানাল, হঠাৎ করে পেটব্যথা শুরু হলো। ডাক্তারকে খবর দিল জিনার আব্বা। ডাক্তার এসে দেখে বলল, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তখনই তাড়াহুড়া করে নিয়ে গেল।

ধপ করে সোফায় বসে পড়ল জিনা। দু-হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল, আম্মা..ও আম্মা, তোমার কি হলো- কেন আজ বেরোলাম ঘর থেকে…আম্মাগো…

তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল সবাই, এই সুযোগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল টেরি। রাফি একবার খেক করে উঠল, কিন্তু ততক্ষণে রান্নাঘরের দরজার কাছে চলে গেছে সে। দরজা পেরিয়েই দড়াম করে লাগিয়ে দিল পাল্লা।

ফিরেও তাকাল না গোয়েন্দারা।

জরুরী কণ্ঠে কিশোর বলল, নিশ্চয় নোট রেখে গেছেন আংকেল।

খুঁজতে শুরু করল তিনজনে।

.

চিঠিটা খুঁজে পেল রবিন। জিনার আম্মার বড় ড্রেসিং টেবিলে চিরুনি চাপা দেয়া। ওপরে জিনার নাম লেখা।

তাড়াতাড়ি খুলে জোরে জোরে পড়ল রবিন:

জিনা,

তোমার মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ভাল না হওয়া পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে থাকব। সেটা দু-দিনও হতে পারে, দুই হপ্তাও হতে পারে। রোজ সকাল নটায় ফোন করে তার খবরাখবর জানাব তোমাদের। চিন্তা কোরো না। মিসেস টোড তোমাদের খেয়াল রাখবেন। বাড়িঘর দেখেশুনে রাখবে। –তোমার বাবা।

বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে হু-হু করে কাঁদতে লাগল জিনা। বলতে লাগল, আম্মা, আম্মাগো, তুমি আর আসবে না। আমি জানি! তোমাকে ছাড়া কি করে থাকব আমি!

তাকে সান্ত্বনা দিয়ে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল তিন গোয়েন্দা। সহজে কাঁদে না জিনা। তাকে এভাবে বিলাপ করতে দেখে অস্থির হয়ে পড়ল ওরাও।

রাফিও জিনাকে কাঁদতে দেখেনি। প্রথমে অবাক হলো, তারপর অস্থির হয়ে উঠল তিন গোয়েন্দার মতই। জিনার হাঁটুতে মুখ রেখে কুঁই কুঁই করতে লাগল।

অনেকক্ষণ কেঁদেকেটে অবশেষে কিছুটা শান্ত হলো জিনা। মুখ তুলে বলল, আমি আম্মাকে দেখতে যাব।

কোথায় যাবে? কিশোর বলল, কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জানি না। আর আমরা গেলেও ঢুকতে দেবে না। সারাদিন কিছু খাওনি। চায়ের সময় হয়ে গেছে। চলো, কিছু খেয়ে নিলে ভাল লাগবে।

আমি কিচ্ছু খাব না! প্রায় ফুঁসে উঠল জিনা। তোমাদের ইচ্ছে হলে যাও! আবার মুখ গুঁজল বিছানায়।

চুপ করে রইল কিশোর। জিনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে।

কয়েক মিনিট পর আবার মুখ তুলল জিনা। চোখ মুছল। মলিন হাসি ফুটল ঠোঁটে। বলল, সরি! কিছু মনে কোরো না! যাও, চায়ের কথা বলে এসো।

কিন্তু কে যাবে মিসেস টোডকে চায়ের কথা বলতে? বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে যাওয়ার অবস্থা হলো যেন দূরদের। মুসা রাজি হলো না। রবিনও আমতা আমতা করতে লাগল। শেষে কিশোরই উঠল যাওয়ার জন্যে।

রান্নাঘরের দরজা খুলে উঁকি দিল সে। টেরি বসে আছে গুম হয়ে। গালের একপাশ লাল, যেখানে চড় মেরেছিল জিনা।

মুখ ভয়ানক গভীর করে মিসেস টোড বলল, আরেকবার খালি আমার ছেলেকে মেরে দেখুক, ওর অবস্থা কাহিল করে দেব আমি!

চড় খাওয়ার কাজ করেছে, খেয়েছে, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। ওসব আলোচনা করতে আসিনি আমি।

তাহলে কি জন্যে এসেছ?

চা দিতে হবে।

পারব না।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে গরগর করে উঠল ঘরের কোণে বসে থাকা ডারবি, কিন্তু কাছে আসার সাহস করল না।

কুকুরটাকে পাত্তাই দিল না কিশোর। আপনি না দিলে আমিই নেব। রুটি কোথায় রেখেছেন? কেক?

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল মিসেস টোড। কিশোরও তাকিয়ে রইল একই ভঙ্গিতে। এরকম বাজে মহিলার সঙ্গে ভদ্রতা করার কোন প্রয়োজন মনে করল না সে।

দৃষ্টির লড়াইয়ে হার মানল মিসেস টোড। বলল, বেশ, এবারকার মত দিচ্ছি। কিন্তু এরপর শয়তানি করলে খাওয়া বন্ধ করে দেব।

অত সহজ না। সোজা পুলিশের কাছে যাব, কথাটা কিছু ভেবে বলেনি কিশোর, আপনাআপনি মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে।

চমকে গেল মিসেস টোড। তাড়াতাড়ি বলল, থাকগে, যা হওয়ার হয়েছে, কিছু মনে কোরো না। এই ডাক্তার, হাসপাতালে অস্থির করে দিয়েছে সবাইকে…যাও, আমি চা নিয়ে আসছি।

মহিলার এই হঠাৎ পরিবর্তন অবাক করল কিশোরকে। পুলিশের কথায় এমন চমকে গেল কেন? ভাবতে ভাবতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। একটা কারণ হতে পারে, পুলিশ এলে পারকার আংকেলকে খবর দেবে। ভয়ানক রেগে যাবেন তিনি। মিসেস টোডকেও ছাড়বেন না। তাঁকে ভয় পায় মহিলা।

সবাইকে এসে খবর দিল কিশোর, চা আসছে।

চা খাওয়া জমল না। কান্না থামালেও মন খারাপ করে রেখেছে জিনা। রবিন আর মুসা তাকে নানা ভাবে খুশি করার চেষ্টা করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। চায়ের সঙ্গে কি দিয়ে গেল মিসেস টোড, খেয়ালই করল না কেউ।

যদি কোন কারণে মিস্টার পারকার ফোন করেন, এ-জন্যে খাওয়ার পর দূরে কোথাও গেল না ওরা, বাগানে বসে রইল।

রান্নাঘর থেকে হঠাৎ শোনা গেল:

জিনা, ঘিনাঃ..

উঠে দাঁড়াল কিশোর। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। একা বসে আছে টেরি।

এই, বেরিয়ে এসো! কঠিন কণ্ঠে ডাকল,কিশোর।

নড়ল না টেরি। গানও গাইতে পারব না?

নিশ্চয় পারবে। সেজন্যেই তো ডাকছি। এটা পুরানো হয়ে গেছে, এসো, নতুন আরেকটা শিখিয়ে দিই।  

বেরোলেই আমাকে মারবে।

না না, মারব কেন, আদর করব! একটা মেয়ের মায়ের অসুখ, তার এমনিতেই মন খারাপ, তাকে খেপাতে লজ্জা করে না! বেরোবে, না কান ধরে বের করে আনব?

কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল মুসা।

ভয় পেয়ে গেল টেরি। চিৎকার করে ডাকল, মা, ও মা! কোথায় তুমি!

জানালা দিয়ে আচমকা হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা। টেরির কান চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল।

ছাড়ো, ছাড়ো!…ওহ, কান ছিঁড়ে ফেলল-মা!

ঘরে ঢুকল তার মা। এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এল জানালার দিকে।

কান ছেড়ে হাতটা বের করে আনল মুসা। পালাতে গিয়েও পালাল না। কিশোরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে রইল।

চেঁচাতে লাগল মিসেস টোড, কত্তবড় সাহস! আমার ছেলেকে চড় মারে…কান টানে! কি, ভেবেছ কি তোমরা!

 কিছুই না, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। তবে আপনার ছেলের খানিকটা শিক্ষা দরকার। আপনারই সেটা দেয়া উচিত ছিল। পারেননি যখন আমাদেরই দিতে হচ্ছে।

তুমি..তুমি একটা শয়তান!

 গাল দেবেন না। যদি কাউকে দিতেই হয়, আপনার ছেলেকে দিন। ও ওই ডার্টি কুত্তাটার চেয়েও খারাপ।

আরও রেগে গেল মিসেস টোড, ওর নাম ডার্টি নয়, ডারবি।

ডার্টি। অত নোংরী কুত্তার এটাই ঠিক নাম। গা-টা ধোঁয়ান, উকুন পরিষ্কার করান, গন্ধ যাক, তারপর ভাবব ডারবি বলা যায় কিনা।

প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে লাগল মিসেস টোড।

কেয়ারই করল না কিশোর। মুসাকে নিয়ে ফিরে এল জিনা আর রবিন যেখানে বসে আছে।

যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেছে, ঘাসের ওপর বসতে বসতে বলল কিশোর।

 কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন।

মুসা টেরির কান টেনেছে। সেটা দেখে ফেলেছে ওর মা। এরপর আর আমাদের খেতে দেবে কিনা সন্দেহ আছে।

না দিলে নিজেরাই নিয়ে খাব, জিনা বলল। শয়তান মহিলাটাকে যে কেন জায়গা দিতে গেল মা…

ওই দেখো, ডার্টি, বলে উঠল মুসা।

রাফি, যাসনে, যাসনে! কলার ধরে আটকানোর জন্যে থাবা মারল কিশোর। ধরতে পারল না।

কেউ নেই ভেবে বেরিয়ে পড়েছিল ডারবি। রাফিকে দেখেই এমন এক চিৎকার দিল, মনে হলো মেরে ফেলা হচ্ছে ওকে।

তার ঘাড় কামড়ে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল রাফি।

লাঠি নিয়ে বেরোল মিসেস টোড। এলোপাতাড়ি বাড়ি মারতে শুরু করল। কোন কুকুরটার গায়ে লাগছে, দেখল না। রাগে অন্ধ হয়ে গেছে।

পানির পাইপের দিকে দৌড় দিল রবিন।

দরজায় দেখা দিল টেরি। রবিনকে পাইপের দিকে যেতে দেখেই ঘরে ঢুকে গেল আবার। গা ভেজাতে চায় না।

গায়ে পানির ঝাপটা লাগতে লাফিয়ে সরে দাঁড়াল রাফি। চোখের পলকে লাফিয়ে উঠে গিয়ে মিসেস টোডের স্কার্টের নিচে লুকাল ডারবি।

বিষ খাওয়াব আমি কুত্তাটাকে! মুখচোখ ভয়ঙ্কর করে গজরাতে লাগল। মিসেস টোড। এত্তবড় শয়তান! বিষ খাইয়ে না মেরেছি তো…

গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেল সে।

আগের জায়গায় এসে বসল গোয়েন্দারা।

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিনা বলল, সত্যিই কি বিষ খাওয়াবে?

 বলা যায় না, কিশোর বলল, ওই মহিলাকে বিশ্বাস নেই। চোখে চোখে রাখতে হবে রাফিকে। আমাদের নিজেদের খাবার থেকে ভাগ দিতে হবে।

কুকুরটাকে কাছে টেনে নিল জিনা। গলা জড়িয়ে ধরল। ইস, আম্মা আব্বা যে কবে আসবে! এই যন্ত্রণা থেকে তাহলে মুক্তি পাই!

হঠাৎ টেলিফোনের শব্দ চমকে দিল সবাইকে। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল ওরা। প্রায় উড়ে এসে ঘরে ঢুকল জিনা। থাবা দিয়ে তুলে নিল রিসিভার।

জিনা? বাবার গলা শুনে দুরুদুরু করে উঠল জিনার বুক।

আব্বা, আম্মা কেমন আছে? জলদি বলো!

পরশুর আগে বলা যাবে না। নানা রকম টেস্ট করছে ডাক্তাররা।

তুমি কবে আসছ?

বলতে পারছি না। তোমার মাকে ফেলে আসি কি করে? চিন্তা কোরো না। কাল সকালে আবার ফোন করব।

আব্বা, ককিয়ে উঠল জিনা, তোমরা নেই, খুব অশান্তিতে আছি। মিসেস টোড একটুও ভাল না।

শোনো, জিনা, অধৈর্য হয়ে বললেন মিস্টার পারকার, নিজে ভাল তো জগৎ ভাল। তোমরা তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার কোরো, সে-ও তোমাদের সঙ্গে করবে। এসব ফালতু কথা নিয়ে বিরক্ত করবে না আমাকে। এমনিতেই অনেক ঝামেলায় আছি।

আমি আসব। আম্মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।

না, আসবে না, বাড়িতে থাকো। বাড়ি থেকে যাবে না কোথাও। আরও হপ্তা দুয়েকের আগে তোমার আম্মাকে ছাড়বে বলে মনে হয় না। দেখি, ঝামেলা কেটে গেলে আমি একবার এসে দেখে যাব তোমাদের। গুড-বাই।

লাইন কেটে দিলেন তিনি।

রিসিভার রেখে বন্ধুদের দিকে ফিরল জিনা। হতাশ কণ্ঠে বলল, পরশুর আগে ওরা বলতেই পারবে না আম্মার কি অবস্থা। আব্বার আসারও কোন ঠিক নেই। ততদিন আমাদের কাটাতে হবে মিসেস টোডের সঙ্গে। ওই বুড়িটার সঙ্গে থাকার কথা ভাবতেই এখন কেমন লাগছে আমার।

.

এতটাই রেগেছে মিসেস টোড, সেদিন সন্ধ্যায় ওদেরকে খাবারই দিল না। রাতের খাওয়া বন্ধ। বলতে গিয়ে কিশোর দেখে, রান্নাঘরে তালা লাগানো।

ফিরে এসে সবাইকে জানাল খবরটা। তালা লাগিয়ে দিয়েছে, যাতে আমরা কিছু বের করে আনতে না পারি। এত্তবড় শয়তান মহিলা জীবনে দেখিনি আমি। কিন্তু

ঘুমাক, তারপর ভাঁড়ারে গিয়ে খুঁজে দেখব কিছু আছে কিনা, জিনা বলল।

খিদেয় পেট জ্বলছে। কান পেতে শুনছে কিশোর, মিসেস টোড আর টেরি ঘুমাতে গেল কিনা। ওপরতলায় উঠে গেল ওরা, দরজা লাগানোর শব্দ হলো, তারও কিছুক্ষণ পর পা টিপে টিপে নামল সে, রান্নাঘরের দিকে এগোল।

ঘর অন্ধকার, আলো জ্বালতে যাবে, হঠাৎ কানে এল ভারী নাক ডাকানোর শব্দ। কে? ডাটি? না, কুকুর তো ওরকম করে নিঃশ্বাস ফেলে না! মানুষের মত লাগছে।

সুইচে হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। চোর-টোর ঢুকল না তো?

নাহ, দেখতেই হচ্ছে। আলো জ্বেলে দিল সে।

ছোটখাট একজন মানুষ শুয়ে আছে সোফায়। গভীর ঘুম। হাঁ করে শ্বাস টানছে।

দেখতে মোটেও ভাল না লোকটা। কতদিন শেভ করেনি কে জানে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গোসল করে না, এমনকি হাতমুখও বোধহয় ঘোয় না, হাতে ময়লা, নখের ভেতর ময়লা ঢুকে কালো হয়ে আছে। মানুষ এত নোংরা হতে পারে ভাবা যায় না। চুল আর নাক টেরির মত।

ও, তাহলে এই ব্যাপার, ভাবল কিশোর। ইনি তাহলে টেরি মিয়ারই বাপ। বাপ-মা যার এরকম, সে আর ভাল হবে কি।

নাক ডাকিয়েই চলেছে লোকটা। কি করবে ভাবতে লাগল কিশোর। ভাঁড়ারে ঢুকতে গেলে যদি শব্দ শুনে জেগে যায় নোকটা? চেঁচামেচি শুরু করে দেবে না তো? অন্যায় ভাবে ঢুকেছে বলে যে বেরিয়ে যেতে বলবে তারও উপায় নেই। তার স্ত্রী চাকরি করে এখানে। তাকে দেখতে আসতেই পারে স্বামী। আংকেল-আন্টিও এতে দোষের কিছু দেখবেন না। বিপদেই পড়া গেল!

খুব খিদে পেয়েছে তার। এবার জিনাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই খাওয়া মোটেও সুবিধের হচ্ছে না। ফলে পেটের চাহিদা রয়েই যাচ্ছে। ভঁড়ারে লোভনীয় খাবার আছে ভাবতেই জিভে পানি এসে গেল তার। আলো নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে এগোল আবার।

দরজা খুলল। অন্ধকারেই হাত বাড়িয়ে তাক হাতড়াতে শুরু করল। হাতে ঠেকল একটা পাত্র, খাবার আছে। গন্ধ শুকে বুঝল, মাংস।

আরেকটা পাত্র রয়েছে ওটার পাশে। বেশ বড়। এটা আর শুঁকতে হলো না, আঙুল ছুঁইয়েই বুঝল, ভেজিটেবল। বাহ, চমৎকার! মাংস, ভেজিটেবল, আর কি চাই? রুটি হলেই হয়ে যায় এখন। সেটা পেতে দেরি হলো না। ট্রেতে অনেক আছে।

পাত্রগুলো ট্রেতে গুছিয়ে নিয়ে ভাঁড়ার থেকে বেরিয়ে এল সে। পা দিয়ে ঠেলে আস্তে লাগিয়ে দিল পাল্লা।

অন্ধকারে এগোতে গিয়ে পথ ভুল করে ফেলল। সোজা এসে হোঁচট খেল সোফায়। ঝাঁকি লেগে ছলকে পড়ল তরকারির ঝোল, কয়েক টুকরো তরকারিও পড়ল। আর পড়বি তো পড় একেবারে মিস্টার টোডের হাঁ করা মুখে।

চমকে জেগে গেল লোকটা।

তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেল কিশোর। কোন শব্দ না শুনলে আবার ঘুমিয়ে পড়বে লোকটা। হয়তো পড়তও, কিন্তু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া তরকারির ঝোল বিরক্ত করছে তাকে। ঝটকা দিয়ে উঠে বসল। কে? কে ওখানে? টেরি? কি করছিস?

জবাব দিল না কিশোর। আন্দাজে দরজার দিকে সরে যেতে লাগল।

সন্দেহ হলো নোকটার। লাফ দিয়ে সোফা থেকে নেমে গিয়ে দেয়ালে সুইচবোর্ড হাতড়াতে লাগল। পেয়েও গেল।

অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তাকাও এদিকে! কি করছ?

আমিও তো সে-কথাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। আপনি এখানে কি করছেন?

 তুমি কে? হাত দিয়ে মুখে লেগে থাকা তরকারির ঝোল মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলল, তাকাও এদিকে!

বললে তো আর চিনবেন না। এটা আমার আংকেলের বাড়ি।

আমার স্ত্রী এখানে চাকরি করে, খসখসে গলায় বলল লোকটা। আমার জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে। ছুটি পেয়েছি। দেখতে এসেছি তাকে। তোমার আংকেলের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে আমার স্ত্রী, আমাকে আসার অনুমতি দিয়েছেন।

এই ভয়ই করছিল কিশোর। মহিলা টোড, আর একটা পুঁচকে টোডের জ্বালায়ই অস্থির হয়ে উঠেছিল, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এখন জলজ্যান্ত এক পুরুষ টোড! বাড়িতে আর টিকতে দেবে না ওদেরেকে।

অনুমতি দিয়েছেন, না? বেশ, কাল সকালে তো আংকেল ফোন করবেন, তখন তাকে জিজ্ঞেস করব। এখন সরুন সামনে থেকে। দোতলায় যাব।

দরজা জুড়ে দাঁড়িয়েছে টোড। কিশোরের হাতের ট্রে-র দিকে চোখ সরু করে তাকাল। আংকেলের বাড়ি, না! ভাড়ার থেকে খাবার চুরি করছ কেন তাহলে? চোর কোথাকার…

বাজে কথা বলবেন না, সরুন! ধমকে উঠল কিশোর। কাল সকালেই একটা ব্যবস্থা করব আপনার। চুরি করে অন্যের বাড়িতে রাতদুপুরে শুয়ে থাকা বের করব।

ধমকে কাজ হলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল টোড। সরার কোন লক্ষণ। নেই। কিশোরের সমানই লম্বা। মুখে শয়তানি হাসি।

ওর খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা নোংরা চেহারাটা সহ্য করতে পারছে না কিশোর। ঠোঁট গোল করে জোরে শিস দিয়ে ডাকল রাফিকে।

লাফ দিয়ে জিনার বিছানা থেকে নামল রাফি। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে এল। দরজার কাছে এসেই গন্ধ পেল টোডের। একটুও পছন্দ হলো না। গেল খেপে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গরগর করতে করতে দরজায় এসে দাঁড়াল।

তাকাও এদিকে!একটানে পাল্লা লাগিয়ে দিল টোড। বাইরে রয়ে গেল রাফি। কিশোরের দিকে তাকিয়ে নোংরা হলদেটে দাঁত বের করে হেসে বলল, এখন?

এই তরকারিগুলো তোমার মাথায় ঢালব! ভেজিটেবলের পাত্রটা তুলে এগিয়ে এল কিশোর। মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেছে।

ঝট করে মাথার ওপর দু-হাত তুলে নিচু হয়ে গেল টোড। না না, এমনি…দুষ্টুমি করছিলাম তোমার সঙ্গে!…তাকাও এদিকেখাবারগুলো নষ্ট কোরো না। ওপরতলায় যাবে তো, যাও

সোফার কাছে সরে গেল আবার সে।

দরজা খুলল কিশোর।

গরগর করছে রাফি। শয়তান লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুমতি চাইছে।

তার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল টোড। ওটাকে আটকাও! কুত্তা দেখতে পারি না আমি!

ডারবিটাকে সহ্য করো কিভাবে তাহলে? বৌকে ভয় পাও বুঝি? রাফি, ছেড়ে দে। তোর গরগরানি শোনার যোগ্যও না ও।

ওপরে উঠে এল কিশোর। নিচতলায় কথা কাঁটাকাটির শব্দ শুনেছে, কি, হয়েছে শোনার জন্যে তাকে ঘিরে এল সবাই।

জানাল কিশোর। টোডের মুখে তরকারি পড়ার কথা শুনে হেসেই অস্থির সব। রাফি পর্যন্ত কিছু না বুঝে খেক খেক করে হাসল।

হাসতে হাসতে বলল রবিন, সবটা তরকারি মাথায় না ফেলে ভালই করেছ। তাহলে আমাদের খাওয়াটা যেত। মিসেস টোড শুনলে কি করবে ভাবছি।

কি আর করবে, খাওয়া শুরু করে দিয়েছে মুসা। বড়জোর নিজের মাথার চুল ছিড়বে যা-ই বলো, রাধে কিন্তু ভাল। মাংসটা চমৎকার হয়েছে।

চেটেপুটে সব সাফ করে ফেলল ওরা।

এরপর টোড পরিবারকে নিয়ে আলোচনায় বসল।

বেঙনি আর বেঙাচির জ্বালায়ই মরছি, আবার এসেছে একটা বেঙ, মুসা বলল তিক্তকণ্ঠে। এবার বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে আমাদের। জিনা, কাল তোমার আব্বাকে বুঝিয়ে বলো সব।

বলব। তবে শুনবে বলে মনে হয় না। কিছু শুনতেও চায় না, বুঝতেও চায় না, আব্বাকে নিয়ে এই হলো সমস্যা, হাই তুলতে শুরু করল জিনা। ঘুম পাচ্ছে আমার। রাফি, চল।

ছেলেদেরকে তাদের ঘরে রেখে নিজের ঘরে শুতে চলে গেল সে।

পেটে খিদে ছিল বলে এতক্ষণ ছটফট করেছে। কিন্তু এখন শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল চারজনেই।

সকালে ওদেরকে অবাক করে দিয়ে নাস্তা তৈরি করে দিল মিসেস টোড।

কিশোর অনুমান করল, আংকেল ফোন করবেন তো, আমরা যদি কিছু বলে দিই, এ-জুন্যে বানিয়ে দিয়ে গেল। মহা ধড়িবাজ মহিলা।

খাওয়ার পর ঘড়ি দেখল মুসা। মাত্র আটটা বেজেছে। বলল, ফোন তো করবেন নটায়। এখনও একঘণ্টা বাকি। চলো, সৈকত থেকে হেঁটে আসি।

বেরিয়ে পড়ল ওরা। বাগানে বসে আছে টেরি। জিনাকে দেখে মুখ ভেঙচাল। রাফি ঘাউ করে উঠতেই কুঁকড়ে গেল।

বাগানের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। রবিন বলল, আমার মনে হয় মাথায় দোষ আছে ছেলেটার নইলে এরকম করে না।

বাদ দাও ওর কথা, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল কিশোর।

নটা বাজতে দশ মিনিট বাকি থাকতে বাড়ি ফিরল ওরা। বাগানে ঢুকতেই কানে এল টেলিফোনের শব্দ।

দৌড় দিল জিনা। তার আগেই মিসেস টোড ধরে ফেলুক, এটা চায় না।

কিন্তু কাছেই ছিল মহিলা, যেন ফোন ধরতেই তৈরি হয়ে ছিল, ধরে ফেলল।

হলে ঢুকতেই গোয়েন্দাদের কানে এল, মিসেস টোড বলছে, হ্যাঁ, স্যার, সব ঠিক আছে, স্যার।…না, কোন অসুবিধে নেই, স্যার। আমার স্বামীও চলে এসেছে, ছুটি পেয়েছে জাহাজ থেকে। আমাকে সাহায্য করতে পারবে। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না, স্যার। সব সামলে রাখব। আপনার যখন ইচ্ছে আসুন…না না, বাচ্চাদের নিয়ে একটুও ভাববেন না…

 আর সহ্য করতে পারল না জিনা। বন্য হয়ে উঠেছে সে। এক থাবায় কেড়ে নিয়ে রিসিভার কানে ঠেকাল, আব্বা, আম্মা কেমন আছে?

আর খারাপ হয়নি। কিন্তু কালকের আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তোমাদের জন্যে খুব চিন্তায় ছিলাম। মিস্টার টোড এসেছে শুনে বাঁচলাম। আর কোন অসুবিধে হবে না তোমাদের। বাড়িঘরের জন্যেও চিন্তা নেই। তোমার আম্মাকে বলব সব ঠিক আছে।

না, নেই! ভয়ানক অবস্থা এখানে। আব্বা, শোনো, টোডদের বিদেয় করে দিই, আমরাই সব সামলাতে পারব…

বলো কি! আঁতকে উঠলেন যেন মিস্টার পারকার। অসম্ভব। তোমরা পারবে নাঃ..যা বলি শোনো…

আব্বা, কিশোর কথা বলবে।

অসহায় ভঙ্গিতে কিশোরের হাতে রিসিভার গুঁজে দিল জিনা। যদি সে কিছু করতে পারে, বোঝাতে পারে তার আব্বাকে।

হ্যালো, আংকেল, আন্টি কেমন?

 আগের মতই। তবে আর খারাপ হয়নি।

ভাল। শুনে খুশি হলাম। আংকেল, শুনুন, মিসেস টোডরা বড্ড জ্বালাচ্ছে…

আরে, তুমিও তো জিনার মতই কথা বলছ দেখছি! রেগে গেলেন মিস্টার পারকার। মহিলার বয়েস হয়েছে, সেটা দেখবে না? জোয়ান মানুষের মত কি আর সব ঠিকমত পারে? কোথায় জিনাকে বোঝাবে, তা না, তোমরাও অভিযোগ শুরু করলে। দেখো, যদি থাকতে পারো থাকো, বেশি কষ্ট হলে বাড়ি চলে যাও। তোমার আন্টি ভাল হলে আবার এসো। আমার আর কিছু বলার নেই।

অন্য কেউ এভাবে কথা বললে স্তব্ধ হয়ে যেত কিশোর। কিন্তু পারকার আংকেলকে চেনা আছে। তাই রাগল না। বোঝানোর চেষ্টা করল, আংকেল, আপনি বুঝতে পারছেন না, ওরা লোক ভাল না…

যত খারাপই হোক, বারো-চোদ্দ দিনে আর কিছু এসে যাবে নাঃ.. রাখলাম…

কিশোরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিলেন তিনি।

 আস্তে করে রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। কাছেই যে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস টোড, ভুলে গিয়ে, জিনার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, না, হলো না…

মিস্টার পারকার কি বলেছেন আন্দাজ করে ফেলেছে কুটিলা মহিলা। হাসিমুখে বলে উঠল, আমরা ভাল না, না? খারাপের কিছু তো দেখোনি এতদিন, এইবার দেখবে। মিস্টার পারকার থাকার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন, আমরা থাকব, দেখি তোমরা কি করো?

Categories: