৩. টেনে নৌকাটাকে তুলে আনল সৈকতের অনেক ওপরে!

0 Comments

জিনার সেই দ্বীপ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ: জুলাই, ১৯৯৪

শান্ত সাগর। এই আবহাওয়ায় রাত থাকতেই মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে জেলেরা। সুতরাং পরিচিত কোন জেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয় নেই। হলোও না। গোবেল দ্বীপের যে প্রাকৃতিক বন্দরটা আছে, প্রণালী দিয়ে ঢুকতে হয়, নিরাপদেই তাতে নৌকা নিয়ে এল ওরা।

টেনে নৌকাটাকে তুলে আনল সৈকতের অনেক ওপরে। ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে। এখানকার সাগরে যখন-তখন ঝড় ওঠে, কোন ঠিকঠিকানা নেই। আর সে ঝড়ও যে-সে ঝড় নয়, ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়ে যায় সাগরের।

দাড় টেনে টেনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মুসা ও জিনা। মসৃণ সাদা বালিতে হাত-পা ছড়িয়ে প্রায় শুয়েই পড়ল।

শুয়ে পড়লে যে, রবিন বলল।

কি করব? পাথরের টিলায় বসা একটা সীগালের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা।

খাওয়া লাগবে না? তোমার তো পেট ভরা, কিন্তু আমরা এখনও নাস্তাই করিনি।

আমিও খাইনি। ভাবলাম, একবারেই খাব।

 টিন ওপেনার বের করে খাবারের টিন কাটতে বসল কিশোর।

ঘেউ ঘেউ করে একটা খরগোশকে তাড়া করে গেল রাফি। ধমক দিয়ে তাকে ডেকে ফিরিয়ে আনল জিনা। চুরি,

আহ, হাত-পা টানটান করতে করতে বলল কিশোর, মনে হচ্ছে জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলাম।

আমারও সে-রকমই লাগছে, রবিন বলল। আসলে, খারাপ মানুষের সঙ্গে বাস করা যায় না।

তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে হবে।

কেন, তাড়াতাড়ি কেন? ভুরু নাচাল মুসা, কি কাজ আছে আমাদের? সময় তো অফুরন্ত।

অনেক কাজ। প্রথমেই রাতে থাকার একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তো আর বাইরে থাকা যাবে না। সেখানে সরিয়ে রাখতে হবে মালপত্রগুলো। তারপর আমরা ঝাড়া হাত-পা। চুটিয়ে আনন্দ করব তখন।

রুটি, মাখন, ঠাণ্ডা মাংস, টমেটো আর কেক দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। তারপর রওনা হলো দুর্গে।

প্রথমবার এসে যেখানে রাত কাটিয়েছিল, সে জায়গাটা এবার আর পছন্দ করতে পারল না কিশোর। দেয়াল আরও অনেকখানি ধসে পড়েছে, ছাত প্রায়। নেই বললেই চলে। এখানে থাকা যাবে না।

জিনা প্রস্তাব দিল, পাতালঘরে থাকলে কেমন হয়?

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানাল মুসা, ওই অন্ধকারে! আমি বাপু এর মধ্যে নেই। ভূতের আড্ডায় কে যায়…

মুসার কথা কানে তুলল না কিশোর, আর কোন জায়গা না পেলে থাকতেই হবে ওখানে। তবে খুব গরম লাগবে।

কথা বলতে বলতে দুৰ্গটার একধারে পাথরের চত্বরে এসে দাঁড়াল ওরা। এখান থেকে সাগর দেখা যায়।

হাত তুলে জিনা দেখাল, ওই দেখো, আমাদের জাহাজটা।

দেখল তিন গোয়েন্দা। ঝড়ে ভেসে উঠেছিল যেটা। একটা নকশা পেয়েছিল ওরা, খুঁজে বের করেছিল সোনার বার।

পাথরের খাঁজে আটকে রয়েছে জাহাজটা, বড় বড় ঢেউও সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।

এক কাজ করলে কেমন হয়! ওটার দিকে তাকিয়ে চোখ চকচক করে উঠল কিশোরের। ওটাতেই গিয়ে থাকি না কেন? চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা হবে..

খাইছে, বলে কি! আঁতকে উঠল মুসা। পোড়ো জাহাজে বাসা! ও তো মেছো ভূতের আড্ডা! জলদস্যুরা মরে গিয়ে সব ভূত হয়ে ওতে বাসা বেঁধেছে।

দেখো মুসা, তোমার এই ভূতের কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। আর ভাল্লাগে না। দয়া করে ভূতটুতগুলোকে মাথা থেকে একটু বের করো।…এই, চলো সবাই। দেখে আসি জাহাজটা।

কিছুদূর এগিয়েই থমকে দাঁড়াল জিনা।

 কি হলো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ওই যে কুয়াটা!

সেদিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। জানে ওরা, এই কুয়া নেমে গেছে অনেক নিচে, সাগর সমতলেরও নিচে, মিষ্টি পানি আছে ওটাতে। লোহার আঙটা বেয়ে নিচে নামা যায়। বেশ কিছুটা নামার পর একটা ফোকর আছে, ওটা দিয়ে ঢোকা যায় পাতালঘরে।

চমকালে কি দেখে? বুঝতে পারছে না মুসা।

দেখছ না, কুয়ার মুখের কাঠের ঢাকনাটা সরানো?

তাতে কি?

কে সরাল? আমি তো সরাইনি। নিশ্চয় কারও পানি খাওয়ার দরকার হয়েছিল!

কত লোক আছে এ কাজ করার ব্যাপারটাকে গুরুত্বই দিল না মুসা। আমরা সোনার বারগুলো খুঁজে পাওয়ার পর তো সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল দ্বীপটা। নিশ্চয় লোকে দেখতে এসেছে। তাদেরই কেউ করেছে একাজ।

সেটা তো অনেক আগের কথা, রবিন বলল। জিনা, তারপর কি আর দ্বীপে এসেছ তুমি?

কতবার? সে জন্যেই তো বলছি…আরে, এই ঢাকনাটাও তো সরানো!

কোথায়? এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিশোর। জিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে সে-ও দেখে ফেলল। দুর্গের নিচে পাতালঘরে নামার একটা সিঁড়ি আছে, কুয়ার মুখের মতই সিঁড়ির গর্তের মুখটাও ঢাকা থাকে ঢাকনা দিয়ে। সেটা সরানো। অর্ধেক বেরিয়ে আছে গর্তের মুখ।

আমার দ্বীপে আমার অনুমতি ছাড়া নামে কার এতবড় সাহস! জিনিস উলট-পালট করে! ধরতে পারলে…

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, আচ্ছা, সেদিন যে ধোঁয়া দেখলাম, এসব তার জবাব নয় তো?

কৃত্রিম হতাশায় মাথা নাড়ল মুসা, এই তো, শুরু করল গ্রীক ভাষা!

খালি কথা ভুলে যাও, সেজন্যেই তো এত কঠিন লাগে। সেদিন যাকে আমরা স্টীমারের ধোঁয়া ভেবেছি সেটা হয়তো ক্যাম্পফায়ারের ধোঁয়া। দ্বীপে নেমে আগুন জ্বেলেছিল কেউ।

কিশোরের সন্দেহই যে ঠিক, তার আরও প্রমাণ মিলল। একজায়গায় পাওয়া গেল আগুন জ্বালানোর চিহ্ন। রান্না করে খেয়েছে কেউ। একটা সিগারেটের গোড়াও পড়ে আছে। দিন কয়েকের মধ্যে যে কেউ দ্বীপে উঠেছিল, তাতে আর সন্দেহ রইল না কারও।

তবে ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাল না তিন গোয়েন্দা। নির্জন দ্বীপ, যে কেউ উঠতে পারে এখানে, পিকনিক করার জন্যেও আসতে পারে। জিনা তো আর পাহারা দিয়ে রাখে না।

কিন্তু জিনা এত সহজে মেনে নিতে পারল না, ফুসতে লাগল, তাকে না বলে তার দ্বীপে লোকটা উঠেছিল বলে।

ভাটার সময় এখন। পানি নেমে যাওয়ায় মাথা উঁচু করে রয়েছে অসংখ্য পাথর। একটা থেকে আরেকটায় লাফিয়ে লাফিয়ে জাহাজটার কাছে পৌঁছানো যাবে।

তবে কাজটা মোটেও সহজ নয়। ক্রমাগত ভিজে ভিজে, শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে পাথরগুলো। পা পিছালানোর সম্ভাবনা প্রচুর।

খুব সাবধানে এগোল ওরা। নিরাপদেই এসে পৌঁছল জাহাজের পাশে। দূর থেকে যতটা মনে হয়, কাছে এলে তার চেয়ে অনেক বেশি বড় লাগে ওটা। আগের বার যেমন দেখেছিল, প্রায় তেমনি আছে, খুব একটা বদলায়নি। নিচের দিকটা পানিতে তলিয়ে আছে। শ্যাওলায় ঢাকা। কাঠ আঁকড়ে রয়েছে নানা রকম শামুক-গুগলি। কেমন একটা আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছে জাহাজের গা থেকে। ( সঙ্গে করে দড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। বার তিনেক চেষ্টা করে জাহাজের ভাঙা মাস্তুলের গোড়ায় দড়ির ফাঁস আটকে ফেলল মুসা। দড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে।

একে একে উঠে এল অন্য তিনজন। রাফিকে কিনারে রেখে আসা হয়েছে। চুপচাপ থাকতে নির্দেশ দিয়েছে তাকে জিনা। এদিকেই তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে সে, আসতে পারেনি বলে মন খারাপ।

আগের চেয়ে করুণ অবস্থা জাহাজটার। ফোকরের সংখ্যা বেড়েছে। গন্ধও যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি। হাত নেড়ে রবিন বলল, অসম্ভব! এখানে বাস করা যাবে না। নিচেই নামব না আমি।

 জলজ প্রাণী, শ্যাওলা আর কাঠ পচে হয়েছে এই ভয়াবহ গন্ধ। নিঃশ্বাস নিতেই যেন কষ্ট হয়।

কিশোর বলল, এসেছি যখন না দেখে যাব না। তোমার সহ্য না হলে। এখানেই থাকো। আমরা নেমে দেখে আসি।

 এখানে যে থাকা যাবে না, বোঝা হয়ে গেছে। তবু পুরানো স্মৃতির আকর্ষণই যেন নিচে টেনে নামাল কিশোরকে। ক্যাপ্টেনের ঘরটা সবচেয়ে। বড়। তবে তাতে ঘুমানো তো দূরের কথা, জিনিসপত্র রাখারও প্রশ্ন ওঠে না। পুরো জায়গাটাই দুর্গন্ধে ভরা, ভেজা ভেজা। কাঠ এত পিচ্ছিল হয়ে আছে কোথাও কোথাও, পা রাখাই মুশকিল।

চলো, যাইগে, মুসা বলল। ইকটুও ভাল লাগছে না।

মই বেয়ে ওপরে উঠছে ওরা, এই সময় কানে এল রবিনের চিৎকার, কিশোর, দেখে যাও, দেখে যাও!

তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরেকটু হলেই পিছলে পড়ে হাঁটু ভাঙত মুসা। ডেকে উঠে এল সবার আগে। কি হয়েছে? কি দেখেছ?

চোখ চকচক করছে রবিনের। হাত তুলে দেখাল। আগের বার যখন এসেছিলাম, ওটা ছিল না!

ডেকের একধারে একটা লকার, হাঁ হয়ে খুলে আছে। তার মধ্যে একটা কালো ট্রাংক।

 তাই তো? রবিনের মতই অবাক হয়েছে কিশোর। আগের বার তো, এটা ছিল না! একেবারে নতুন জিনিস! কে রেখে গেল? কি আছে এর মধ্যে?

ডেকও পিচ্ছিল। সাবধানে লকারটার দিকে এগোল ওরা। দরজাটা বন্ধই থাকার কথা, কিন্তু বাতাসেই হোক, কিংবা ঢেউয়ের দোলায়ই হোক, খুলে গেছে।

ট্রাংকটা ছোট। বের করে আনল কিশোর।

ওখানে এই জিনিস রাখতে গেল কে? মুসার প্রশ্ন। চোর-ডাকাত নয় তো? স্মাগলার?

হতে পারে, ট্রাংকটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। চোরাই মাল লুকানোর দারুণ জায়গা এই জাহাজ। কেউ আসে না এখানে। হঠাৎ করে দেখে ফেলারও ভয় নেই।

যদিও আমরা দেখে ফেললাম, জিনা বলল।

আমাদের মত তো আর ছোঁক ছোঁক করে না কেউ, মুসা বলল।

 কি আছে ভেতরে? ঝুঁকে ট্রাংকটার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। এই কিশোর, কোকেন-টোকেন নয় তো? স্মাগল করে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছে।

দুটো নতুন তালা লাগানো রয়েছে। চাবি ছাড়া খোলা যাবে না।

ভেঙে ফেললেই হয়, জিনা বলল।

না। এটার কথা যে আর গোপন নেই, তালা ভাঙা দেখলেই বুঝে যাবে। চোরই হোক, আর চোরাচালানিই হোক, তাকে বুঝতে দেব না যে আমরা দেখে ফেলেছি।

ধরার ইচ্ছে?

নয় কেন? নিজেকেই যেন বোঝাচ্ছে কিশোর, আমরা যে দ্বীপে উঠেছি, কেউ জানে না। লুকিয়ে থেকে চোখ রাখব। কোনও বোট আসে কিনা দেখব।

মন্দ হয় না, মুসা বলল। একটা কাজ পেয়ে গেলাম। একঘেয়ে লাগবে আর এখানে

এমনিতেও লাগত না, বাধা দিয়ে বলল জিনা।

এখন আরও বেশি লাগবে না।

সাগরের দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল কিশোর, জোয়ার আসছে! জলদি নেমে যাওয়া দরকার।

ট্রাংকটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিল সে।

সমস্যা কিন্তু একটা হবে, রবিন বলল। দড়িটা রেখে যেতে হবে আমাদের। লোকটা এসে এই দড়ি দেখলেই তো বুঝে যাবে, কেউ উঠেছিল।

ভাল কথা মনে করেছ! ঘুরে তার দিকে তাকাল কিশোর, কি করা যায়?

সমাধান করে দিল মুসা, তোমরা নেমে যাও। দড়িটা খুলে নিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ব আমি।

না না, পা ভাঙবে।

 ভুলে যাচ্ছ কেন, আমি মুসা আমান। টারজানের চেয়ে কম যাই কিসে? নামো তোমরা।

আর কিসে কম যাও বলতে পারব না, তবে খাওয়ার ব্যাপারে যে যাও না, গলাবাজি করে বলতে পারব, হেসে বলল রবিন।

অন্যেরাও হাসল।

টারজানের চেয়ে কম যে যায় না, প্রমাণ করে ছেড়ে দিল মুসা। সবাই নেমে যেতেই মাস্তুলের গোড়া থেকে দড়িটা খুলে নিল। সেটা কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে জাহাজের কিনার ধরে ঝুলে পড়ল। নিচে ওখানটায় পাথর আছে কিনা দেখে নিয়েছে আগেই। আলগোছে ছেড়ে দিল হাতটা। ঝপ করে পড়ল পানিতে। পানি ওখানে নেহায়েত কম নয়, পাথরও নেই, কিছুই হলো না ওর।

এবারও নিরাপদেই কিনারে ফিরে এল সবাই। পিছলে পড়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটাল না।

এতক্ষণ একা বসে থেকে অস্থির হয়ে পড়েছিল বেচারা রাফি। আনন্দে হাত চেটে দিতে লাগল সবার।

কিশোর বলল, জাহাজে তো জায়গা হলো না, রাতে থাকি কোথায় বলো তো? জিনা, তোমার কোন জায়গা জানা আছে? গুহাটুহা হলে ভাল হত,..,

আছে! তুড়ি বাজাল জিনা। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চেহারা। এসো আমার সঙ্গে।

.

একটা পাহাড়ের কাছে ওদেরকে নিয়ে এল জিনা। ঢালে ঝোপঝাড় যেমন ঘন, পাথরেরও ছড়াছড়ি। হাত তুলে দেখাল, ওই যে।

কিছুই দেখতে পেল না তিন গোয়েন্দা।

রবিন জিজ্ঞেস করল, কই?

ওই তো। চলো, আরও কাছে, তাহলেই দেখবে।

ঝোপঝাড় আর লতায় প্রায় ঢাকা পড়ে আছে গুহামুখটা। এখানে আছে ওটা জানা না থাকলে চোখেই পড়ে না।

আগে আগে ঢুকল জিনা। পেছনে অন্যেরা।

খাইছে! ঢুকেই বলে উঠল মুসা, দারুণ তো!

গুহার ভেতরটা আসলেও সুন্দর। সাদা পাউডারের মত মিহি, শুকনো বালিতে ঢাকা মেঝে। সমুদ্র সমতল থেকে অনেক ওপরে, সাংঘাতিক জলোচ্ছাসের সময়ও এখানে পানি ঢোকে কিনা সন্দেহ। একধারের দেয়ালে একটা তাকমত রয়েছে।

বাহ, খুশি হয়ে বলল রবিন, এক্কেবারে যেন আমাদের জন্যে বানিয়ে রাখা হয়েছে। জিনিসপত্র রাখতে পারব ওটাতে। কিশোর, ওই দেখো, স্কাইলাইটও আছে।

গুহাটা অনেক বড়। ছাতের একধারে একটা ফোকর। আলো আসছে সে পথে। ফোকর দিয়ে বৃষ্টির পানি গুহায় ঢোকে, তবে সরাসরি মেঝেতে না পরে দেয়াল বেয়ে গড়িয়ে চলে যায় একটা গর্তের দিকে। দীর্ঘদিন পানি পড়ে পড়েই বোধহয় তৈরি হয়েছে গর্তটা। নিশ্চয় নালাও আছে পাহাড়ের ভেতরে।

কিশোর বলল, নৌকা থেকে আমাদের জিনিসগুলো এনে দড়িতে বেধে ওখান দিয়ে নামিয়ে দেয়াটা সহজ হবে, বার বার পাহাড়ের খাড়া দেয়াল। বাইতে হবে না আর। যে দিক দিয়ে ঢুকেছে সে পথটা দেখিয়ে বলল, সৈকত থেকে এ পথ দিয়ে আসা কঠিন।

গুহা থেকে বেরিয়ে প্রায় খাড়া দেয়াল বেয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। ওরা। প্রথম কাজ, বাইরে থেকে স্কাইলাইটের ফোকরটা খুঁজে বের করা।

ঢাল বেয়ে উঠতে সবচেয়ে অসুবিধে হলো রাফির। মানুষের মত হাত নেই তার, ঝোপ কিংবা লতা ধরে যে পতন ঠেকাবে, সে উপায়ও নেই। হড়হড় করে পিছলে পড়ে যেতে চায়। হাস্যকর ভঙ্গিতে শরীরটাকে বাকিয়ে নখ দিয়ে মাটি খামচে ধরে উঠতে লাগল সে।

ওপরে উঠে এল ওরা। ফোকরটা কোনখানে, মোটামুটি আন্দাজ থাকায় খুঁজে বের করা কঠিন হলো না। জানা না থাকলে গুহামুখের মতই এটাও সহজে দেখতে পেত না। এক ধরনের কাঁটাঝোপে ঢেকে রেখেছে।

কাঁটাডাল সরিয়ে নিচে উঁকি দিল কিশোর। ফোকরটা একটা সুড়ঙ্গমুখ। মাত্র কয়েক ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ, ওপর থেকে মোটা একটা পাইপের মত নেমে গেছে ঢালু হয়ে। গুহার ছাতে গিয়ে শেষ হয়েছে। দেখেটেখে মাথা দুলিয়ে বলল, হুঁ, বেশি নিচে না। কিন্তু বিপজ্জনক। না দেখে এই গর্তে পা দিলে নিচে পড়ে হাত-পা ভাঙতে পারে।

সবাই মিলে গর্তের মুখের কাছের ঝোপ আর লতা পরিষ্কার করে ফেলল। কাঁটার আঁচড় লাগল হাতে।

নিচের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, দড়ি ছাড়াও কিন্তু লাফিয়ে নামা যায়।

দরকারটা কি ঝুঁকি নেয়ার, কিশোর বলল। চলো, মালগুলো নিয়ে আসি।

সৈকতে চলে এল ওরা। যে যতটা পারল, জিনিসপত্র হাতে তুলে নিল। নিয়ে এল ফোকরের কাছে। সেগুলো রেখে আরও মাল আনতে ফিরে গেল। এভাবে কয়েকবারে সমস্ত মাল এনে জমা করল একজায়গায়। এইবার নিচে নামানোর পালা।

লম্বা একটা দড়িতে এক ফুট পর পর গিট দিল কিশোর। দড়ির একমাথা বাধল একটা বড় ঝোপের গোড়ায়। গাছটার শেকড় অনেক গভীরে, ভার রাখতে পারবে। দড়ি বেয়ে নেমে যেতে বলল জিনা আর রবিনকে। ওপর থেকে সে আর মুসা দড়িতে মাল বেধে নামিয়ে দেবে, নিচে থেকে ওরা দু জনে খুলে নেবে। তারপর আবার মাল পাঠানো হবে।

নেমে গেল রবিন ও জিনা। দড়িতে গিট থাকায় সুবিধে হলো, হাত পিছলে গেল না।

মাল নামানোটা আরও সহজ কাজ।

সমস্যা হলো রাফিকে নিয়ে।

মুসা জিজ্ঞেস করল, ওকে নামাব কি ভাবে?

বেঁধে নামাতে হবে, আর তো কোন উপায় দেখি না।

তবে সমস্যার সমাধান রাফি নিজেই করে দিল। হঠাৎ ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল একটা খরগোশ। কুকুরটাকে দেখে ভয় পেয়ে বিরাট লাফ দিয়ে ফোকর পেরিয়ে চলে গেল অন্যপাশে।

তাড়া করল রাফি। উত্তেজিত না হলে, সাবধান থাকলে সে-ও ফোকরটা পেরিয়ে যেতে পারত, কিন্তু তাড়াহুড়োয় কোন কিছু খেয়াল না করে লাফ দিয়ে বসল, পড়ল একেবারে ফোকরে। নিমেষে ঢালু সুড়ঙ্গ গলে পিছলে নেমে গেল নিচে। ধপ করে পড়ল মেঝেতে।

ওপর থেকে জিনার তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল মুসা আর কিশোর।

রাফির কিছু হয়েছে কিনা দেখার জন্যে তাড়াতাড়ি দড়ি বেয়ে নেমে গেল মুসা।

তার পেছনেই নামল কিশোর।

রাফির কিছু হয়নি দেখে হাঁপ ছাড়ল। মিহি নরম বালি বাঁচিয়ে দিয়েছে কুকুরটাকে। হাড়টাড় ভাঙেনি।

প্রচুর পরিশ্রম করেছে। খিদে পেয়েছে সবারই। খাবারের টিন খুলে খেতে বসে গেল ওরা।

পেট কিছুটা শান্ত হয়ে এলে কিশোর বলল, কাজ কিন্তু আরও আছে। বিছানার জন্যে লতাপাতা জোগাড় করে আনতে হবে।

মুসা বলল, কি দরকার কষ্ট করার। যা মিহি আর নরম বালি, এর ওপরই কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ব।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সবাই ক্লান্ত। গুহা থেকে এখন আর বেরোতে ইচ্ছে করল না কারও।

মোম জ্বালল রবিন। গুহার দেয়ালে ছায়ার নাচন। কেমন রহস্যময় হয়ে উঠল গুহার পরিবেশ।

আরও কিছুক্ষণ জেগে রইল ওরা। কম্বলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্পগুজব করল। ঘুমে কখন জড়িয়ে এল চোখ, বলতে পারবে না।

গলে গলে শেষ হলো মোম, নিভে গেল আলো; কেউ দেখল না সেটা একমাত্র রাফি ছাড়া…।

.

১০.

পরের দিনটাও যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। হেসেখেলে, সাঁতার কেটে, আর দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দিল ওরা। সঙ্গে খাবার নিয়ে বেরিয়েছিল, ফলে আর একবারও গুহায় ঢোকার প্রয়োজন বোধ করেনি। ঢুকল একেবারে সন্ধ্যাবেলায়। মোম জ্বেলে খাওয়া সারল।

দেয়ালে ছায়া নাচছে। সেদিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিল মুসার। বলল, আগুন জ্বলতে পারলে ভাল হত। আলো আরও বেশি পেতাম…

হেসে ফেলল রবিন, ভুতের ভয় পাচ্ছ তো? আগুনে আলো বেশি পাবে বটে, কিন্তু গরম হয়ে যাবে গুহার ভেতর। ধোঁয়ায় যাবে দম আটকে। বেরোনোর তো পথ নেই।

আছে, ওপর দিকে আঙুল তুলল মুসা। ফোকরটা চিমনির কাজ করবে।

তা করবে, কিশোর বলল, কিন্তু বাইরে থেকে ধোঁয়া দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। স্মাগলারদের চোখে পড়ে যেতে পারে। ভুলে যাচ্ছ কেন, আমরা এখানে লুকিয়ে আছি। এমন কিছু করা চলবে না, যাতে ওদের চোখে পড়ে যাই।

আগুন জ্বালানো আর হলো না। আগের দিনের মতই গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। জেগে রইল কেবল রাফি। কান খাড়া।

হঠাৎ গরগর করে উঠল।

ঘুম ভেঙে গেল পাশে শোয়া জিনার। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, রাফি, কি হয়েছে?

রবিনও জেগে গেছে। মুসা আর কিশোর অনেকটা দূরে, তাই রাফির চাপা গরগর ওদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি।

নিচু স্বরে রবিন বলল, মনে হয় স্মাগলাররা এসেছে!

চলো, দেখি!

চলো।

দড়িটা বাঁধাই আছে, ঝুলে আছে ফোকর থেকে। সেটা বেয়ে প্রথমে উঠে এল রবিন। সাবধানে মাথা বের করল ফোকরের বাইরে। শরীরটা বের করার আগে উঁকি দিয়ে দেখে নিল কিছু আছে কিনা।

রাফিকে চুপ থাকার নির্দেশ দিয়ে তার পেছনে উঠল জিনা।

সাগরের দিকে তাকাল ওরা। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত। চাঁদ ওঠেনি এখনও। কোন জাহাজ চোখে পড়ল না। এমন কি ভাঙা জাহাজটাও না।

চাঁদ থাকলে ভাল হত, রবিন বলল।

নেই যখন, কি আর করা।

হঠাৎ রবিনের চোখে পড়ল আলোটা। দেখেছ!

হ্যাঁ। উত্তেজিত হয়ে বলল জিনা, ভাঙা জাহাজটার কাছ থেকে আসছে! কেউ উঠেছে ওটাতে! হ্যারিকেনের আলো!

স্মাগলারই! আরও মাল এনে লুকাচ্ছে।

কিংবা ট্রাংকটা নিতে এসেছে।…দেখো, নড়ছে আলোটা। নৌকা নিয়ে এসেছে ওরা। জাহাজের গায়ে বেঁধে রেখে উঠেছে।

যতটা সম্ভব কান খাড়া করে রেখেছে দু-জনে, শব্দ শোনার আশায়। কিছুই শুনল না। জাহাজটা অনেক দূরে।

 কয়েক মিনিট পর নিভে গেল আলো।

দাঁড়ের শব্দ শোনার অপেক্ষায় রইল ওরা। কিন্তু ঢেউয়ের একটানা শব্দের জন্যে আর কিছুই কানে ঢুকল না।

আরও মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে নেমে চলে এল ওরা। কিশোর আর মুসা ঘুমিয়েই আছে। খবরটা ওরা জানল পরদিন সকালে।

আমাদের ডাকলে না কেন? অনুযোগের সুরে বলল মুসা।

তেমন কিছু তো আর দেখিনি, জিনা বলল, শুধু হ্যারিকেনের আলো। এটা দেখানোর জন্যে আর কি ডাকব। ভাবলাম, ঘুমিয়ে আছ, থাকো।

তারমানেই মানুষ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। খেয়ে নাও। দেখতে যাব।

ভাটার সময় জাহাজটা দেখতে চলল ওরা। আগের বারের মতই পিচ্ছিল পাথর টপকে টপকে এসে দাঁড়াল জাহাজের ধারে। দড়ির সাহায্যে ডেকে উঠল।

লকারের দরজাটা বাতাসে আপনাআপনি খুলে যায় বলে ফাঁকে একটা কাঠের গোজ ঢুকিয়ে দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।

গোঁজটা খুলে নিল কিশোর। দরজা খুলতে অসুবিধে হলো না।

পিচ্ছিল ডেকের ওপর সাবধানে পা ফেলে এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করল জিনা, ট্রাংকটা আছে?

আছে। অবাক কাণ্ড! আরও কি সব রেখে গেছে, দেখো! খাবারের টিন, কাপ, প্লেট, মোমবাতি, হ্যারিকেন, কম্বল, আমাদের মতই যেন দ্বীপে বাস করতে এসেছে কেউ! বার দুই ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। নিশ্চয় কেউ থাকতে এসেছে। চোরাই মাল আসার অপেক্ষায় থাকবে বোধহয়। দিন-রাত নজর রাখতে হবে আমাদের।

উত্তেজিত হয়ে জাহাজ থেকে নেমে এল ওরা। লুকিয়ে থেকে বাস করার চমৎকার একটা জায়গা পেয়ে গেছে বলে খুশি। এখানে থাকলে ওরা কারও চোখে পড়বে না, কিন্তু কেউ এলে ওদের চোখে ঠিকই পড়বে।

নৌকাটা লুকিয়ে ফেলতে হবে! হঠাৎ বলে উঠল জিনা। ও পথে ঢোকার সম্ভাবনাই বেশি। জাহাজটার এদিক দিয়ে ঢোকা ডেঞ্জারাস। বোকা না হলে এদিক দিয়ে দ্বীপে ওঠার কথা ভাববে না কেউ।

ভাববে, দক্ষ নাবিক হলে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। সামান্য একটু সরে গেলেই নৌকা ভেড়াতে পারবে।

কিন্তু ঝুঁকি নেয়ার দরকার কি? মুসা বলল, নৌকাটা লুকিয়ে ফেলাই ভাল। চলো, এক্ষুণি।

কিন্তু লুকাব কোথায়? রবিনের প্রশ্ন, এতবড় একটা নৌকা?

জানি না, চিন্তায় পড়ে গেছে কিশোর। চলো আগে, যাই।–এখানে বসে কিছু বোঝা যাবে না।

দল বেধে সৈকতে চলে এল ওরা। সাগর থেকে এসে প্রণালীটা যেখানে খাঁড়িতে ঢুকেছে, তার একধারে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট গুহা আছে। সব সময় পানি থাকে। সেটা দেখিয়ে জিনা বলল, এর মধ্যে লুকানো যেতে পারে। ভেতরে অনেক বড় একটা পাথরের চাঙড় আছে। তার ওপাশে রাখলে সহজে চোখে পড়বে না। তবে ঝড় এলে, পানি ফেপে উঠলে আছাড় মেরে চুরমার করে দিতে পারে নৌকাটা।

 ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগল সবাই। কিন্তু আর কোন উপায়ই দেখল

 শেষে ওই গুহাতেই নৌকা ঢোকানো হলো। চাঙড়ের ওপাশে নেয়ার পরও পুরোটা আড়াল হলো না নৌকার। উজ্জ্বল লাল রঙের জন্যে হয়েছে বিপদ। তবে এই সমস্যারও সমাধান হলো। ডুব দিয়ে দিয়ে জলজ আগাছা আর শ্যাওলা তুলে ঢেকে দিল জিনা আর মুসা।

গুড। এপাশ থেকে ওপাশ থেকে দেখে মাথা ঝাঁকাল কিশোর, দেখা যায় না। চলো, চায়ের সময় হয়েছে। গুহা থেকে বেরিয়ে আসার পর বলল, একটা বোকামি কিন্তু করে ফেলেছি। পাহারা দেয়ার জন্যে একজনকে পাহাড়ের চুড়ায় বসে থাকা উচিত ছিল।

তাই তো! একমত হয়ে বলল রবিন, বোকামিই হয়ে গেছে। কি আর, করা। তবে আমার মনে হয় না দিনে কেউ উঠবে। স্মাগলাররা এলে আসবে রাতের বেলা।

নিজেদের আস্তানায় ফিরে চলল, ওরা।

 কিছুদূর এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রাফি। গরগর শুরু করল।

দুর্গের দিকে এগোচ্ছিল ওরা, ওখান দিয়ে ঘুরে এসে ফোকর দিয়ে গুহায় নামার ইচ্ছে ছিল। এই সময় হুঁশিয়ার করল রাফি।

কিশোরের নির্দেশে তাড়াতাড়ি একটা ঝোপে ঢুকে পড়ল ওরা। রাফিকে চুপ থাকতে বলল জিনা।

আস্তে ডাল সরিয়ে ফাঁক করে উঁকি দিল কিশোর। কাঁটার খোঁচা লাগল। কিন্তু উত্তেজনায় খেয়ালই করল না সেটা। চত্বরে মানুষ দেখতে পেয়েছে। সে–তাকাতে না তাকাতেই অদৃশ্য হয়ে গেল লোকগুলো।

জিনাও দেখতে পেয়েছে। ফিসফিস করে বলল, কিশোর, পাতালঘরে চলে গেল না তো?

মনে হয়। ঢাকনা ওরাই সরিয়েছে। চোরাই মাল জমা করে রেখেছে হয়তো নিচে। মানুষ লুকিয়ে থাকতেও অসুবিধে নেই। চোর-ডাকাতের জন্যে স্বর্গ। ভাবল একমুহূর্ত। এখান থেকে ভালমত দেখতে পারব না। চলো, গুহায়। নিচের মুখটা দিয়ে ঢুকব। তারপর একজন উঠে বসে থাকব ফোকরের কাছে। দেখব, ব্যাটারা কি করে।রাফি, একদম চুপ, একটা শব্দ করবি না!

ওপর দিয়ে আর গেল না ওরা। নিচে নেমে দ্বীপের কিনার ঘুরে চলে এল গুহামুখের কাছে। ভাল করে তাকাল একবার আশপাশে। কেউ নেই। দেখছে না ওদেরকে। তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ল ভেতরে।

ঢুকেই রবিনকে পাঠিয়ে দেয়া হলো নজর রাখার জন্যে।

দড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল রবিন। ফোকর দিয়ে মাথা বের করে তাকিয়ে রইল দুর্গের দিকে। ঝোপের ডাল তার মাথা আড়াল করে রেখেছে, ওদিক থেকে কেউ দেখতে পাবে না।

নিচে হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসল রাফি। ঘেউ ঘেউ করে দু-বার ডাক দিয়েই বেরিয়ে গেল গুহা থেকে। তাকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারল না। জিনা।

গুহামুখের কাছে এলে ডাকল সে, রাফি! কোথায় গেলি তুই! এই রাফি?

সাড়া দিল না কুকুরটা।

একটু পরেই তাকে দেখতে পেল রবিন। এক ঝোপ থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে আরেক ঝোপে ঢুকল রাফি। যেন শিকারের সন্ধান পেয়েছে। চিতাবাঘ, ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে এখন।

কিসের সন্ধান পেয়েছে সেটা জানতে ও দেরি হলো না। চত্বরের দিক থেকে ল্যাগব্যাগ করতে করতে বেরিয়ে এল একটা ছোট্ট কুকুর। চোখের পলকে ঝোপ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাফি।

এমন চিৎকার জুড়ে দিল ছোট কুকুরটা, যেন খুন করে ফেলা হচ্ছে। তাকে। কউউ উউ করে যেন চেঁচিয়ে বলছে, বাবাগো! মেরে ফেললগো! বাঁচাওগো!

শঙ্কিত হলো রবিন। সর্বনাশ করে দিল রাফি। চেঁচামেচি শুনে এখন বেরিয়ে আসবে স্মাগলাররা। রাফিকে সরে আসার জন্যে ডাক দিতে গেল

কিন্তু মুখ খোলার আগেই যারা বেরিয়ে এল, তাদের দেখবে কল্পনাই করেনি সে। টোড পরিবার–মা, বাবা, ছেলে, তিনজনেই আছে। ও, এ কারণেই কুত্তাটাকে চেনা চেনা লাগছিল!

ঝট করে ফোকরে মাথা নামিয়ে ফেলল রবিন। তার ধারণা, নিশ্চয় কোনভাবে টোডরা জেনে গেছে ওরা দ্বীপে পালিয়ে এসেছে। ধরে নিতে এসেছে এখন। খবরটা বন্ধুদের জানানোর জন্যে তাড়াতাড়ি নেমে এল নিচে।

কুকুরের ঝগড়া গুহার ভেতর থেকেও শোনা যাচ্ছে। রবিন বলল, জিনা, রাফিকে জলদি ডাকো! ডারবির সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছে।

অবাক হলেও প্রশ্ন করল না জিনা। আগে রাফিকে ডেকে আনা দরকার। দুই আঙুল মুখে পুরে তীক্ষ্ণ শিস দিল। ডাকটা শুনতে পেল রাফি। এই আদেশ না মানার অর্থ তার জানা আছে। ভীষণ রাগ করবে জিনা। পিটুনিও লাগাতে পারে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডারবির কান কাঁটা স্থগিত রেখে ফিরে আসতে হলো তাকে। প্রথমবার যে ভাবে ঢুকেছিল, সে ভাবেই ফোকর গলে ধপ করে এসে পড়ল গুহার মেঝেতে। আরেকটু হলেই পড়েছিল মুসার মাথায়।

রাফির পিছু পিছু ছুটে এসেছে টেরি। হঠাৎ দেখল, কুকুরটা নেই। চোখের সামনে হাওয়া। একেবারে ভোজবাজি! চোখ ডলল। বিশ্বাস করতে পারছে না।

তার কাছে এসে দাঁড়াল তার বাবা-মা।

মিসেস টোড জিজ্ঞেস করল, কুত্তাটা গেল কোথায়? দেখতে কেমন?

মা, বললে বিশ্বাস করবে না, টেরি বলল, কুত্তাটা দেখতে ঠিক জিনার শয়তান কুত্তাটার মত!

গুহায় বসে তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পেল গোয়েন্দারা। ফিসফিস করে রাফিকে সতর্ক করল জিনা, শব্দ না করার জন্যে।

তা কি করে হয়! মিসেস টোড বলছে, ওরা তো গেছে রকি বীচে। কুত্তাটাকেও নিয়ে গেছে। নিজের চোখেই তো দেখলাম স্টেশনের দিকে যেতে। নিশ্চয় এটা অন্য কুত্তা। কেউ ফেলে গেছে।

তা তো বুঝলাম, শোনা গেল টোডের খসখসে কণ্ঠ, কিন্তু গেল কোথায়?

মাটিতে তলিয়ে গেছে! জবাব দিল টেরি।

তোর মাথা! ধমকে উঠল টোড। গাধা যে গাধাই রয়ে গেছে! মাটিতে তলায় কি করে! তুই তলাতে পারবি? মাটি কি পানি? এক হতে পারে, চুড়া থেকে নিচে পড়ে যেতে পারে। পড়লে মরবে। না মরলেও হাড্ডিগুড্ডি ভাঙবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

চূড়ার কাছে গর্তটর্তও থাকতে পারে, মিসেস টোড বলল। হয়তো তাতে লুকিয়েছে। এসো না, দেখি।

নিথর হয়ে বসে রইল গোয়েন্দারা। রাফির কলার চেপে ধরে রাখল জিনা। ঝোপঝাড়ের ডালপাতা সরানোর শব্দ কানে আসছে। সেই সঙ্গে কাঁটার আঁচড় খেয়ে উহ-আহ। ফোকরের মুখের কাছ থেকে দূরে রইল ওরা। বলা যায় না, যে কোন মুহূর্তে না জেনে গর্তে পা দিয়ে বসতে পারে কোন টোড, গুহায় এসে পড়তে পারে।

কিন্তু কাঁটার জন্যেই বোধহয়, গর্তটার বেশি কাছে এল না ওরা। ফলে দেখতেও পেল না।

মিসেস টোডের কথা শোনা গেল, টেরি, সত্যি ওই কুত্তাটাকেই দেখেছিস তো? তোর তো আবার কথার কোন ঠিকঠিকানা নেই।

খোদার কসম, মা, ওটার মতই লাগল!

হুঁ! বাড়ি থেকে পালিয়ে এখানেই এসে লুকিয়েছে হয়তো বিচ্ছুগুলো। আমাদের বুঝিয়েছে, ট্রেনে করে চলে গেছে। এখানে এসে থাকলে আমাদের কাজ সব গড়বড় করে দেবে। নৌকা ছাড়া তো আসতে পারবে না, সেটা কোথায় আছে বের করা দরকার।

অত অস্থির হওয়ার কিছু নেই, টোড বলল। এসে থাকলে খুঁজে পাবই। এত ছোট দ্বীপে লুকানোর জায়গা কম। বিশেষ করে নৌকাটা পেয়েই যাব।

এখন খুঁজতে অসুবিধে কি?

অসুবিধে নেই। টেরি, তুই ওদিক দিয়ে ঘুরে যা। ডোরিয়া, তুমি দুর্গের দিকে যাও। আমি এদিকটায় খুঁজছি।

গুহার মধ্যে গা ঘেষাঘেঁষি করে বসে রইল ছেলেমেয়েরা, যেন এভাবে থাকলেই আর খুঁজে পাবে না ওদেরকে। আল্লাহ আল্লাহ করছে, যাতে নৌকাটা চোখে পড়ে না যায়।

তিন গোয়েন্দা, জিনা, রাফি; এদের কারও সামনেই পড়তে চায় না। টেরি। ভয়ে ভয়ে এগোল। চলে এল ছোট্ট সৈকতে। বালিতে নৌকার দাগ দেখতে পেল বটে, কিন্তু চিনতে পারল না। জোয়ারের সময় পানি এসে অনেকখানিই মুছে দিয়ে গেছে দাগ। পানি ঢুকে থাকা ছোট গুহাটার দিকে তাকাল ভয়ে ভয়ে। একবার এগোয় একবার পিছোয়, এরকম করতে করতে শেষমেষ এসে উঁকি দিল ভেতরে। অন্ধকার। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। ভেতরে ঢোকার আর সাহস করতে পারল না। ভাবল, কাজ কি বাবা ঢুকে! কোন জলদানব লুকিয়ে আছে এখানে কে জানে! ফিরে এল তার বাবা যেখানে খোঁজাখুজি করছে সেখানে।

ওদিকটায় কিছু নেই, জানাল টেরি।

তার মা-ও সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পেল না, ফিরে এল।

টোডও কিছু না পেয়ে বলল, না, ওই ছেলেমেয়েগুলো নয়। তাহলে নৌকা থাকতই। ওটা অন্য কুত্তা। কেউ ফেলে গেছে এখানে। আস্তে আস্তে বুনো হয়ে উঠেছে। সে জন্যেই কামড়াতে এসেছে ডারবিকে।

তাহলে তো ভয়ের কথা, মিসেস টোড বলল। আবারও আসতে পারে। আমাদেরকেই যে কামড়ে দেবে না তার ঠিক কি?

সাবধান থাকতে হবে। দেখলেই গুলি করে মারব এবার।

হাঁপ ছাড়ল গোয়েন্দারা। যাক, আপাতত ফাড়া কাটল। ফোকরটা দেখতে পায়নি কানাগুলো। নৌকাটাও না। তবে রাফির জন্যে শঙ্কিত হয়ে উঠল জিনা। তার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার একটা বড় কারণ, টোডেরা বিষ খাইয়ে রাফিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু এখানে এসেও নিশ্চিত হওয়া গেল না। সেই মেরে ফেলার ভয়। এখন বলছে, গুলি করে মারবে!

কথা বলতে বলতে সরে গেল টোডেরা। শেকল দিয়ে রাফিকে বেঁধে ফেলল জিনা। গুহা থেকেই বেরোতে দেবে না আর। ডারবির গন্ধ পেলেই ও খেপে যায়, এ এক অদ্ভুত কাণ্ড! সাধারণত এমন করে না রাফি। অন্য কুকুর দেখলে বরং বন্ধুতই করতে যায়।

খিদে পেয়েছে। টিন খুলে খাবার বের করতে লাগল রবিন। তাকে সাহায্য করল মুসা।

কিশোর বলল, একটা ব্যাপার পরিষ্কার, আমাদের খোঁজে আসেনি ওরা। ট্রেনে করে রকি বীচে চলে গেছি, এটাই বিশ্বাস করেছে।

তাহলে কেন এল? মুসার প্রশ্ন।

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

আমরা পালিয়েছি বলেই হয়তো ওরাও ভয়ে পালিয়েছে, আনারসের টিন খুলে রেখে মাংসের টিন টেনে নিল রবিন। পারকার আংকেলকে কি জবাব দেবে?

জবাব তো সহজ। বলবে, আমরা বাড়ি ফিরে গেছি। আংকেলও কিছু সন্দেহ করবেন না। তিনিই তো আমাদের চলে যেতে বলেছেন।

ভয়ে পালিয়েছে, না মরতে এসেছে, ওসব জানার দরকার নেই আমার। ফুঁসে উঠল জিনা, এটা আমার দ্বীপ! এখানে আসার কোন অধিকার নেই ওদের! চলো, ঘাড় ধরে গিয়ে বের করে দিয়ে আসি!

উঁহু, মাথা নাড়ল কিশোর, ওদের সামনে যাওয়া যাবে না। আমাদের দেখলেই এখন গিয়ে বলে দেবে আংকেলকে। আংকেলেরও বিশ্বাস নেই। রেগেমেগে এসে হাজির হতে পারেন, আমাদের কান ধরে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। টিন থেকে চামচ দিয়ে আনারসের একটা টুকরো বের করে মুখে পুরল সে। চিবিয়ে গিলে নিয়ে বলল, তাছাড়া, আরও একটা কারণে ওদের সামনে যাব না এখন আমরা।

কি কারণ? গলা বাড়াল মুসা।

অন্য দু-জনও আগ্রহ নিয়ে তাকাল।

কেন, সন্দেহটা ঢোকেনি তোমাদের মাথায়? কিশোর বলল, টোডরাও হয়তো স্মাগলিঙে জড়িত। ওরা এখানে আসে স্মাগলারদের রেখে যাওয়া মাল সরিয়ে নিয়ে গিয়ে দেশের ভেতর চালান দিতে। টোড নাবিক। নৌকায় করে এখানে যাতায়াত করা তার জন্যে কোন ব্যপারই না। কি, খুব একটা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে?

না, মাথা নাড়ল জিনা, মোটেও অসম্ভব না। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। টোডরা চলে যাক, তারপর গিয়ে পাতালঘরে ঢুকব আমরা। দেখব, কিছু আছে কিনা। ব্যাটাদের শয়তানি বন্ধ করতেই হবে!

.

১১.

গেল না টোডেরা।

ফোকর দিয়ে মুখ বের করে দুর্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা করে ফেলল গোয়েন্দারা, কিন্তু টোডদের যাওয়ার কোন লক্ষণই দেখতে পেল না। চত্বরে এক-আধবারের জন্যে বেরোনো ছাড়া তেমন একটা বাইরে বেরোতেও দেখা গেল না ওদের। যেন ছুচো হয়ে গেছে, পাতালঘরের অন্ধকারে বসে থাকাটাই বেশি আরামের, দিনের আলো সহ্য করতে পারে না।

ইতিমধ্যে আরেকটা কাজ করে এসেছে রবিন। পাহাড়ে চড়ায় ওস্তাদ সে। তাই তাকেই পাঠিয়েছিল কিশোর, টোডরা কিসে করে এসেছে দেখে আসার জন্যে। এ পাহাড় সে পাহাড় করে ঘুরে ঘুরে একটা পাহাড়ের গোড়ায়। যেই নেমেছে, অমনি একটা পাথরের আড়ালে দেখতে পেয়েছে ছোট নৌকাটা।

প্রণালী দিয়ে ঢোকেনি টোডরা, সেজন্যেই জিনার নৌকাটা দেখতে পায়নি। তবে ওস্তাদ নাবিক বলতে হবে টোডকে। দ্বীপের যেখানে এনে নৌকা ভিড়িয়েছে, সেখানে আনাটা সত্যি কঠিন। ভাঙা জাহাজটার কাছাকাছিই, কিশোর যেখানে সন্দেহ করেছিল।

বিকেল পেরিয়ে গেল। আরেকটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই ছায়া নামতে শুরু করেছে পাহাড়ের গোড়ায়।

কিশোর বলল, মনে হচ্ছে রাতটা এখানেই কাঁটাবে ওরা।

বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে কোন লাভ হলো না, তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। যাদের যন্ত্রণায় পালালাম, তারাই এসে হাজির। ধুর!

গুহার ভেতরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। মোম জালল রবিন। বলল, চলো, ভয় দেখাই ব্যাটাদের।

মানে? ভুরু কুঁচকে তাকাল মুসা।

আছে তো পাতালঘরে। তোমার মত ওদেরও ভূতের ভয় থাকতে পারে।

রবিনের পরিকল্পনা কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছে কিশোর। মুচকি হাসল।

মুসা বুঝল না। খুলেই বলো না ছাই!

রবিন বলল, বুঝলে না? দুর্গের নিচে কিছু কিছু জায়গায় প্রতিধ্বনি খুব বেশি হয়, ভুলে গেছ? পাতালঘরের কাছে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করব আমরা। ভূতের ভয় দেখাব ওদের।

চটাস করে নিজের উরুতেই চাটি মারল মুসা, দারুণ আইডিয়া! এক্ষুণি চলো! ব্যাটাদের কলজে শুকিয়ে না দিয়েছি তো আমার নাম মুসা আমান নয়!

এখন না, মুচকি হাসল কিশোর, আরেকটু রাত হোক।

জিনা বলল, রাফিকে কি করব? ও তো গিয়েই ঘেউ ঘেউ শুরু করবে। ভূত যে নয়, বুঝে ফেলবে টোড। ভাববে, বুনো কুকুরটাই, মারতে বেরোবে।

ওকে সিঁড়ির মুখে পাহারায় রেখে যাব। স্মাগলারদের কেউ এলে সতর্ক করতে পারবে আমাদের।

আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক পর রওনা হলো ওরা। চলে এল দুর্গের চতুরে। টোডদের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। আগুন নেই, আলো নেই। পাতালঘরে নামার সিঁড়ির মুখের পাথরগুলো সরানো, তাতে বোঝা গেল নিচেই রয়েছে ওরা।

রাফি, একদম চুপ করে থাকবি, কড়া নির্দেশ দিল জিনা। কেউ এলে আমাদের হুঁশিয়ার করবি। মানুষ না দেখলে চেঁচাৰি না, খবরদার!

ও কি আর বুঝবে নাকি কিছু? কিশোর বলল, খরগোশ দেখলেও চেঁচানো শুরু করবে। একজনকে এখানে থাকা দরকার।

কে থাকবে? ভয় পেয়ে টোডরা কি করে, মজা দেখার লোভ সবারই। শেষে জিনা নিজেই বলল, তোমরাই যাও। আমি থাকি। রাফিকে একা একা ছেড়ে রাখতে ভরসা পাচ্ছি না আমি।

সিঁড়ি বেয়ে পাতালঘরে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। নিচে অনেক ঘর, কোনওটা সেলার, কোনওটা ডানজন। বদ্ধ বাতাসে একধরনের ভাপসা গন্ধ।

বড় একটা ঘরে ঢুকল ওরা। টর্চের আলোয় দেয়ালে গাথা লোহার সারি সারি আঙটা দেখা গেল। একসময় এটা বোধহয় জেলখানা ছিল, কিংবা টর্চার চেম্বার। দুর্ভাগা বন্দিদের ধরে এনে এখানে বন্দি করে রাখা হত, লোহার আঙটায় শেকল দিয়ে বেধে অমানুষিক অত্যাচার চালানো হত তাদের ওপর। মধ্যযুগীয় এসব বর্বতার ইতিহাস অনেক পড়েছে রবিন। মুসারও জানা আছে কিছু কিছু। তার মনে হতে লাগল, ভয়াবহ যন্ত্রণা পেয়ে মারা যাওয়া সে সব মানুষের প্রেতাত্মারা এখনও ঘুরে বেড়ায় পাতালের এসব ঘরে ঘরে, করিডরে। গায়ে কাঁটা দিল তার।

সঙ্গে টর্চ আছে। কিন্তু পারতপক্ষে সেটা জ্বালছে না কিশোর। প্যাসেজ ধরে যাওয়ার সময় দেয়ালে চক দিয়ে একে চিহ্ন দিয়ে রাখল, যাতে ফেরার। সময় অসুবিধে না হয়।

হঠাৎ কথার শব্দ কানে এল। আরেকটু আগে বাড়তেই একটা ফোকর। দিয়ে আলো চোখে পড়ল। সেই ঘরটায় আস্তানা গেড়েছে টোডরা, যেখানে সোনার বারগুলো খুঁজে পেয়েছিল তিন গোয়েন্দা।

ফিসফিসিয়ে মুসা বলল, আমি গরু।

মানে! চমকে গেল রবিন। ভাবল, ভূতের ভয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সহকারী গোয়েন্দার।

আমি গরুর ডাক ডাকব।

ও, তাই বলো। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। বেশ, আমি তাহলে ছাগল। কিশোর, তুমি? গাধা?

জন্তু-জানোয়ারের ডাক আমি ভাল পারি না। তবু দেখি, পারি কিনা।

একটা পাথরের থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে গরুর ডাক ডেকে উঠল মুসা। শব্দ শুনে সে নিজেই চমকে গেল। বিকট শব্দ হয়েছে বদ্ধ জায়গায়, সেই সঙ্গে প্রতিধ্বনি; মূল শব্দটাকে ভয়াবহ করে তুলেছে।

ফোকর দিয়ে তাকিয়ে আছে রবিন ও কিশোর। টোডদের প্রতিক্রিয়া দেখছে।

ভীষণ চমকে গিয়ে প্রায় ককিয়ে উঠল টেরি, মা, কিসের শব্দ!

তার কুকুরটা তার চেয়েও ভীতু। গিয়ে লুকাল ঘরের কোণে।

গরু, বলেই টোড নিজেও থমকে গেল। এখানে গরু আসবে কোত্থেকে।

মুসা সরে এল থামের আড়াল থেকে। সেখানে চলে গেল রবিন। মা-মা। করে উঠল ছাগলের মত। থামল না, ডেকেই চলল।

আরিসব্বোনাশ! চোখ বড় বড় করে ফেলল মিসেস টোড। এসব এল কোত্থেকে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল টোড। কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে মুখ।

কয়েকবার ডেকে চুপ হয়ে গেল রবিন।

কিশোরের গায়ে গুঁতো দিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করল মুসা। নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে।

 কিশোর ব্যাঁ-ব্যাঁ করে যে ডাকটা ডাকল, সেটা গাধায় শুনলেও চমকে যেত, এতটাই বিকৃত আর ভয়ঙ্কর, পিলে চমকে দেয়ার মত; এবং সত্যি সত্যি চমকেও দিল টোড পরিবারের।

শুধু ডাকাডাকি করেই থামল না কিশোর, এমন করে লাথি মারতে লাগল, মনে হচ্ছে সাংঘাতিক, রেগে গিয়ে মেঝেতে পা ঠুকছে সাংঘাতিক জানোয়ারটা।

ঘরের দরজার কাছে সরে এল মিসেস টোড। ভয়ে ভয়ে বলল, হেই হেই, যাহ, যাহ্!

ফিক করে হেসে ফেলল রবিন। কিন্তু তার হাসিটা শুনতে পেল না মিসেস টোড, কিশোরের চিৎকারে। নাকি স্বরে চেঁচিয়ে টেনে টেনে বলল গোয়েন্দাপ্রধান, সাঁব-ধাঁন! তারপর আবার গাধার ডাক, মেঝেতে পা ঠোকাঠুকি।  

লাফ দিয়ে গিয়ে ঘরের ভেতরে পড়ল মিসেস টোড। দড়াম করে লাগিয়ে দিল ভারি কাঠের দরজাটা। কাঁপা গলায় বলল, রোজ রাতেই যদি এই কাণ্ড চলে, এখানে থাকা যাবে না!

দাঁতাল শুয়োর রেগে গেলে যেমন করে তেমনি ভাবে ঘোৎ-ঘোৎ করে উঠল মুসা।

হা-হা করে হেসে ফেলল রবিন। ভীষণ প্রতিধ্বনি উঠল।

কিশোরও হাসছে। বলল, আর পারি না! চলো এখান থেকে! বেরোও!

বিকৃত হয়ে প্রতিধ্বনিত হলো তার কথা ও পারি না! পারি না। পারি না!…খান থেকে! খান থেকে! খান থেকে!…বেরোও! বেরোও! বেরোও।

সিঁড়ির ওপরে উঠেও তাদের হাসি থামল না।

সব শুনে জিনাও হেসে গড়িয়ে পড়ল।

গুহায় ফিরে চলল, ওরা। কিন্তু হাসি আর থামতে চায় না। কিছুই না বুঝে ঘউ ঘউ করল কয়েকবার রাফি।

আস্তে আস্তে কমে এল হাসি।

কিশোর বলল, ওরা যে আমাদের খুঁজতে আসেনি, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। স্মাগলারদের সঙ্গে জড়িত। এ কাজে সুবিধে হবে বলেই হয়তো মিসেস টোড চাকরি নিয়েছিল জিনাদের বাড়িতে।

এবার তো তাহলে বাড়ি ফেরা যায়, রবিন বলল।

চোরগুলোকে হাতেনাতে না ধরেই?

কথা বলতে বলতে পাহাড়ের চূড়ায় চলে এল ওরা। ফোকর দিয়ে গুহায়। নামবে। টর্চ জ্বালতে যাবে কিশোর, এই সময় তার হাত খামচে ধরল মুসা। ফিসফিস করে বলল, ওই দেখো!

সাগরের মাঝে একটা আলো, জ্বলছে নিভছে।

কিশোরের মনে হলো, কোন বোট কিংবা জাহাজ থেকে টর্চের সাহায্যে সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে। আবার বোধহয় পুরানো জাহাজের লকারে চোরাই মাল রেখে যাওয়া হয়েছে। সঙ্কেত দিচ্ছে টোডকে সে কথা জানানোর জন্যে।

অনেকক্ষণ ধরে চলল এই সঙ্কেত দেয়া।

এতক্ষণ কেন? রবিনের প্রশ্ন।

হয়তো এপাশ থেকে জবাব আশা করছে। না পেয়ে সঙ্কেত দিয়েই চলেছে।

আবার হাসতে শুরু করল মুসা, তাহলে জবাবের আশা আজ ওদের ছাড়তে হবে। মেরে ফেললেও জনাব বেঙ আজ আর গর্ত থেকে বেরোবে না।

একসময় থেমে গেল আলোর সঙ্কেত। আর জ্বলল না।

গুহায় ঢুকল গোয়েন্দারা।

কোন রকম অঘটন ঘটল না আর। নিরাপদে কাটিয়ে দিল রাতটা।

.

১২.

পরদিন সকালে নাস্তা খেতে বসেও প্রথমেই টোডদের কথা উঠল।

রেগে উঠল জিনা, বুড়িটা নাম্বার ওয়ান চোর! আমাদের ঘরের জিনিসপত্র সব ডাকাতি করে নিয়ে এসেছে, দেখোগে!

তা তো কিছু এনেছেই, জকুটি করল কিশোর। আন্টি এসে তাঁর ঘরের এ হাল দেখলে খুব কষ্ট পাবেন।

ভালমত একটা শিক্ষা দিয়ে দেয়া দরকার, গজগজ করতে লাগল মুসা।

হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন।

নৌকায় করে এনেছে, সেটা তো বোঝাই গেছে, বলল কিশোর। মালগুলো কোথায় রেখেছে দেখা দরকার। নিশ্চয় পাতালঘরে।

চলো, দেখে আসি।

ওরা যদি থাকে? মুনার প্রশ্ন।

আছে তো জানা কথাই, রবিন বলল। নজর রাখব। তারপর যেই দেখব সরেছে, অমনি নেমে যাব পাতালে।

বুদ্ধিটা মন্দ না, কিশোর বলল। চলো।

রাফিকে কি করব? জিজ্ঞেস করল জিনা।

এখানেই রেখে যেতে হবে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে সব ভজঘট করে দিতে পারে।

একা থাকবে? কেঁদেই মরে যাবে ও। এক কাজ করো, তোমরা যাও। আমি বরং ওর সঙ্গে থেকে যাই, আসলে গুহার মধ্যেও রাফিকে একা রেখে যেতে ভয় পাচ্ছে জিনা। যদি কোন কারণে ডাকতে শুরু করে কুকুরটা? আর তার ডাক শুনে এসে হাজির হয় টোড?

থাকবে? ঠিক আছে, থাকো।

দড়ি বেয়ে ফোকরের কাছে উঠে এল তিন গোয়েন্দা। বড় একট ঝোপে ঢুকে চোখ রাখল দুর্গের ওপর।

উফ, কি কাঁটার কাঁটারে বাবা! কনুই ডলতে ডলতে গুঙিয়ে উঠল মুসা, সব ছিলে ফেলেছে!

চুপ! সাবধান করল রবিন, বেঙের গোষ্ঠী বেরোচ্ছে।

একে একে বেরিয়ে এল তিন টোড। পাতালঘরে অমাবস্যার অন্ধকার। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় বেরিয়ে খুশি হয়েছে, ভাবভঙ্গিতেই বোঝা যায়।

এদিক এদিক তাকাতে লাগল ওরা। ডারবি রয়েছে মিসেস টোডের পা ঘেষে। পায়ের ফাঁকে ঢোকানো লেজ।

গরু-ছাগল খুজছে! হেসে ফেলল মুসা।

চুপ। আস্তে! সাবধান করল তাকে কিশোর, শুনে ফেলবে!

দু-তিন মিনিট কথা বলল মিসেস আর মিস্টার টোড, তারপর এগিয়ে গেল দুর্গের কিনারের দিকে, যেখান থেকে ভাঙা জাহাজটা দেখা যায়। টেরি গেল দেয়াল ধসে পড়া একটা ঘরের দিকে। ছাতও বেশির ভাগই নেই ওটার।

আমি টোডদের পিছে যাচ্ছি, কিশোর বলল। টেরি কি করে দেখো তোমরা।

ঝোপের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে গেল সে।

মুসা আর রবিনও ঝাৈপ থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে চলে এল, দুর্গের কাছাকাছি, টেরি দেখে ফেলার আগেই চট করে বসে পড়ল আরেকটা ঝোপের আড়ালে।

খোলা চত্বরে ছোটাছুটি করছে ডারবি। শিস দিতে দিতে ভাঙা ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল টেরি। দু-হাতে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে রেখেছে কয়েকটা গদি।

জিনাদের জিনিস! দাঁতে দাঁত চেপে বলল মুসা,সবচেয়ে ভালগুলো নিয়ে এসেছে!

দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা, বলে একটা মাটির ঢেলা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল রবিন। টেরি এবং ডারবির মাঝখানে পড়ে ভাঙল ওটা।

হাত থেকে গদিগুলো ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল টেরি। ভয় পেয়েছে।

আরেকটা ঢেলা নিয়ে আবার ছুঁড়ে মারল রবিন। নিশানা ঠিক হলো, পড়ল ডারবির ওপর। ঘেউক করে উঠে একলাফে গিয়ে সিঁড়ির গর্তে ঝাঁপ দিল কুকুরটা।

 আবার আকাশের দিকে তাকাল টেরি। তারপর চারপাশে তাকাতে লাগল। ঢিল কোনখান থেকে আসছে বুঝতে পারছে না।

মুচকি হাসল মুসা। বুদ্ধিটা ভালই করেছে রবিন। টেরি ওদের দিকে পেছন করতেই অনেক বড় একটা ঢেলা তুলে ছুঁড়ে মারল সে। টেরির পায়ের কাছে পড়ে ভাঙল ঢেলাটা।

অবাক হয়ে নিচের দিকে তাকাল টেরি। তাকে কিছু বোঝার সামান্যতম সময় না দিয়ে ঢিল ছুঁড়ল রবিন।

কাঁধে পড়ল টেরির। মা-গো! করে চেঁচিয়ে লাফ দিয়ে সরে গেল সে।

চিৎকার করে গরুর ডাক ডেকে উঠল মুসা।

আর সহ্য করতে পারল না টেরি। দুই হাত তুলে চিৎকার করতে করতে গিয়ে তার কুকুরটার মতই লাফ দিয়ে পড়ল সিঁড়িতে।

শেষ চিলটা ছুঁড়ল মুসা। নিখুঁত নিশানা। সিঁড়ির গর্তে গিয়ে পড়ল ওটা। ভেতর থেকে আর্তচিৎকার শোনা গেল। নিশ্চয় মাথায় পড়েছে টেরির।

জলদি! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন, এটাই সুযোগ!

একদৌড়ে দু-জনে গিয়ে চত্বর থেকে গদিগুলো কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলে এল ঝোপের কাছে।

ভেতরে কি আছে দেখে আসতে পারি, রবিন বলল। তুমি এক কাজ করো। সিঁড়ির মুখের কাছে গিয়ে বসে থাকো। টেরির মাথা দেখলেই গরু হয়ে যাবে। ব্যস, আর কিছু করা লাগবে না। মাটি ফেড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে চাইবে ও। আমি গিয়ে কুয়ার ভেতর দিয়ে পাতালঘরে নামব। দেখে আসি, কি কি জিনিস চুরি করেছে ধাড়ি বেঙগুলো।

আঙটা ধরে নামতে মোটেও অসুবিধে হলো রবিনের। এই কাজ আগেও একাধিকবার করেছে সে। দুর্গের নিচে নামা লাগতে পারে, এ জন্যে তৈরিই হয়ে এসেছে ওরা। কোমর থেকে টর্চ খুলে জ্বালল। রাতে যে ঘর থেকে ভয় দেখিয়েছে টোডদের, তার পাশের ঘরটায় এসে ঢুকল।

জিনিসপত্র কম আনেনি টোডেরা, তিনজনের সাধ্যে যা কুলিয়েছে, এনেছে। কম্বল, তৈজসপত্র, খাবার তো আছেই, হাতে করে আনা যায় দামী এরকম যা যা পেয়েছে নিয়ে এসেছে। বেশ কিছুদিন থাকার ইচ্ছে এখানে ওদের।

কুয়া থেকে উঠে এসে দেখল রবিন, সিঁড়ির মুখের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে মুসা। তাকে নিয়ে সরে চলে এল ঝোপের কাছে। জানাল, কি দেখে এসেছে।

ফিসফাস করে কথা বলছে ওরা, এই সময় সেখানে এসে হাজির হলো কিশোর। বলল, পাথরের আড়ালে নৌকা লুকিয়ে রাখে টোড। বের করে নিয়ে ভাঙা জাহাজটায় গেছে, বোধহয় ট্রাংকটা আনতে। তীরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে মিসেস টোড।

মুসা আর রবিনও জানাল, ওরা কি কি করেছে।

 শুনে হাসল কিশোর। তাহলে এটাই সুযোগ।

কিসের? ভুরু কোঁচকাল রবিন।

জিনিসগুলো নিয়ে আসার। মুখ বাঁকাল কিশোর, আস্ত চোর! কেন যে এগুলোকে জায়গা দিয়েছিলেন কেরিআন্টি দাঁড়াও, সব নিয়ে আসব। একটা জিনিসও রেখে আসব না।

মুসাকে আবার সিঁড়ির মুখে পাহারায় রেখে নিচে নেমে গেল কিশোর আর রবিন। টেরি আর তার ভীতু কুকুরটার ছায়াও চোখে পড়ল না। নিশ্চয় সিঁড়ির নিচে কোথাও লুকিয়ে বসে আছে।

ব্যাগে ভরে জিনিসগুলো এনেছে টোডেরা। সেই সব ব্যাগে ভরেই আবার দড়িতে বেধে কুয়া দিয়ে বের করে আনল গোয়েন্দারা। একটা জিনিসও রাখল না।

দুই টোড এখনও ফেরেনি। এখানে আর থাকার প্রয়োজন মনে করল না তিন গোয়েন্দা। জিনিসগুলো সব বয়ে নিয়ে এল ফোকরের কাছে। দড়িতে বেধে গুহায় নামাল।

সর্বনাশ করে দিয়েছিল শয়তানগুলো! ফুসতে লাগল জিনা। তবে তার রাগ বেশিক্ষণ থাকল না। টেরিকে কি ভাবে ভয় দেখিয়েছে রবিন ও মুসা, শুনে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল।

কিশোর বলল, ট্রাংকটাও রাখতে দেব না ওদেরকে। মুসা, চলো, দেখি। এনে থাকলে ওটাও কেড়ে আনব।

ফোকর দিয়ে আবার বেরোল দু-জনে দেখে, ট্রাংকটা দূর্গের দিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুই টোড! চত্বরের কাছে গিয়ে ওটা নামিয়ে রেখে এদিক ওদিক তাকাল মিসেল, টেরি গেল কোথায়?…টেরি। টেরি!

মায়ের ডাক শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল টেরি।

তোকে না বললাম এখানে থাকতে? নিচে কি করছিস?

এখানে থেকে মরব নাকি!

মরব নাকি মানে?

আবার সেই ভূতুড়ে গরু এসে হাজির! ডাকাডাকি করল, আমাদের ঢিল মারল… ভয়ানক জানোয়ার! ওরা কি ওপরে থাকতে দেয়?

ভুরু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে টোড, যেন বোঝার চেষ্টা। করছে পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি। গরু তোকে ঢিল ছুড়ল?

ছুঁড়লই তো, মিথ্যে বলছি নাকি? ডারবিকে জিজ্ঞেস করে দেখো। কি আর বলব তোমাকে, বাবা, একটা-দুটো না, হাজারে হাজারে গরু! একেক শিঙ কি! আট-দশ হাত করে লম্বা। দেখো না, ভয়ে ডারবিটা আর বেরোচ্ছেই না।

ভীতুর ডিমটাকে তো খামোকা খাওয়াস

এই, ডারবিকে কিছু বলবে না বলে দিলাম! রেগে উঠল মিসেস টোড। ওর কি দোষ? গরুর সঙ্গে কুকুর কখনও পারে নাকি?

না পারলে ওটাকে রাখার কি দরকার? ছেলের দিকে তাকাল আবার টোড, গদিগুলো কোথায়? নিচে রেখে এসেছিস?

রাখলাম আর কখন। সবে এনেছি, গর্তে নামব, এই সময় গরুগুলো এসে হাজির।

কোথায় ফেলেছিস? আশপাশে তাকাল টোড।

 এখানেই তো ছিল। ওরাই হয়তো নিয়ে গেছে!

গরুতে ঢিল ছোঁড়ে, গদি ছিনিয়ে নিয়ে যায়, একথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না, টোডও করল না। কেউ আছে এই দ্বীপে, আমি এখনও বলছি। সে-ই এই কাণ্ড করছে।

তা তো আছেই, ওই গরুগুলো

 চুপ, গাধা কোথাকার!

নিচ থেকে ডারবির করুণ চিৎকার শোনা গেল।

মিসেস টোড বলল, বেচারা! ওপরে আসতেও ভয় পাচ্ছে। এই ডারবি, ডারবি, আয়, আয়। কেউ কিচ্ছু করবে না।

কিন্তু মিসেস টোডের কথায় ভরসা করতে পারল না কুকুরটা। এল না ওপরে।

যাই, নিয়ে আসিগে। খাবারও আনতে হবে। এখানে বসেই খাব, নিচে নেমে গেল মিসেস টোড। একটু পর গর্তের মুখ দিয়ে প্রায় ছিটকে বেরোল সে। উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল, এই শোনো, কিছুই নেই কিছু না..সব নিয়ে গেছে

বললাম না, গরুগুলোর কাজ! টেরি বলল, তোমরা তো বিশ্বাস করতে চাও না…

তার কথায় কান দিল না তার বাবা। নেমে গেল গর্তের ভেতর। পেছনে গেল অন্য দুজন।

মুসার গায়ে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরেই উঠে দৌড় দিল কিশোর।

চত্বরে ফেলে রাখা ট্রাংকটা বয়ে নিয়ে এল দু-জনে। গুহায় এনে রাখল। এরপর কি ঘটে দেখার জন্যে আবার বাইরে বেরিয়ে এল কিশোর।

গর্ত থেকে বেরিয়ে এল টোড। ট্রাংকটা যেখানে ছিল সেদিকে চোখ পড়তেই হাঁ হয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, ডোরিয়া, দেখে যাও, ট্রাংকটাও নেই!

দেখে মিসেস টোডও হাঁ। টেরির ভঙ্গি দেখে তো মনে হলো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে।

তার মা বলল, দ্বীপে যে, মানুষ আছে, আর কোন সন্দেহ নেই। ভূতেরা দিনের বেলা বেরোয় না। জন, তোমার পিস্তলটা আছে?

আছে, পকেটে চাপড় দিল টোড।

এসো, পুরো দ্বীপ খুঁজে দেখব আজ। বের করেই ছাড়ব।

তাড়াতাড়ি গুহায় ঢুকে বন্ধুদের খবরটা জানাল কিশোর। গুহার মধ্যে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আপাতত আর কিছু করার নেই। রাফিকে চুপ থাকতে বলল জিনা।

খুঁজতে খুঁজতে গুহার ওপরে চলে এল টোডেরা।

টেরির গলা শোনা গেল, বাপরে বাপ, কি কাঁটার কাঁটা!

টোড বলল, ডোরিয়া, দেখো, এই ঝোপটায় কেউ বসেছিল! ঘাস দুমড়ে গেছে, দেখেছ? ডালও ভেঙেছে।

তাহলে সেই কেউটা এখন কোথায়?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না!

আস্তে আস্তে সরে গেল দুই টোডের কণ্ঠ।

যাক, এবারেও দেখতে পায়নি ফোকরটা। সবে শরীর ঢিল করে বসেছে গোয়েন্দারা, এই সময় ঘটল ঘটনাটা। ওপর থেকে ধুড়ুম করে এসে মেঝেতে পড়ল টেরি। ঝোপে ঢুকে খুঁজতে খুঁজতে ফোকরে পা দিয়ে ফেলেছিল সে। আর ঠেকাতে পারেনি। ঢালু সুড়ঙ্গ দিয়ে পড়েছে এসে গুহার ভেতরে। নরম বালিতে পড়েছে বলে রাফির মতই সে-ও ব্যথা পায়নি। তবে অবাক হয়েছে খুব।

বিমূঢ় অবস্থাটা কাটতে সময় লাগল তার। কিশোরদের এখানে দেখতে পাবে কল্পনাই করতে পারেনি। চিৎকার করে মাকে ডাকার জন্যে মুখ খুলতেই মুসার থাবা এসে পড়ল তার মুখে। চেপে ধরল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, টু শব্দ করলেই রাফিকে ছেড়ে দেব। তোমাকে খাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে আছে ও।

কথাটা বিশ্বাস করল টেরি। চিৎকার করল না। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে রাফির দিকে।

টেরির মুখ থেকে হাত সরিয়ে আনল মুসা।

সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল টেরি। মিন মিন করে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি করছ তোমরা?

তোমার মুণ্ডু কাটতে এসেছি! ধমকে উঠল জিনা। এটা আমাদের দ্বীপ, ইচ্ছে হলেই আসব, কিন্তু তোমরা এসেছ কোন সাহসে? কাকে বলে এসেছ?

 তার সঙ্গে সুর মিলিয়েই কড়া গলায় ধমক দিল রাফিও, খউ, অর্থাৎ, জবাব দাও!

এই, তুই থাম! বেঙগুলো শুনে ফেলবে!

ভয়ে কেঁচো হয়ে গেছে টেরি।

 দ্বীপে এসেছ কেন তোমরা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

তা তো জানি না, ভোঁতা গলায় জবাব দিল টেরি। বাবা আসতে বলল, এলাম।

দেখো, মিথ্যে বলে পার পাবে না। স্মাগলিঙের সঙ্গে জড়িত না তোমার বাবা?

বিস্ময় ফুটল টেরির চোখে। স্মাগলিঙ!

 হ্যাঁ, স্মাগলিঙ। চোরাচালান।

কি বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না। দেখো, আমাকে ছেড়ে দাও…

এহ, মামার বাড়ির আবদার! মুখ ভেঙচে বলল মুসা, ছেড়ে দাও! দিই, তারপর গিয়ে বলো বাপ-মাকে, পিস্তল নিয়ে তেড়ে আসুক…ওসব ঘ্যানর ঘ্যানর করে লাভ নেই, বেঙাচি, ছাড়া তোমাকে হবে না। এসেই যখন পড়েছ, এখানেই থাকতে হবে।

আমার বাবা আমাকে খুঁজে বের করবেই…

যেন তার কথায় সাড়া দিয়েই ডেকে উঠল টোড, টেরি, টেরি, কোথায় গেলি? এই টেরি!

জবাব দিতে যাচ্ছিল, রাফির ওপর চোখ পড়ে গেল টেরির। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে কুকুরটা। হাঁ করা মুখটা হাঁ-ই থেকে গেল তার, শব্দ আর বেরোল না। ঢোক গিলল সে।

খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করে সেখান থেকে সরে গেল টোড।

অনেকক্ষণ পরও যখন আর কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না, কিশোর। বলল, ট্রাংকে কি আছে এবার দেখতে হয়।

রবিন বলল, তালা কি করবে?

একটা পাথর তুলে নিল মুসা, এই তালা কিছু না।

কয়েক বাড়িতেই তালা দুটো ভেঙে ফেলল সে।

ডালা তুলল।

ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে হুড়াহুড়ি করে এগিয়ে এল সবাই, টেরি বাদে। এসবে তার কোন আগ্রহ নেই। মুখটাকে করুণ করে রেখেছে সে। মনে হচ্ছে, ধমক দিলেই ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে এখন।

ট্রাংকের একেবারে ওপরে রয়েছে একটা ছোটদের কম্বল, এমব্রয়ডারি করে তাতে সাদা খরগোশ আঁকা। টেনে বের করল ওটা কিশোর, নিচে কি আছে দেখার জন্যে। দেখে অবাক হয়ে গেল। এক এক করে জিনিসগুলো বের করে রাখল বালিতে।

দুটো নীল রঙের জার্সি, দুটো নীল স্কার্ট, একটা গরম কোট, এবং আরও কিছু জামা-কাপড়। কাপড়ের নিচে রয়েছে চারটে পুতুল আর একটা খেলনা– ভালুক।

এগুলোর মধ্যে করেই হেরোইন পাচার করে, মুসা বলল। দেখো কেটে, কাটলেই পেয়ে যাবে।

কিন্তু কিশোরের সন্দেহ হলো। টিপেটুপে দেখল। ভেতরে কিছু আছে বলে মনে হলো না। তবু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কেটে দেখল একটা পুতুল। অতি সাধারণ খেলনা। ভেতরে কিছুই নেই হীরা, মাদকদ্রব্য, কিংবা চোরাচালানি করে আনার মত কোন জিনিস, কিচ্ছু না।

অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল গোয়েন্দারা।

আনমনে নিচের ঠোঁটে বার দুই চিমটি কাটল কিশোর। বিড়বিড় করে বলল, এই জিনিস এত কষ্ট করে ভাঙা জাহাজে এনে লুকানোর অর্থ কি?

Categories: