২. গটমট করে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল মিসেস টোড

0 Comments

জিনার সেই দ্বীপ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ: জুলাই, ১৯৯৪

গটমট করে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল মিসেস টোড। চেঁচিয়ে কথা বলে সুখবরটা শোনাতে লাগল স্বামী আর ছেলেকে।

বসার ঘরে সোফায় বসে রইল ছেলেমেয়েরা। সবারই মুখ কালো। নীরবে তাকাচ্ছে একে অন্যের দিকে।

আব্বাটাকে যে দেখতে পারি না আমি, এ-জন্যেই! হঠাৎ ফুঁসে উঠল জিনা। কোন কথা কখনও শুনতে চায় না!

আসলে আন্টিকে নিয়ে খুব অস্থির হয়ে পড়েছেন তো, মুসা বলল। আমাদের কপালই খারাপ, নটার আগেই ফোন করেছেন। কোন আক্কেলে যে বেরিয়েছিলাম!

আব্বা তোমাকে কি বলেছে, বলো তো? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল জিনা।

বলেছেন, বেশি কষ্ট হলে বাড়ি চলে যেতে। আন্টি ভাল হলে আবার আসতে…

তুমি তো খালি আব্বাকে ভাল ভাল বললো, বোঝো এখন কার সঙ্গে বাস করি! শোনো, এখানে থেকে তোমাদের কষ্ট করার কোন দরকার নেই। চলে যাও। বেড়াতে এসে অযথা কেন অত্যাচার সহ্য করবে।

কি যে বলো না। তোমাকে একা বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যাব ভাবলে কি করে? যা-ই ঘটে ঘটুক, আমরা থাকছি। মাত্র তো দুটো হপ্তা, দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

না, যাবে না! এত শয়তান লোকের সঙ্গে থাকতে গেলে দুই হপ্তা দুশো বছরেও শেষ হবে না। বাড়ি সামলে রাখার জন্যে ওদেরকে জায়গা দিয়েছে তো আব্বা, রাখুক ওরা। তোমরা বাড়ি চলে যাও, আমিও আমার মত চলব।

ঘাবড়ে গেল কিশোর। খেপিয়ে দেয়া হয়েছে জিনাকে। কি করে বসবে এখন, তার ঠিক নেই।

বোকার মত কথা বোলো না। কিভাবে চললে ভাল হবে, সবাই মিলে আলোচনা করে একটা উপায় বের করে ফেলতে পারব।

দেখো, টিকতে পারবে না এখানে, চলে তোমাদের যেতেই হবে।…রাফি, চলো, ঘুরে আসি।

আমরাও যাব তোমার সঙ্গে, মুসা বলল।

বাধা দিল না জিনা।

সৈকতে এসে বসল ওরা।

গুম হয়ে আছে জিনা। মায়ের জন্যে দুঃখ, বাবার ওপর রাগ-অভিমান, টোডদের ওপর ঘৃণা, সব মিলিয়ে অস্থির করে তুলেছে তাকে। চিরকাল সুখে থেকে থেকে মানুষ, এসব সহ্য করতে পারছে না।

কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল কিশোর, আমরা চলে গেলে কি করার ইচ্ছে তোমার, বলো তো? কিছু একটা প্ল্যান তো নিশ্চয় করেছ।

না, বলব না। বললে আমাকে করতে দেবে না তোমরা।

কেন দেব না? রবিন বলল, খারাপ তো আর কিছু করবে না…

যদি করিই, তোমাদের কি? রেগে উঠতে গিয়ে সামলে নিল জিনা, সরি, ঝগড়া করতে চাই না। অহেতুক দাওয়াত দিয়ে এনে তোমাদের ছুটিটা পণ্ড করলাম।

পণ্ড হতে দিচ্ছি না, নিশ্চিন্ত থাকো, জোরগলায় বলল মুসা। দরকার হয় পিটিয়ে বের করব বেঙগুলোকে…বাড়িঘর যদি ঠিকঠাক রাখতে পারি আমরা, আংকেলের কিছু বলার থাকবে নাঃ..

ওই বাড়িটাতে ঢুকতেই ইচ্ছে করছে না আমার আর। বাইরেই ভাল।

চলো তাহলে, কিশোর বলল, দূরে কোথাও চলে যাই। তোমরা এখানে বসো, আমি খাবার নিয়ে আসি।

হুহ, গেলেই দেবে আরকি…

দেখোই না দেয় কিনা, উঠে বাড়ি রওনা হলো কিশোর।

রান্নাঘরে তখন হাসাহাসি চলছে, কথা বলছে তিন টোড। কিশোরকে ঢুকতে দেখেই গম্ভীর হয়ে গেল।

পাত্তাই দিল না কিশোর। ভারী গলায় বলল, স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিন। বেড়াতে যাব আমরা।

বা-বা, আব্দার! মুখ ঝামটা দিয়ে বলল মিসেস টোড। রাতের বেলা সব চুরি করে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলেছে, এখন এসেছে স্যান্ডউইচের জন্যে। শুধু রুটি আছে ওখানে, নিলে নাও, নইলে বিদেয় হও।

সোফায় শুয়ে আছে টেরি। হাতে একটা কমিকের বই। সুর করে বলে উঠল, কিশোর, বিশোর...

এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব, শয়তান ছেলে কোথাকার!

কিশোরকে ভয় পায় টেরি। ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল।

খেঁকিয়ে উঠল মিসেস টোড, মারো তো দেখি চড়, কত্তবড় সাহস!

মারলে ধরে রাখতে পারবেন না। বজ্জাত বানিয়েছেন, আবার বড় বড় কথা…

গলা খাঁকারি দিল এককোণে বসা মিস্টার টোড। দেখো ছেলে, তাকাও এদিকে...

আপনার দিকে কে তাকায়!

দেখো, তাকাও এদিকে, রেগে গেছে টোড। বসা থেকে উঠল।

বার বার তাকাও এদিকে, তাকাও এদিকেকরছেন কেন? বললাম না। তাকাব না। দেখার মত আহামরি কোন চেহারা নয়।

চেঁচিয়ে উঠল মিসেস টোড, খবরদার, মুখ সামলে…

মুখ সামলে আপনি কথা বলবেন, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল মহিলার দিকে।

কয়েক মুহূর্তের বেশি তার চোখে চোখে তাকিয়ে থাকতে পারল না মিসেস টোড। ছেলেটার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অস্বস্তিতে ফেলে দেয় তাকে। শান্তকণ্ঠে কথা বলে, কিন্তু জিভে যেন বিছুটির জ্বালা। সসপ্যান দিয়ে মাথায় একটা বাড়ি মারতে ইচ্ছে করছে তার, কিন্তু অতটা সাহস করল না। এই ছেলে বিপজ্জনক ছেলে।

কিশোরের মাথায় তো মারতে পারল না, টেবিলেই থ্রম করে সসপ্যান আছড়ে ফেলল মিসেস টোড।

আচমকা এই শব্দে ভাঁড়কে গিয়ে গোওও করে উঠল ডারবি।

 হাল্লো, ডার্টি! তীব্র ব্যঙ্গ ঝরল কিশোরের কণ্ঠে, আছিস কেমন? গোসল করানো হয়েছে তোকে? মনে তো হচ্ছে না…

ওর নাম ডার্টি নয়! ঝাঁঝিয়ে উঠল মিসেস টোড।

ধুয়েমুছে গন্ধ দূর করুন, ডারবিই বলব। যতক্ষণ গন্ধে বমি আসবে, ততক্ষণ ডাটি…যাকগে, ফালতু কথা বলার সময় নেই। আপনি ব্যস্ত, বুঝতে পারছি। ঠিক আছে, স্যান্ডউইচই তো কটা, লাগবে না। বাইরে থেকেই কিনে খেয়ে নেব। তবে রাতের খাওয়াটা যেন ভাল হয়, বলে দিলাম।

বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ঘুরল কিশোর। শিস দিতে দিতে এগোল দরজার দিকে। বেরিয়ে যাবে, ঠিক এই সময় আবার বলে উঠল টেরি, কিশোর, বিশোর…

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল কিশোর, কি বললে!

কুঁকুড়ে গেল টেরি। গোওও করে উঠল ডারবি।

বরফের মত শীতল কণ্ঠে বলল কিশোর, বলো তো আবার শুনি?

কিন্তু আর বলার সাহস করল না টেরি। কুকুরটাও ভয় পাচ্ছে। কিশোরকে। মিসেস টোড চুপ। মিস্টার টোড স্তব্ধ।

সবার ওপর একবার করে কড়া নজর বোলাল কিশোর। মিস্টার পারকার থাকার অনুমতি দিয়েছেন বলেই সাত খুন মাপ হয়ে যায়নি; ওদের সঙ্গে খারাপ। আচরণ করলে ওরাও ছাড়বে না, বুঝিয়ে দিল এটা। তারপর যেন কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গিতে আবার শিস দিতে দিতে বেরিয়ে এল।

বন্ধুদেরকে সব জানাল সে।

জিনা বলল, কিন্তু এভাবে মুখ কালাকালি করে বাড়িতে বাস করা যায়!

সারাটা দিন চুপচাপ রইল সে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তার মুখে। হাসি ফোঁটাতে পারল না তিন গোয়েন্দা।

কিশোর বলল, জিনা, চলো, তোমার দ্বীপ থেকে ঘুরে আসি।

মাথা নাড়ল জিনা। ভাল লাগছে না। বাড়ির কাছাকাছি থাকতে চাই। আব্বা আবার ফোন করতে পারে। বুড়িটাকে ধরতে দেব না। ধরলেই সাতখান করে লাগাবে আব্বার কাছে।

চায়ের সময় বাড়ি ফিরল ওরা। রুটি, মাখন আর জ্যাম দিল ওদেরকে মিসেস টোড, কেকটেক কিচ্ছু না। রুটিও এত কম, শুধু ওদের চারজনেরই হবে, রাফির জন্যে নেই। দুধ টক হয়ে গেছে, খাওয়া গেল না। চায়ে যে মিশিয়ে খাবে, তারও উপায় নেই। বাধ্য হয়ে দুধ ছাড়াই চা খেল ওরা।

জানালায় দেখা দিল টেরি। হাতে একটা বাসন। বলল, এই যে, কুত্তাটার খাবার।

জানালার নিচে ঘাসের ওপর ওটা নামিয়ে রেখে পালাল সে।

মাংসের গন্ধ পেয়ে ছুটে বেরোল রাফি।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল জিনা। যাসনে, রাফি, যাসনে!

বেরিয়ে দেখল বাসনের মাংস শুকছে কুকুরটা।

খেয়ে ফেলিসনি তো!

 জানালা দিয়ে রবিন বলল, না, খায়নি। কেবল এঁকেছে। আমি দেখেছি।

জিনার পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছে কিশোর। বাসনটা তুলে নিয়ে শুকল। কাঁচা মাংসের গন্ধ। আর কোন গন্ধ পাওয়া গেল না।

রবিন আর মুসাও বেরোল।

খাইছে! মুসা জিজ্ঞেস করল, বিষটিষ দেয়নি তো?

দাঁড়াও, দেখি। গলা চড়িয়ে ডাক দিল কিশোর, ডারবি! ডারবি!

লেজ নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এল ছোট্ট কুকুরটা। মাংস দেখাতেই দৌড়ে আসতে লাগল।

আরেক দরজা দিয়ে ছুটে বেরোল টেরি। ডারবি, যাবি না, ডারবি! খবরদার, ওই মাংস খেতে দেবে না ওকে!

কেন দেব না? বলো, কেন দেব না?

 ও মাংস খায় না। কেবল কুকুরের বিস্কুট।

মিথ্যে কথা! চেঁচিয়ে উঠল জিনা, কালও ওকে মাংস খেতে দেখেছি। এখনও তো মাংস দেখে ছুটে এল!

হঠাৎ একটান দিয়ে কিশোরের হাত থেকে বাসনটা কেড়ে নিয়ে দৌড় দিল টেরি। রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

পেছনে দৌড় দিতে গেল মুসা, হাত ধরে তাকে থামাল কিশোর। যেয়ো না। গিয়ে দেখবে আগুনে ফেলে দিয়েছে। ওই মাংস আর পাবে না।

নিশ্চয় বিষ দিয়েছিল। শিউরে উঠল জিনা।

ইঁদুরের বিষটিষ হবে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। যাকগে, ভয় পেয়ো না। মুখে তো আর দেয়নি রাফি।

কিন্তু দিতে তো পারত..আবার খাওয়ানোর চেষ্টা করবে ওরা..

আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। শুধু হুমকি দিয়েছে ভেবেছিলাম। কিন্তু সত্যিই যে দেবে ভাবিনি।

আমাদেরও খাইয়ে দেবে না তো! শঙ্কিত হয়ে পড়েছে রবিন।

কুকুরকে যখন দিয়েছে, মানুষকেও দিতে পারে:

অত সাহস করবে না। চার-চারজন মানুষকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে, অতই সোজা!

.

০৬.

রাত হলো।

অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ল মুসা। বলল, রাতে খেতে দেবে বলে তো মনে হয় না। কিশোর, আজও কি চুরি করতে হবেনাকি?

যতই কঠোরতা দেখাক, গালাগাল করুক, আরেকবার টোডের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। ভয় পেয়েছে, তা নয়, আসলে বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ করেই রাগ হতে লাগল নিজের ওপর। জিনাদের বাড়ি মানে ওদেরও বাড়ি, টোডদের চেয়ে এখানে তাদের অধিকার অনেক অনেক বেশি, ওদের ভয়ে চুরি করতে যায় কেন সে? খাবারের জন্যে অনুরোধই বা করতে যায় কেন?

উঠে দাঁড়াল সে, রাফি, আয় তো আমার সঙ্গে।

আমি আসব? জিজ্ঞেস করল মুসা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আজ বেঙের বাচ্চার নাক ফাটিয়ে দেব।

না, তুমি থাকো। নাক ফাটানোর সময় এখনও হয়নি।

প্যাসেজ ধরে রান্নাঘরের দিকে এগোল কিশোর। রেডিও বাজছে। তাই ঘরের কেউ কিশোরের পায়ের আওয়াজ শুনল না। সে দরজায় গিয়ে দাঁড়ানোর আগে জানতে পারল না কিছু। সবার আগে চোখ পড়ল টেরির। দেখে দরজায় কিশোর, তার পেছনে রাফি।

এ বিশাল কুকুরটাকে বাঘের মত ভয় পায় সে। তাকে দেখে রাফি ঘাউ ঘাউ করে উঠতেই লাফ দিয়ে নেমে গিয়ে সোফার পেছনে লুকাল।

রেডিও অফ করে দিয়ে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল মিসেস টোড, কি চাই?

রাতের খাবার দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন?

রুটি আর কিছু পনির পাবে, ব্যস, আর কিছু না। নিয়ে যাও।

কেন, আপনার বাবার টাকায় কেনা খাবার, ভাল কিছু দিতে এত কষ্ট হয়?

ক্ষণিকের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল মিসেস টোড। চেঁচিয়ে উঠল, গাল দিচ্ছ কোন সাহসে!

কথা না শুনলে আরও খারাপ কিছু করব, কোনও বয়স্ক মহিলার সঙ্গে এতটা অভদ্র আচরণ জীবনে করেনি কিশোর। সহ্যের শেষ সীমায় চলে গেছে সে। রাফি, খেয়াল রাখ। সোজা কামড়ে দিবি, বলে রাখলাম তোকে।

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল রাফির চেহারা। গরগর করে গজরাতে লাগল।

জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করল না কিশোর, মৃদু শিস দিতে দিতে এগোল ভাঁড়ারের দিকে। জানে তার এই আচরণ আরও খেপিয়ে দেয় মিসেস টোডকে, সেজন্যেই আরও বেশি করতে লাগল এরকম। বাহ, ভাড়ার কি করে বোঝাই করে রাখতে হয় আপনি জানেন, মিসেস টোড। মুরগীর রোস্ট। আহ, গন্ধেই পানি এসে যাচ্ছে জিভে। মনে হচ্ছে কত বছর খাই না। নিশ্চয় আজ সকালে জবাই করেছে মিস্টার টোড। অনেক কঁক-কঁক শুনেছি। আরে, টমেটো! চমৎকার! গাঁয়ের সবচেয়ে ভালটা নিয়ে আসা হয়েছে, বুঝতে পারছি। আরি সব্বেনাশ, আপেল-পাইও আছে। আপনি সত্যি ভাল রাঁধেন মিসেস টোড, স্বীকার করতেই হবে।

বড় একটা ট্রে নিয়ে এক এক করে তাতে পাত্রগুলো তুলতে শুরু করল সে।

চিৎকার করে বলল মিসেস টোড, জলদি রাখো! ওগুলো আমাদের খাবার!

ভুল করলেন, মোলায়েম স্বরে বলল কিশোর। এগুলো আমাদের খাবার। আজ সারাদিন খাওয়াটা ভাল হয়নি, রাতেও না খেয়ে থাকতে পারব না।

দেখো ছেলে, এদিকে তাকাও!এত সুস্বাদু খাবারগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে ঘোৎ-ঘোৎ করে উঠল মিস্টার টোড।

আপনার দিকে তাকাব? কেন? যেন সাংঘাতিক অবাক হয়েছে। কিশোর, এমন কি মহামানব হয়ে গেছেন আপনি? শেভ করেছেন? গোসল করেছেন? মনে তো হয় না। না, মিস্টার টোড, আপনার দিকে তাকানোর রুচি হচ্ছে না।

বাকহারা হয়ে গেল মিস্টার টোড। একটা ছেলের জিভে যে এতটা ধার থাকতে পারে, কল্পনাই করেনি। আরও দু-বার আনমনেই বিড়বিড় করল, দেখো, এদিকে তাকাও,এদিকে তাকাও!

উফ, আবারও সেই একই কথা! অসহ্য! আচ্ছা মিস্টার টোড, দুনিয়ায় এত নাম থাকতে আপনার নাম টোড রাখতে গিয়েছিল কেন? টোড কাকে। বলে জানেন তো? রেঙ। তা-ও ভাল জাতের হলে এককথা ছিল, গড়িয়ে গড়িয়ে যেগুলো চলে সেগুলো:

চুপ করো পাজি ছেলে কোথাকার! আর সহ্য করতে না পেরে ধমকে উঠল মিসেস টোড।

কিশোরকে কিছু বলতে হলো না, ঘাউ করে বিকট হাঁক ছাড়ল রাফি।

চমকে উঠে পিছিয়ে গেল মিসেস টোড। কণ্ঠস্বর নরম করে বলল, সব নিয়ে গেলে আমরা কি খাব, বলো?

কেন, রুটি আর পনির রয়েছে না, যেগুলো আমাদের জন্যে রেখেছিলেন। তাই খেয়ে নিন।

কুকুরের কথা ভুলে গিয়ে একটা চামচ তুলে কিশোরকে বাড়ি মারতে গেল মিসেস টোড।

আবার ঘাউ করে লাফিয়ে এসে সামনে পড়ল রাফি। কামড়ে দিতে গেল।

বাবাগো! বলে লাফ দিয়ে সরে গেল মিসেস টোড। কি শয়তান কুত্তারে বাবা! আরেকটু হলেই আমার হাত কেটে নিয়েছিল!

আপনাকে তো বলেছি, গোলমাল করবেন না, করছেন কেন?

দাঁড়াও, এমন শিক্ষা দেব একদিন.. ফোঁস ফোঁস করতে লাগল মিসেস টোড।

চেষ্টা তো আজও কম করেননি, পেরেছেন? আজকে মাপ করে দিলাম, আবার যদি এরকম করেন, ওই যে বলেছি, সোজা পুলিশের কাছে যাব।

আগের বারের মতই পুলিশের কথায় ভয় পেয়ে গেল মহিলা। চট করে একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে পিছিয়ে গেল।

সন্দেহ হলো কিশোরের, কোন অপরাধ করে এসে এখানে লুকায়নি তো লোকটা? নইলে পুলিশের কথা শুনলেই ঘাবড়ে যায় কেন? আসার পর থেকে একটিবারের জন্যে ঘরের বাইরেও যায়নি, এটাও সন্দেহজনক।

খাবারের ট্রে হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। পেছনে রাফি; খুব হতাশ হয়েছে কারও পায়ে একটা অন্তত কামড় বসাতে পারেনি বলে।

যুদ্ধজেতা বীরের ভঙ্গিতে বসার ঘরে ঢুকল কিশোর। ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, এসো, দেখে যাও, কি নিয়ে এসেছি।

সব কথা শুনে হুল্লোড় করে উঠল সবাই।

রবিন বলল, সাহস আছে তোমার, কিশোর। ওই মহিলাটার সামনে যেতেই ভয় করে আমার।

ভয় কি আমারও কম করছিল। কেবল সঙ্গে রাফি থাকাতেই পার হয়ে এলাম।

ছুরি-চামচ-প্লেটের অভাব হলো না। সাইডবোর্ড থেকে বের করে আল জিনা। চায়ের সময় খাওয়ার পর রুটি বেঁচে গিয়েছিল, তারপরেও রান্নাঘর থেকে বড় আরেকটা নিয়ে এসেছে কিশোর। কারোরই কম পড়ল না, এমন কি রাফিরও পেট ভরল।

খাওয়ার পরই হাই তুলতে শুরু করল রবিন। আমি আর বসে থাকতে পারছি না।

আজকাল বড় বেশি ঘুমকাতুরে হয়ে পড়েছ তুমি, রবিন, অভিযোগ করল মুসা।

কি আর করব, বলো, হেসে বলল রবিন। সারাদিন থাকি খাবারের চিন্তায়। কখন পাব, কখন পাব এই টেনশনেই শরীর হয়ে থাকে ক্লান্ত। খাওয়ার পর আর থাকতে পারি না।

বিষণ্ণকণ্ঠে জিনা বলল, তোমাদের আসতে বলে এবার ভুলই করলাম…

সববারই তো শুদ্ধ হয়, এবার নাহয় একটু ভুল হলোই, পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বলল রবিন, তাছাড়া তুমি তো আর জানতে না আন্টির শরীর এতটা খারাপ হয়ে যাবে।

শুতে গেল ওরা। গোয়েন্দারা তাদের ঘরে, জিনা তার ঘরে। রাফি শুয়ে থাকল জিনার বিছানার কাছে। কান পেতে রইল সন্দেহজনক শব্দ শোনার জন্যে। টোডদেরকে শুতে যেতে শুনল সে। দরজা বন্ধ হতে শুনল। ডারবি গোঙলি একবার, তারপর সব নীরব।

থুতনি নামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল রাফি। তবে একটা কান খাড়াই রইল ঘুমের মধ্যেও। টোড পরিবারকে একবিন্দু বিশ্বাস করে না সে।

রাতে তাড়াতাড়ি শুয়েছে, পরদিন খুব সকালে বিছানা ছাড়ল। ছেলেমেয়েরা। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। সুন্দর দিন। আকাশের রঙ ফ্যাকাসে নীল, মাঝে মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে গোলাপি মেঘ। সাগর শান্ত, আকাশের মতই নীল। মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র ধোপাখানা থেকে ধুয়ে এনে বিছানো হয়েছে বিশাল এক নীল চাদর।

নাস্তার আগে সাগরে গোসল করতে গেল ওরা। বাড়ি ফিরে এল সাড়ে আটটার মধ্যে। আগের দিনের মত যদি নটার আগেই ফোন করেন মিস্টার পারকার, তাহলে যাতে ধরতে পারে। আজ আর মিসেস টোডকে ফোন ধরার সুযোগ দিতে চায় না।

মহিলাকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল কিশোর, আংকেল ফোন করেছেন?

না, মেজাজ দেখিয়ে বলল.মিসেস টোড। সে আশা করেছিল, আজও আগেই ফোন ধরে ফেলবে। পারল না বলেই এই রাগ।

নাস্তা দিতে হবে। ভাল জিনিস। আংকেলকে যাতে বলতে পারি ভাল খাবারই খাওয়ানো হচ্ছে আমাদের।

ছেলেটাকে বিশ্বাস নেই। খারাপ কিছু দিলে সত্যি বলে দিতে পারে। বানিয়েও বলতে পারে অনেক কিছু। তাই শুকনো রুটি আর মাখন দেয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করতে হলো মিসেস টোডকে।

খানিক পরেই রান্নাঘর থেকে মাংস ভাজার গন্ধ পেল কিশোর।

মাংস, ডিম ভাজা, টমেটোর সালাদ আর রুটির ট্রে ধাম করে টেবিলে নামিয়ে রাখল মিসেস টোড। মুচকি হাসল শুধু কিশোর, কিছু বলল না। যত খুশি মেজাজ দেখাক, খাবার না দিয়ে তো পারল না।

টেরি ঢুকল আরেকটা ট্রে হাতে। তাতে চায়ের সরঞ্জাম।

বাহ, এইতো লক্ষ্মী ছেলে, হেসে বলল কিশোর।

বিড়বিড় করে কি যেন বলল টেরি, বোঝা গেল না। মায়ের মতই আছাড় দিয়ে ট্রে রাখল টেবিলে। ঝনঝন করে উঠল কাপ-পিরিচ। এই শব্দ সহ্য করল না রাফি, হউক! করে ধমক লাগাল।

প্রায় উড়ে পালাল টেরি।

খবর শোনার জন্যে অস্থির হয়ে আছে জিনা। খাবারের দিকে নজর নেই। তার প্লেটে মাংস, ডিম বেড়ে দিল কিশোর।

খাওয়ার মাঝপথে বাজল টেলিফোন। হাতের চামচটা প্লেটে ফেলে দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে গেল জিনা। দ্বিতীয়বার রিঙ হওয়ার আগেই ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার। আব্বা?…আম্মার খবর কি?

শুনল ওপাশের কথা।

তিন গোয়েন্দাও খাওয়া থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

তাই নাকি? জিনা বলল, উফ, বাঁচলাম। আম্মাকে বোলো, তাকে দেখার জন্যে পাগল হয়ে আছি আমি! তুমি তো আবার ভুলে যাবে, বলবে না কিছু! বলবে কিন্তু বলে দিলাম! আব্বা, আমি আসতে চাই, কিছু হবে?

আবার ওপাশের কথা শুনতে লাগল সে।

শোনার পর আস্তে নামিয়ে রাখল রিসিভার।

রবিন বলল, নিশ্চয় যেতে মানা করেছেন?

মাথা ঝাঁকাল জিনা। আবার টেবিলে এসে বসল। আম্মার অপারেশন হয়েছে। ব্যথা নেই। ডাক্তাররা বলছে, দিন দশেকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে। আব্বা আম্মাকে নিয়েই একবারে আসবে।

যাক, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর, এতদিনে একটা সুখবর পাওয়া গেল।

কিন্তু কুখবর যে ঘাড়েই চেপে আছে এখনও, মুখ বাঁকাল মুসা। বেঙ পরিবার। দশটা দিন ওদের সহ্য করব কি ভাবে?

.

০৭.

 জিনা ফোন ধরার সময় কাছেই ছিল মিসেস টোড। সব শুনল। মিসেস পারকার আসতে আসতে আরও দিন দশেক লাগবে। এ কদিন নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবে এ-বাড়িতে।

হঠাৎ করেই যেন রাক্ষুসে খিদে পেয়ে বসল জিনাকে। এতক্ষণ কেবল চামচ নাড়াচাড়া করছিল, এখন গপ গপ করে গিলতে শুরু করল।

আমার যে কি ভাল লাগছে। আবার হাসি ফুটেছে তার মুখে।

এরপর যে কথাটা বলল জিনা, সেটা আর ভাল লাগল না কিশোরের।

জিনা বলল, আম্মা ভাল হয়ে যাচ্ছে, টোডের গোষ্ঠীকে আর ভয় পাই না আমি। তোমরা রকি বীচে ফিরে যাও, খামাকা ছুটিটা নষ্ট কোরো না। আমি আর রাফিই সামলাতে পারব ওদের।

গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর, দেখো, জিনা, এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। একবার কিছু ঠিক করলে তুমি যেমন না করে ছাড়ো না, আমিও ছাড়ি না, ভাল করেই জানা আছে তোমার। আমাকে কিন্তু রাগিয়ে দিচ্ছ।

বেশ, জিনা বলল, তাহলে আমি যা ঠিক করেছি তাই করব। বাড়ি না যেতে চাইলে এখানেই থাকো, আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আমি যে প্ল্যান করেছি, সেটা আমার একার। তোমরা এতে থাকছ না।

কি প্ল্যান তোমার? বলতে অসুবিধে কি? আমাদের বিশ্বাস করো না?

করি। কিন্তু বললে আমাকে করতে দেবে না, ঠেকাতে চাইবে।

তাহলে তো আরও বেশি করে শোনা-দরকার, শঙ্কিত হয়ে উঠল কিশোর। জিনাকে বিশ্বাস নেই, কারও ওপর রেগে গেলে যা খুশি করে বসতে পারে।

কিন্তু কোনভাবেই জিনার মুখ থেকে তার প্ল্যান সম্পর্কে একটা কথা আদায় করা গেল না।

গোপনে তার ওপর নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

জিনাও কম চালাক নয়। অস্বাভাবিক কিছুই করল না। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে সৈকতে বেড়াল, সাঁতার কাটল, খেলল। তার মায়ের শরীর ভাল হওয়ার খবর শুনেছে, আজ তার মন ভাল। দ্বীপে যাওয়ার কথা বলল একবার মুসা, এড়িয়ে গেল জিনা। তাকে আর চাপাচাপি করা হলো না এ-ব্যাপারে।

দিনটা ভালই কাটতে লাগল। বাড়ি গিয়ে খাবারের জন্যে মিসেস টোডের সঙ্গে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হলো না কারও, তাই বেকারি থেকে স্যান্ডউইচ কিনে খেল।

বিকেলে জিনা বলল, বাজারে যেতে হবে। আমি কয়েকটা জিনিস কিনব। চায়ের সময় হয়েছে, তোমরা বাড়ি যাও। আমি যাব আর আসব।

আমিও যাব তোমার সঙ্গে। রাফিকে নিয়ে রবিন আর মুসা চলে যাক। তিনজনে মিলে ভালই সামলাতে পারবে মিসেস টোডকে।

না, আমি একা যাব। তোমরা যাও।

শেষ পর্যন্ত সবাইকে সঙ্গে নিতে বাধ্য হলো জিনা। কারণ, কিশোর। তাকে একা যেতে দেবে না, ওদিকে মুসা আর রবিনও মিসেস টোডের মুখোমুখি হতে রাজি নয়।

এক একটা দোকানে ঢুকে টর্চের জন্যে নতুন ব্যাটারি কিনল জিনা। দুই বাক্স দিয়াশলাই, আর এক বোতল মেথিলেটেড স্পিরিট কিনল।

এসব কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।

কাজে লাগে না এসব? এড়িয়ে গেল জিনা, দরকারী জিনিস।

জিনার কেনাকাটা এ-পর্যন্তই। বাড়ি ফিরে এল ওরা। অবাক হয়ে দেখল, টেবিলে চা দেয়াই আছে। যদিও আহামরি কিছু নয়-রুটি, জ্যাম আর চা, তবু আছে তো। দেয়ার জন্যে যে মিসেস টোডকে কিছু বলতে হয়নি এতেই খুশি ওরা। যা পেল খেয়ে ফেলল।

সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি নামল। ঘর থেকে বেরোনোর উপায় নেই। বসে বসে কেরম খেলতে লাগল ওরা। কেরিআন্টির খবর শুনে মন অনেকটা হালকা ওদের।

এক সময় উঠে গিয়ে বেল বাজাল কিশোর।

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা, বেল বাজালে কেন?

মিসেস টোডকে ডাকলাম, খাবার দিতে বলব।

কিন্তু তার ঘণ্টার জবাব দিতে এল না কেউ।

আবার বাজাল সে। আবার। যতক্ষণ না রান্নাঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল মিসেস টোড। মুখ কালো করে, চোখ পাকিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল সে। বেল বাজাচ্ছ কেন? তোমার বেলের জবাব দিতে যাচ্ছে কে?

আপনি, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর, আর কে আছে বাড়িতে? খাবার দিন। ফালতু জিনিস আনলে ভাল হবে না। কাল রাতে কাউকে কামড়াতে পারেনি বলে খুব বিরক্ত হয়ে আছে রাফি।

আজ যদি কিছু করতে আসো রান্নাঘরে…আমি..আমি…

কি করবেন? পুলিশে খবর দেবেন তো? আমিও সেটাই চাইছি। পুলিশকে বেশ কিছু কথা বলার আছে আমার। ডাকবেন নাকি এখনই?

চোখের দৃষ্টিতে কিশোরকে ভস্ম করে দেয়ার চেষ্টা চালাল যেন মিসেস টোড, ব্যর্থ হয়ে ক্ষুব্ধ আক্রোশে হাত মুঠো করে ফেলল। বিড়বিড় করে কি বলতে বলতে, বোধহয় তাকে অভিশাপ দিতে দিতেই চলে গেল রান্নাঘরে। বাসন-পেয়ালা আছড়ানোর শব্দ পাওয়া গেল বসার ঘর থেকেও।

বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর।

আগের দিনের মত এতটা ভাল খাবার পেল না ওরা, তবে তেমন খারাপও না। ঠাণ্ডা মাংস, পনির আর খানিকটা পুডিং। রাফির জন্যেও খানিকটা রান্না করা মাংস এনে দিল মিসেস টোড।

তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল জিনার দৃষ্টি। কড়া গলায় বলল, ওটা লাগবে না, নিয়ে যান। বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন তো? আপনাকে বিশ্বাস নেই…

না, থাক, বাধা দিল কিশোর, নিতে হবে না। কাল এই মাংস কেমিস্টের কাছে নিয়ে যাব পরীক্ষা করাতে। দেখি, কি জিনিস মেশানো আছে ওতে। তারপর পুলিশের কাছে যাওয়ার আরও একটা ছুতো পেয়ে যাব।

একটা কথা বলল না মিসেস টোড। কারও দিকে তাকালও না। নীরবে বাসনটা তুলে নিয়ে চলে গেল।

খাইছে! বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মুসা, কি ভয়ঙ্কর মেয়েমানুষরে বাবা?

মেঘ জমেছে জিনার মুখে। রাফিকে কাছে টেনে নিতে নিতে বলল, সাংঘাতিক অবস্থা! রাফিকে তো মেরে ফেলবে! কতক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখব!

এই ঘটনা দিল ওদের সন্ধ্যাটাকে মাটি করে। .

খেলা তো নয়ই, আলাপ-আলোচনাও আর তেমন জমল না। হাই তুলল কিশোর। ঘড়ি দেখে বলল, রাত দশটা। বসে থেকে লাভ নেই। ঘুমাতে যাই।

সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করেছে, সাঁতার কেটেছে, হাঁটাহাঁটি করেছে, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল সবাই, এমন কি কিশোরও।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। মনে হলো, কোন একটা শব্দ শুনেছে। সব চুপচাপ। মুসা আর রবিনের নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছে। কেন ঘুমটা ভাঙল? টোডদের কেউ শব্দ করেছে? না, তাহলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত রাফি। তাহলে?

বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ল জিনার কথা, প্ল্যান করেছে! লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল তার ঘরের দিকে।

দরজা খোলা। জিনা, জিনা বলে ডাকল সে। জবাব নেই। উঁকি দিল ঘরে। খালি ঘর। খুব অল্প পাওয়ারের একটা সবুজ আলো জ্বলছে। জিনাও নেই, রাফিও না।

আবার দৌড়ে ঘরে ফিরে এল কিশোর। ডেকে তুলল মুসা আর রবিনকে।

 ঘুমজড়িত কণ্ঠে মুসা বলল, আবার কি হলো? টোডের মুখে তরকারি ফেলেছ?

জলদি ওঠো! জিনা নেই ঘরে!

গেল কোথায়? লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল রবিন।

সেটা তো আমারও প্রশ্ন। তোমরা এসো। আমি ওর ঘরে গিয়ে খুঁজে দেখি।

সুইচ টিপে উজ্জ্বল আলো জ্বালল কিশোর। বালিশে পিন দিয়ে আটকানো চিঠিটা চোখে পড়ল। তাড়াতাড়ি খুলে আনল সেটা। জিনা লিখেছে?

কিশোর,

রাগ কোরো না। রাফিকে নিয়ে আর ঘরে থাকার সাহস পেলাম না। ওর কিছু হলে যে আমি বাঁচব না তোমরা জানো। মিসেস টোডকে বিশ্বাস নেই। রাফিকে মেরে ফেলবে ও। আমি কয়েক দিনের জন্যে চলে যাচ্ছি, আব্বা আম্মা না এলে ফিরব না। তোমরা কাল বাড়ি চলে যেয়ো। আমাদের বাড়ি পাহারা দেয়ার দরকার নেই। টোডদেরকে যখন এতই বিশ্বাস আব্বার, ওরাই থাকুক, পাহারা দিক। ধ্বংস করে দিক বাড়িঘর, আমার কিছু না। আবার অনুরোধ করছি, রাগ কোরো না।

-জিনা।

ঘরে ঢুকল মুসা ও রবিন।

নীরবে রবিনের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে আনমনে বলল কিশোর, ইস, এরকম কিছু যে করবে আগে ভাবলাম না কেন! নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটতে শুরু করল সে। পুরোদমে চালু হয়ে গেছে মগজ।

চিঠিটা দ্রুত পড়ে ফেলল রবিন। নিজেকেই জিজ্ঞেস করল যেন, কোথায় যেতে পারে?

বিড়বিড় করছে কিশোর, টর্চ…স্পিরিট…দেশলাই… তুড়ি বাজাল দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে। বুঝে গেছি! জলদি এসো আমার সঙ্গে! 

কিছুই জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করল না দু-জনে, করার সময়ও নেই, দরজার কাছে চলে গেছে কিশোর। তার পেছনে ছুটল ওরা।

নিজেদের ঘরে এসে টর্চটা বের করে নিল কিশোর। ছুটল সিঁড়ির দিকে।

বাগানে বেরিয়ে এল ওরা। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু মেঘ জমে আছে এখনও। সহসা কাটবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অন্ধকার রাত।

গেটের দিকে দৌড় দিল কিশোর। তার পাশে ছুটতে ছুটতে মুসা জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেছে?

এখনও বোধহয় যেতে পারেনি। দ্বীপে যাবে ও।

তাহলে আর অসুবিধে কি? যাক না। কাল আমরাও গিয়ে হাজির হব।

ভয় তো সেটা নয়, ভয় হলো অন্ধকারের। সাগরের অবস্থাও ভাল না, বড় বড় ঢেউ। এই ঢেউয়ে দ্বীপে নৌকা ভেড়াবে কি করে সে? ডুবে মরবে।

সৈকতে বেরিয়ে এল ওরা। নৌকাটা কোথায় রাখে জিনা, জানা আছে। সেদিকে তাকাতে টর্চের আলো চোখে পড়ল।

কিছু বলতে হলো না মুসাকে। ভেজা বালি মাড়িয়ে ছুটল। দেখতে দেখতে অনেক পেছনে ফেলে এল কিশোর ও রবিনকে।

জিনা, জিনা, থামো, যেয়ো না! চিৎকার করে বলল সে।

জোরে এক ধাক্কা মেরে নৌকা পানিতে ঠেলে দিল জিনা। ফিরেও তাকাল না। লাফিয়ে উঠে বসল। আগেই চড়ে বসে আছে রাফি। কিশোরদের আসতে দেখে ভাবল, রাতদুপুরে এ-এক মজার খেলা, খেক খেক করে চেঁচাতে শুরু করল।

ঝপাৎ করে পানিতে দাঁড় ফেলল জিনা।

একটুও দ্বিধা করল না মুসা। ড্রেসিংগাউন নিয়েই নেমে পড়ল পানিতে। চিৎকার করে বলছে, জিনা, শোনো, এই অন্ধকারে গেলে মরবে..

না, আমি যাবই। বাড়ি আর যাচ্ছি না, জোরে জোরে দাঁড় বাইতে শুরু করল জিনা।

নৌকার একটা গলুই ধরে ফেলল মুসা। টানতে লাগল। কিশোর আর রবিনও পৌঁছে গেল। ওরাও ধরে ফেলল নৌকাটা।

আর এগোতে পারল না জিনা।

লাফিয়ে নৌকায় উঠে পড়ল মুসা। জিনার হাত থেকে দাঁড় কেড়ে নিল।

আমার সর্বনাশ করে দিলে তোমরা! গুঙিয়ে উঠল জিনা। যা-ই করো, আমি আর ও-বাড়িতে ফিরে যাব না…

শোনো, জিনা,বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর, না যাও, নেই। কিন্তু তোমার প্ল্যানের কথাটা আমাদের বলতে কি অসুবিধে ছিল? আমরা কি বাধা . দিতাম? তুমি যদি বাড়ি ছাড়তে চাও, আমরাও ছাড়ব। দ্বীপেই চলে যাব।

এভাবে তোমার একা একা যাওয়ার চেয়ে, চলো, সবাই মিলেই যাই।

এক মুহূর্ত ভাবল জিনা। বেশ, চলো।

এখন না। এই অন্ধকারে গিয়ে মরার কোন মানে হয় না। কাল যাব আমরা। দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে, তৈরি হয়ে, যাতে আরামে থাকতে পারি। খালি হাতে গিয়ে শুধু শুধু কষ্ট করব কেন?

.

০৮.

টেনে নৌকাটাকে আবার বালিতে তুলল ওরা।

জিনা বলল, কিছু জিনিস আছে। নিয়ে নেব, নাকি নৌকায়ই থাকবে?

টর্চের আলো ফেলল কিশোর। বাহ, অনেক খাবার নিয়েছ তো। রুটি, মাখন, মাংস…টোডদের চোখ এড়িয়ে বের করলে কি করে?

রান্নাঘরে কেউ নেই। টোডও না। বোধহয় সে-ও আজ ওপরতলায় শুতে গেছে।

থাক এগুলো এখানেই। আরও আনতে হবে। অনেক। অন্তত দশদিনের খাবার।

কোথায় পাবে? রবিনের প্রশ্ন। কিনে নেবে?

আর কোন উপায় না থাকলে তাই করতে হবে।

জিনা বলল, আরেক কাজ করতে পারি কিন্তু। আম্মার ঘরে একটা বিশাল আলমারি দেখেছ না? ওটাতে কি আছে জানো? খাবার। সব টিনের খাবার। পর পর দু-বছর শীতকালে সাংঘাতিক অবস্থা হয়েছিল গোবেল বীচে। এমন তুষারপাত শুরু হয়েছিল, লোকে ঘর থেকে বেরোতে পারেনি অনেকদিন। খাবারের এত অভাব হয়ে গিয়েছিল, না খেয়ে থেকেছে অনেকে। তারপর থেকেই সাবধান হয়ে গেছে আম্মা। আলমারিটাতে প্রচুর খাবার জমিয়ে রাখে, যাতে আর বিপদে না পড়তে হয়।

ভেরি গুড, খুশি হয়ে বলল কিশোর, তাহলে তো কোন কথাই নেই। যা যা নেব লিখে রাখব আমরা। কেরিআন্টি এলে বাজার থেকে কিনে এনে আবার ভরে রাখব ওসব জিনিস।

তালা দেয়া দেখেছি, মুসা বলল। চাবি পাবে কোথায়?

আমি জানি আম্মা কোথায় রাখে, জবাব দিল জিনা।

বাড়ি ফিরল ওরা। পা টিপে টিপে চলে এল জিনার মায়ের ঘরে। শব্দ করলে টোডরা উঠে যেতে পারে, তাই রাফিকেও চুপ থাকতে বলে দিল জিনা।

চাবি দিয়ে তালা খুলে আলমারি খুলল সে।

মৃদু শিস দিয়ে উঠল মুসা। পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেল, টোডদের কানে শিসের শব্দ চলে যাওয়ার ভয়ে। জেগে উঠলে আবার কোন গণ্ডগোল বাধাবে ওরা, কে জানে।

গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে খাবার। সব টিনে ভর্তি। স্যুপ, মাংস, ফল, দুধ, মাছ, মাখন, বিস্কুট, সব্জি, কিছুরই অভাব নেই।

বড় দেখে দুটো কাপড়ের থলে বের করে আনল জিনা। তাতে খাবার ভরতে শুরু করল সবাই মিলে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল খাবারের, সেটা মিটে যাওয়াতে খুশি হলো কিশোর।

বৃষ্টি হলে গোবেল দ্বীপে খাবারের পানির সাধারণত অভাব হয় না। তবু প্ল্যাস্টিকের কয়েকটা বোতল ভরে বিশুদ্ধ খাবার পানি নিয়ে নেয়া হলো, বাড়তি সাবধানতা।

ভাড়ার থেকে নিয়ে আসা হলো ভেড়ার মাংসের দুটো আস্ত রান। পরিষ্কার কাপড়ে পেচিয়ে নেয়া হলো ওগুলো।

এছাড়া প্রয়োজনীয় আরও অনেক টুকিটাকি জিনিস নিল ওরা; যেমন, মোম, দড়ি, বালিশ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে সোফার কুশন, বিছানো আর গায়ে দেয়ার জন্যে কম্বল। জিনা মাত্র দুটো দেশলাই কিনেছে, তাতে হবে না, তাই আরও কিছু দেশলাইও নিয়ে নিল কিশোর।

মুসা বলল, সবই তো হলো। আসল জিনিসই বাকি।

কী? জানতে চাইল রবিন। রু

টি।

ও নিয়ে ভাবনা নেই, কিশোর বলল। সকালে বেকারি থেকে নিয়ে নিলেই হবে।

কিন্তু এত সকালে দোকান খুলবে?

না খুললে ঘর থেকে ডেকে বের করে এনে খোলাব, জিনা বলল, অসুবিধে হবে না।

বেঙের গোষ্ঠী যখন দেখবে আমরা নেই, হেসে বলল মুসা, আকাশ থেকে পড়বে। তাজ্জব হয়ে ভাববে, কোথায় উধাও হলাম আমরা। ভয়ও পাবে নিশ্চয়।

উঁহু, ভয় পাওয়ানো চলবে না, কিশোর বলল। ওরা পারকার আংকেলকে বলে দেবে তাহলে। হয়তো ছুটে আসবেন তিনি। আমাদের বাড়ি ফিরতে বাধ্য করবেন।

করলে কি? আমরা না গেলেই হলো।

তার মুখের ওপর না বলতে পারবে না। থাক, এসব নিয়ে ভাবার অনেক সময় আছে। জরুরী কাজটা আগে সারি। অন্ধকার থাকতে থাকতেই মালপত্রগুলো নিয়ে নৌকায় তুলতে হবে।

মালের বোঝার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। এত জিনিস নেব কি করে? নিতে নিতেই ভোর হয়ে যাবে তো। কবার যেতে-আসতে হবে ভেবে দেখেছ?

একমুহূর্ত চিন্তা করে জিনা বলল, ছাউনিতে দুটো ঠেলাগাড়ি আছে আমাদের। একটাতে করেই সব নেয়া যাবে। গাড়িটা আবার জায়গামত রেখে দিয়ে গেলেই হবে।

 গাড়ি বের করা হলো। চাকার অতি মৃদু শক্তও ঠিকই কানে গেল। ডারবির, কিন্তু একবার চাপা গলায় গোওও করে. উঠল শুধু। রাফির ভয়ে জোরে চিৎকার করার সাহস পাচ্ছে না। তার গোঙানিটা মিসেস টোডের কানে গেল না। গভীর ঘুমে অচেতন। নাক ডাকছে জোরে জোরে। জানতেই পারল না, নিচে কি চলছে।

নৌকায় মাল বোঝাই করা হলো। গাড়িটা রেখে দেয়া হলো আবার ছাউনিতে। রাত এখনও বাকি। এত জিনিস এভাবে নৌকায় ফেলে সবার চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে মুসাকে পাহারায় থাকতে বলল কিশোর।

মুসারও আপত্তি নেই। কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল নৌকার পাটাতনে।

সব নেয়া হয়েছে তো? প্রয়োজনীয় কিছু নেয়া বাকি আছে কিনা দেখছে কিশোর। নাহ্, হয়েছে…ওহহো, আসল জিনিসটাই তো ভুলে গেছি, টিন ওপেনার। টিনের মুখ কাটব কি দিয়ে?

রাফির জন্যে একব্যাগ ডগ-বিস্কুটও নিতে হবে, জিনা বলল।

তা নেয়া যাবে। মুসা, চলি। আরামসে ঘুমাও। ভোরেই চলে আসব আমরা।

বাড়ি রওনা হয়ে গেল কিশোররা, সঙ্গে গেল রাফি।

সাগরের পাড়ে বেশ ঠাণ্ডা, শীত লাগে। কম্বল মুড়ি দিয়ে আকাশের তারা গুণতে লাগল মুসা। কখন জড়িয়ে এল চোখ, বলতে পারবে না।

.

হাঁটতে হাঁটতে কিশোর বলল, সকাল আটটায় একটা ট্রেন আছে। রেলওয়ের একটা টাইম-টেবল নিয়ে ডাইনিং টেবিলে খুলে ফেলে রাখব। টোডদের। দেখিয়ে দেখিয়ে চলে যাব স্টেশনের দিকে। তারপর ঘুরে আরেক দিক দিয়ে গিয়ে উঠব নৌকায়।

ওরা ভাববে আমরা রকি বীচে ফিরে গেছি, হেসে বলল রবিন। কল্পনাই করবে না, খাবার-দাবার নিয়ে দ্বীপে চলে গেছি পিকনিক করার জন্যে।

চমৎকার বুদ্ধি, জিনা বলল, এতে খানিকটা দুশ্চিন্তায়ও থাকবে ওরা। পুলিশকে ভয় পায়, ওদের সাহায্য নিতে পারবে না। আব্বাকেও কিছু বোঝাতে পারবে না। বোরতে গেলেই তো নিজেদের শয়তানির কথা ফাঁস। করতে হবে। কিন্তু দশদিনের আগেই যদি আব্বা-আম্মা চলে আসে, জানব কি করে?

তা-ও তো কথা, কিশোর বলল। এখানে এমন কেউ আছে, যাকে বিশ্বাস করে সব কথা বলে যেতে পারো?

একমুহূর্ত ভাবল জিনা। আছে। ফগ। ওই যে, সেই জেলের ছেলেটা, যার কাছে রাফিকে লুকিয়ে রেখেছিলাম…

হ্যাঁ, মনে আছে। তাহলে তাকে বলে যেতে হবে।

বাড়ি ফিরে মায়ের লেখার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা টাইম-টেবল বের করে আনল জিনা।

কোন ট্রেনটায় যাচ্ছে ওরা, মোটা করে তার নিচে দাগ দিয়ে রাখল কিশোর। বইটা খোলা রেখেই উপুড় করে ফেলে রাখল টেবিলে।

এরপর একটা টিন ওপেনার বের করে পকেটে ভরল কিশোর।

শেষ হয়ে আসছে রাত। ঘুমানোর আর সময় নেই। বসার ঘরেই বসে রইল ওরা।

.

ফর্সা হয়ে এল পুবের আকাশ। সোনালি রোদ এসে পড়ল বাগানে।

এত সকালে কি বেকারি খুলবে, জিনা? জানতে চাইল কিশোর।

ছটা তো বাজে। চলো, গিয়ে দেখি।

দোকান খোলেনি রুটিওয়ালা। সামনের রাস্তায় পায়চারি করছে। ছেলেমেয়েদের চেনে। হেসে জিজ্ঞেস করল, এত সকালে এদিকে? কি ব্যাপার?

রুটি লাগবে, জিনা বলল।

ক’টা?

ছটা। বড় দেখে।

এত রুটি! কি করবে?

 খাব, হেসে জবাব দিল জিনা।

অবাক হলেও আর কিছু বলল না রুটিওয়ালা। দিয়ে দিল।

দোকান খুলে সবে ঝাড়পোছ করছে এক মুদী। তার কাছ থেকে একব্যাগ কুকুরের বিস্কুট কিনল জিনা।

জিনিসগুলো নৌকায় রাখতে চলল ওরা।

কম্বল মুড়ি দিয়ে কুঁকড়ি-বুকড়ি হয়ে তখনও ঘুমাচ্ছে মুসা।

ডাক দিল রবিন, এই মুসা, ওঠো। আরামেই আছো দেখি…

আরাম আর কই, হাই তুলতে তুলতে জবাব দিল মুসা, উফ, শীতে মরে গেছি।

কিশোর বলল, এত মালপত্রসহ নৌকাটা এখানে থাকলে লোকের চোখে পড়ে যাবে। জিনা, কি করা যায়? এটাকে লুকাতে হবে।

হাত তুলে একদিক দেখিয়ে জিনা বলল, ওদিকে একটা সরু খালমত আছে, একটা গুহার ভেতরে ঢুকেছে। গুহাটাতে লুকানো যেতে পারে। মুসা, বেয়ে নিয়ে যেতে পারবে?

আশা তো করি।

তাহলে যাও, কিশোর বলল।

 খিদে পেয়েছে। কিছু খেয়ে নিলে কেমন হয়?

খিদে পেলে খাবে। খাবারের কি অভাব আছে নাকি? আগে নৌকাটা। এখান থেকে সরাও, তারপর খেয়ো।

তোমরা খাবে না?

পরে এসে। আগে কাজ সেরে নিই।

 সবাই মিলে ঠেলে নৌকাটা পানিতে নামাল। দাঁড় তুলে নিল মুসা।

বাড়ি ফিরে এল কিশোররা। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল। টোডরা কেউ ঢুকতে দেখল না ওদের।

ওপরতলায় উঠে জোরে জোরে কথা বলতে লাগল, নানা রকম শব্দ শুরু করল, যেন এইমাত্র উঠল ঘুম থেকে। হুড়ুম-ধাড়ুম করে নামল নিচতলায়। বাগানে বেরিয়ে গেটের দিকে এগোল।

রান্নাঘরের জানালার দিকে তাকাল রবিন। নিচু স্বরে বলল, বেঙাচিটা চেয়ে আছে।

থাকুক, কিশোর বলল। দেখুক, আমরা কোনদিকে যাচ্ছি।

গেট খুলে বেরিয়ে এল ওরা।

Categories: