৪. ভুরু কোঁচকাল ক্যাসাডো; রেডিও?

0 Comments

ছিনতাই – তিন গোয়েন্দা – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ – জুলাই, ১৯৮৮

তাই নাকি? ভুরু কোঁচকাল ক্যাসাডো। রেডিও?

অনেক চেষ্টা করেছি আমি আর ওরটেগা, জানাল কিশোর। ঠিক করতে পারিনি।

আমি একবার দেখতে পারলে হত, বলল ক্যাসাডো।

এখান থেকে অনেক দূরে, বিশেষ আশাবাদী হতে পারল না জিনা।

না, বেশি দূরে নয়। প্লেনটা কোথায় পড়েছে, অনুমান করতে পারছি। ওই ইয়ারা নদী আর পাহাড়ের কথা যে বলছ, আমার চেনা। শর্টকাট আছে, এখান থেকে মাত্র এক ঘণ্টা লাগে। অনেক এগিয়ে গিয়েছিলে তোমরা, ঘুরপথে, পিছিয়ে আনা হয়েছে আবার! আমি যাব প্লেনটা দেখতে।

বললেন না বেরোতে দেয় না? কিশোর মনে করিয়ে দিল।

দেয় না মানে, জিভারোদের ছেড়ে চলে যেতে দেবে না। কিন্তু গায়ের বাইরে বেরোনোতে নিষেধ নেই, অবশ্য একলা বেরোতে দেবে না। কতবার শিকারে। গেছি ওদের সঙ্গে। অনেক জায়গা চিনেছি।

তাহলে একলা যাবেন কি করে? আটকাবে না?

হাসল ক্যালাডো। আসলে একা বেরোনোর চেষ্টাই করিনি কখনও। একলা। পালাতে পারব না, জঙ্গলে মরব, তাই। তবে চেষ্টা করলে যে ওদের চোখ এড়িয়ে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আসতে পারব না, তা নয়।

গত কয়েক দিনের তুলনায় সে-রাতে ভাল ঘুম হলো ছেলেদের।

পরদিন সকালে ঝরঝরে শরীর-মন নিয়ে ঘুম ভাঙল।

রোজ নাস্তা নিয়ে আসে সে মেয়েমানুষটা, সে-ই নিয়ে এল সেদিনও। ঝুড়ি নামিয়ে রেখে চলে গেল।

একটা পেঁপের নিচে ভাজ করা একটা কাগজ পাওয়া গেল। ক্যাসাডো লিখেছে :

কাল রাতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। প্লেনটা খুঁজে পেয়েছি। একটা ভুল করেছিল ওরটেগা, রেডিওর একটা পার্টস উল্টো লাগিয়েছিল, ফলে ঠিক হয়নি। সেটা মেরামত করেছি। রেডিও কাজ করছে এখন। এসওএস-ও পাঠিয়েছি একটা। জবাব পাইনি। সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছি। আবার গিয়ে মেসেজ পাঠানোর চেষ্টা করব।
–ক্যাসাডো।

খবর শুনে এত খুশি হলো, বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ নেচে নেয়ার লোভ সামলাতে পারল না মুসা আর জিনা। তাড়াহুড়ো করে নাস্তা সেরে কুঁড়ের বাইরে বরোল। নাচতে শুরু করল। তাদের সঙ্গে যোগ দিল রাফিয়ান। তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে, সেই সাথে ঘেউ ঘেউ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার যোগাডু কিশোর আর রবিনের।

এই মজার কাণ্ড ইনডিয়ান ছেলেমেয়েদেরও দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করল। পায়ে। পায়ে এগিয়ে এল ওরা। কাছে এসে সাহস পেয়ে তারাও যোগ দিল নাচে।

এল সর্দার হামুর ছেলে পুমকা। বয়েস যোলো। খুব ভদ্র, শান্ত। তাকে অপছন্দ করার জো নেই। সে-ও নাচতে শুরু করল, হাসছে হা-হা করে।

 এত হই-হল্লা কিসের! সর্দার মনে করল, সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেছে। কুঁড়ের দরজায় উঁকি দিল সে। দেখল, দেবতার ছেলেদের সঙ্গে তার ছেলের ভাব। হয়েছে। খুব খুশি হলো সে। হেসে, আপনমনে মাথা দুলিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল।

নাচতে নাচতেই কনুই দিয়ে মুসার পাঁজরে গুঁতো মারল জিনা। বোঝে এবার। এদের ভয়েই কিনা আমরা কেঁচো হয়ে ছিলাম। এই জিভারোদের মত ভদ্র জংলী–আর হয় না।

তা হোক, মুসা বলল। তবু আমি থাকতে চাই না এখানে। দেখা যাক, ক্যাসাডোর এসওএস-এর জবাব আসে কিনা।

কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে ছেলেরা। ফলে মনের ভার অনেকখানি। হালকা হয়েছে। সহজ ভাবে ইনডিয়ানদের সঙ্গে মিশতে পারছে।

প্রায় প্রতিদিনই ক্যাসাডোর সঙ্গে তার কুঁড়েতে দেখা হয়। আলাপ-আলোচনা হয়। সুযোগ পেলেই প্লেনে গিয়ে এসওএস পাঠায় বৈমানিক। যদিও একটা জবাবও আসেনি এখনও।

 সময় কাটাতে এখন আর তেমন অসুবিধে হয় না গোয়েন্দাদের। ইনডিয়ান। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভাব হয়েছে। বন্ধুত্ব হয়েছে পুমকার সঙ্গে। তার কাছে। জিভারো ভাষা শিখছে ওরা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কাজ চালানোর মত ভাষা শিখে ফেলল দুতরফই। মোটামুটি আলাপ করতে পারে। আর এই আলাপের মাধ্যমেই একদিন অদ্ভুত কিছু কথা শুনল অভিযাত্রীরা।

ভালমত বুঝিয়ে বলতে পারল না পুমকা, তত শব্দ দু-তরফের কারও স্টকেই জমা হয়নি এখনও। স্পষ্ট বোঝা গেল শুধু চারটে শব্দ : গুপ্তধন, মন্দির, চাঁদ এবং উপত্যকা।

কান খাড়া হয়ে গেল কিশোর পাশার। অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করল পুমকাকে, বোঝানোর চেষ্টা করল।

পুমকা বুঝল ঠিকই, কিন্তু বলতে পারল না। আবার একই কথা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, গুপ্তধন। মন্দির। চাঁদ।

নাহ, হবে না, হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল কিশোর। ক্যাসাডোকে জিজ্ঞেস করে দেখি, কিছু বলতে পারেন কিনা।

ছেলেদের আগ্রহ দেখে হাসল ক্যাসাডো।

পুরানো একটা জিভারো কিংবদন্তী, বলল সে। সব কিংবদন্তীই তিল থেকে তাল হয়, তবে তিল একটা থাকে। এটাতেও বোধহয় রয়েছে। কোন্ কথাটা সত্যি আর কোনটা রঙ চড়ানো বোঝা মুশকিল। জঙ্গলের পরে এক পাহাড়ী উপত্যকায় অনেক পুরানো একটা মন্দির আছে, নাম চন্দ্রমন্দির। ইনকাদের মত একটা সভ্য। জাতির বাস নাকি ছিল ওখানে, এখনও আছে ধ্বংসস্তূপ। সেখানেই আছে গুপ্তধন বা। মূল্যবান কিছু। সম্ভবত দামী ধাতুর তৈরি দেব-দেবীর মূর্তি।

দারুণ ভো! জিনা বলল।

হউ! তার সঙ্গে একমত হলো রাফিয়ান, চোখে কৌতূহল।

বা-বা, আলোচনায় যোগ দিতে চাস মনে হয়? আরও শুনবি? হেসে বলল ক্যাসাডো। পুরানো কিংবদন্তী, অথচ অনেক চেষ্টা করেও এতদিন গুপ্তধন খুঁজে পায়নি কেউ। এখন আর উৎসাহ নেই কারও। তাছাড়া গুপ্তধন দিয়ে করবেটাই বা কি তারা? কেউ আর খুজতে যায় না। ওসব ধনরত কিংবা সোনাদানার চেয়ে। শিকার খোঁজাই অনেক বেশি জরুরী প্রয়োজন ওদের।

হ্যাঁ, তা ঠিক, মাথা দোলাল কিশোর। তারমানে, গুপ্তধনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহী করতে চাইলে, এমন কিছু বলতে হবে, যাতে স্বার্থ থাকবে জিভারোদের।

হ্যাঁ। এটাই তোমাদের সুযোগ। ওদের বোঝানো সহজ হবে, কারণ… নাটকীয় ভঙ্গিতে চুপ হয়ে গেল সে, চোখ টিপল। আগ্রহ বাড়াচ্ছে ছেলেদের।

কারণ! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। জলদি বলুন?

কারণ, কিংবদন্তী আরও বলে, ওই গুপ্তধন খুঁজে পাবে কয়েকটা ছেলেমেয়ে।

বলেন কি? উত্তেজনায় গলা কাঁপছে রবিনের। তাহলে তো মস্ত সুযোগ। আজই গিয়ে বলুন না সর্দারকে, আমরা গুপ্তধন খুজতে যেতে চাই। বলবেন ওই গুপ্তধনের মধ্যে রয়েছে ওদের সৌভাগ্য।

রবিন ঠিকই বলেছে, কিশোর বলল। অন্যভাবেও বলতে পারেন। বলবেন, ওই গুপ্তধনে রয়েছে কালুম-কালুমের আশীর্বাদ। আমরা থাকলে যতখানি সৌভাগ্য আসবে, গুপ্তধনগুলো তার চেয়ে বেশি সৌভাগ্য বয়ে আনবে। তাছাড়া ওগুলো অমর। দর কষাকষি করবেন, আমরা ওগুলো খুঁজে বের করে দেব, বিনিময়ে। আমাদের মুক্তি দিতে হবে।

আস্তে, এত উত্তেজিত হয়ো না, হাত তুলল ক্যাসাডো। গুপ্তধন খুঁজে পাবেই, এত শিওর হচ্ছ কেন? মন্দিরটার কাছে হয়তো নিয়ে যেতে পারবে। জিভারো গাইড, কিন্তু গুপ্তধন বের করবে কি ভাবে? কোথায় খুঁজবে?

কোন নির্দেশ নেই?

আছে। কিন্তু শত শত বছর ধরে মুখে মুখে ফিরেছে কথাগুলো, কিছু বাদ। পড়েছে, কিছু রঙ চড়েছে, বিকৃত হয়েছে। আসল সত্য বের করে নেয়া খুব কঠিন। প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।

তবু, চেষ্টা করতে দোষ কি? রহস্যের গন্ধ পেয়েছে কিশোর পাশা, তাকে থামানো এখন আরও অসম্ভব কিন্তু সেকথা জানে না ক্যাসাডো। জায়গাটা নিশ্চয়। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়, তাহলে জিভারোদের কানে আসত না। মিস্টার ক্যাসাডো, আপনি গিয়ে বলুন সর্দারকে। চেষ্টা করে দেখি, তারপর যা হয় হবে।

হাসল বৈমানিক। তা নাহয় বলব। কিন্তু লাভ কতখানি হবে জানি না। এমনও হতে পারে, বলতে পারে, হাতে যা আছে তা-ই ভাল, যেটা নেই সেটার পেছনে ছুটোছুটি করার দরকার নেই।

কিন্তু ওগুলো পাওয়ার পর তো আর ‘নেই’ থাকবে না।

হুঁ, নাছোড়বান্দা ছেলে। ছেলেমী হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ঠিকই বলেছ, চেষ্টা করতে দোষ কি? কথায় আছে : ফরচুন ফেভারস দা ব্রেভ। হাহ।

পর দিনই হামুর সঙ্গে দেখা করতে গেল বিটলাঙগোরগা।

 অধীর হয়ে কুঁড়ের বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল ছেলেরা।

অনেকক্ষণ পর বেরিয়ে এল ওঝা। মুখোশের জন্যে তার মুখ দেখা গেল না, দীর্ঘ আলোচনার ফল কি হয়েছে, আন্দাজ করা গেল না।

ইশারায় ডাকল ওঝা। ছেলেদের নিয়ে আবার কুঁড়েতে ঢুকল।

মাদুরে বসে রয়েছে সর্দার। পাশে তার ছেলে পুমকা, জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল বিদেশী বন্ধুদের দিকে।

উঠে এসে এক এক করে চারজনের গায়েই এক আঙুল রাখল সর্দার, কয়েকবার করে মাথা নাড়ল, সম্মান দেখাল দেবতার বাচ্চাদের।

পুমকাও উঠে এসে হাত মেলাল ইউরোপীয়ান কায়দায়, বন্ধুদের কাছে। শিখেছে।

ব্যাপার দেখে হাঁ হয়ে গেল তার বাবার মুখ, চোখ বড় বড়। স্বর্গের রীতি শিখে ফেলছে তার ছেলে। ছেলের এত বড় সম্মানে গর্বে আধ হাত ফুলে উঠল হামুর। বুক। সরল হাসিতে ভরে গেল মুখ।

মনে হয় খবর ভাল, ফিসফিস করে বলল জিনা।

অভ্যর্থনার পালা শেষ হলে ছেলেদের নিয়ে তার কুঁড়েতে চলে এল। ক্যাসাডো। মুখোশ খুলে হাসল।

সর্দারের সঙ্গে কি কথা হয়েছে শোনার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে ছেলেরা, রাফিয়ানও যেন খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। সে-ও বসল ছেলেদের পাশে, গম্ভীর ভাবভঙ্গি।

হামুকে বুঝিয়ে বললাম, ক্যাসাডো বলল। বললাম, তোমরা স্বর্গ থেকে এসেছ কালুম-কালুমের নির্দেশ নিয়ে। কিংবদন্তীর গুপ্তধন খুঁজে বের করার জন্যে। প্রথমে বিশেষ গায়ে মাখল না হামু। তার কাছে গুপ্তধনের কোন মূল্য নেই। শেষে। বললাম, কাল রাতে কালুম-কালুমের আদেশ পেয়েছি আমি।

আল্লাহরে, কি কাণ্ড! এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল মূলা। এক আমেরিকায়ই মানুষে মানুষে কী ফারাক। এক অঞ্চলের মানুষ পাড়ি দিচ্ছে মহাশূন্য, আরেক অঞ্চলের মানুষ এখনও পড়ে আছে সেই গুহামানবের যুগে।

তা কি আদেশ এল কালুম-কালুমের কাছ থেকে? হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

কালুম-কালুম তো বাতাসের দেবতা, নাকি? ক্যাসাডোও হাসছে। গত রাতে, ঝড়ো হাওয়া বয়েছে, টের পেয়েছ? সেটাই বললাম হামুকে : বাতাসের মধ্যে রয়েছে জিভারোদের সব চেয়ে বড় সৌভাগ্য। ওগুলো একবার এনে তুলতে পারলে, শিকারের আর কোন দিন অভাব পড়বে না, দীর্ঘজীবী হবে জিভারোরা, শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ে প্রতিবারেই জিতবে-কখনও হারবে না।

 তারমানে আমরা এখন খুব দামী বস্তু হয়ে গেলাম ওদের কাছে, রবিন মন্তব্য করল। এজন্যেই এত সম্মান দেখিয়েছে মিস্টার হামু।

হ্যাঁ।

আসল কথা কি বলল? আর তর সইছে না কিশোরের। যেতে দেবে?

যদি গুপ্তধন পাওয়া যায়, দেবে মুক্তি পথ দেখিয়ে উপত্যকায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে লোক দেবে। এত উত্তেজিত হয়েছে, মোটেই দেরি করতে চায় না, পারলে এখুনি রওনা হয়। পাওয়া গেলে কথা রাখবে হামু, জঙ্গল পেরোতে সাধ্যমত সাহায্য করবে তোমাদের। তখন কোন একটা ছুতোয় আমিও সঙ্গে যাব তোমাদের।

খুব ঠাণ্ডা স্বভাবের লোক হামু। কোন ব্যাপারে হুট করে উত্তেজিত হয় না। ভেবে-চিন্তে কাজ করে। কিন্তু কোন ব্যাপারে যদি একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সেকাজ থেকে আর ফেরানো যায় না তাকে, শেষ না দেখে ছাড়ে না।

বিটলাঙগোরগা বলেছে, ছেলেরা এসেছে গুপ্তধন খুঁজে বের করে জিভারোদের চিরসৌভাগ্য বহাল করার জন্যে, এর চেয়ে খুশির খবর আর কি হতে পারে হামুর জন্যে?

এতবড় দায়িত্ব, যাকে তাকে সঙ্গে নেয়া যায় না। বেছে বেছে লোক ঠিক করল হামু। সবাই ভাল যোদ্ধা, তার খুব বিশ্বস্ত। পুমকাকেও নেবে সঙ্গে।

আনন্দে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে লাগল পুমকা। গায়ের ছেলেরা তার সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত। সেদিন থেকে অভিযাত্রীদের কাছছাড়া হয় না সে পারতপক্ষে, ওরা যেখানে যায়, সে-ও সঙ্গে সঙ্গে যায়।

এক্কেবারে আরেক রাফিয়ান, জিনা মন্তব্য করল।

কিন্তু এসব হালকা রসিকতায় কান দেয়ার মানসিকতা নেই কিশোরের। রবিন। আর মুসাও বুঝতে পারছে, কতখানি জটিল হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি।

গুপ্তধন পাওয়া গেলে তো খুবই ভাল, বাঁচলাম, কিশোর বলল, কিন্তু যদি না পাই, কি হবে ভেবে দেখেছ? ক্যাসাডোর কি অবস্থা হবে? হামু ধরে নেবে, তার সঙ্গে মিথ্যাচার করা হয়েছে, তাকে ফাঁকি দেয়া হয়েছে, ঠকানো হয়েছে। ঠাণ্ডা মানুষ রাগলে ভয়ানক হয়ে যায়। দেবতার কাছ থেকে এসেছি আমরা, সে-বিশ্বাস হারাবে হামু। ধরে সোজা বলি দিয়ে ফেলবে তখন।

তাই তো, এটা তো ভাবিনি! নিমেষে হাসি হাসি মুখটা কালো হয়ে গেল জিনার।

যা হবার হবে, মুসা বলল। আমার বিশ্বাস, তুমি ওগুলো খুঁজে পাবেই।

বেশি ভরসা করছ মুসা, কিশোর বলল। যদি সত্যি থাকে, হয়তো পাব। কিন্তু যদি না থাকে?

.

ধাঁধার তিনটে অংশ, সাবধানে নোট করে নিল কিশোর। ক্যাসাডোর মুখে শুনেই মুখস্থ করে ফেলেছে, তবু লিখে নিল। অনেক সময়, লেখার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক জটিল রহস্যের গিট খুলে যায়, কিশোরের বেলায়ই কয়েকবার ঘটেছে এই ঘটনা।

বন্ধুদেরকে নিয়ে গায়ের ধারে বিশাল এক গাছের ছায়ায় এসে বসল সে। ধাঁধা। সমাধানের চেষ্টা করবে। খানিক দূরে বসে উৎসুক হয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল। রাফিয়ান আর পুমকা।

দূরে কুঁড়ের দরজায় বসে এদিকেই ফিরে রয়েছে ক্যাসাডো। সে কি ভাবছে, জানে না, ছেলেরা। সে ভাবছে, কাজটা খুব খারাপ হয়ে গেল। নিজের ওপরই রেগে গেছে। যাওয়ার সব যোগাড় করে ফেলেছে হামু, এখন তাকে আর কিছুতেই ফেরানো যাবে না, কিছু বলেই বোঝানো যাবে না। যেতে না চাইলে খারাপ অর্থ করবে। ভাল বিপদেই পড়া গেছে। কেন যে বাচ্চাদের কথায় নাচলাম! ধাঁধা। সমাধানের চেষ্টা তো আমিও অনেক করেছি। পেরেছি? কয়েকটা ছেলে পারবে, কেন বিশ্বাস করতে গেলাম?

ঘাসের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে কিশোর। সামনে খোলা নোটবুক। পুকুরের ঠিক মাঝখানে পড়বে সূর্য, বিড়বিড় করল সে। তারপর পশ্চিমে দেখতে পাবে অস্তপ্রায় চন্দ্র। তারও পরে রয়েছে হলুদ দেবা, তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে সবুজ চোখে। মানে কি?

কেউ জবাব দিল না।

 তিনটে ধাঁধা, আবার বলল সে, একটার সঙ্গে আরেকটা কোনভাবে গাথা।

হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে, রবিন বলল। দ্বিতীয় ধাঁধাটা শুরু হয়েছে তারপর দিয়ে। তৃতীয়টা শুরু হয়েছে তারও পরে দিয়ে। সিরিয়াল ঠিকই আছে।

হুঁম! মাথা দোলাল জিনা।

মুসা কিছুই বলল না। মাথাখাটানো নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই তার, ধাঁধা– আর বুদ্ধির কচকচি ভালও লাগে না।

পুকুর তো বুঝলাম, কিশোর বলল, কিন্তু তাতে সূর্য পড়ে কিভাবে?

সূর্য ডোবার কথা বলেনি তো? রবিন বলল।

সেটাও অসম্ভব, পুকুরে সূর্য ডোবে না।

তাহলে কথাটা হয়তো অন্য কিছু ছিল, মুখে মুখে বিকৃত হয়েছে।

তা হতে পারে, ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। কথাটা হয়তো ছিল রোদ পড়েনা না, তা-ও না, রোদ পড়লে শুধু মাঝখানে পড়বে কেন? সারা পুকুরেই পড়বে। আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, পুকুরের মাঝখানে সূর্যের। প্রতিবিম্ব পড়াকে বুঝিয়েছে। তীরে দাঁড়িয়েই হয়তো দেখা যায় সেটা।

ঠিক বলেছ! নিজের উরুতে চাপড় মারল রবিন। দুপুর বেলা পুকুরে সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়তেই পারে। পুকুরটা খুঁজে বের করব। তারপরের ধাঁধাটা?

তারপর পশ্চিমে দেখতে পারে অস্তপ্রায় চন্দ্র, পড়ল কিশোর।

 নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল রবিনের। এইটা কি ভাবে সম্ভব? এর কোন মানেই হয় না। ধরা যাক, পুকুরটা আমরা খুঁজে পেলাম, যাতে ঠিক দুপুরে সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়ে। কিন্তু ওই সময় চাঁদ দেখব কি করে, তা-ও পশ্চিমে, আবার অস্তগামী? তারও ওপর রয়েছে জঙ্গল, উঁচু উঁচু গাছ, সত্যি সত্যি যখন অস্ত যায়, তখনও তো দেখা যাবে না।

ভূগোলের কোন গোলমাল হয়তো আছে ওই এলাকায়, মিনমিন করে বলল মুসা।

আরে দূর! ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিল যেন রবিন। যত ভৌগোলিক গোলমালই হোক, দুপুরবেলা চাঁদ ডুবতে দেখা যায় না।

চুপ হয়ে গেল মুসা।

কিশোর, কি হবে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

বুঝতে পারছি না। এখানে বসে মাথা ঘামিয়ে লাভ হবে না। পুকুরটা খুঁজে বের করার পর হয়তো কিছু বোঝা যাবে।

ওটা কোথায় আছে, কি করে জানছ?

ক্যাসাডো বলল না, এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা জলা জায়গা আছে। পুকুরটা সম্ভবত ওখানে। চারপাশে জঙ্গল ঘিরে রাখলে রোদই পড়বে না ঠিকমত, থাকত সূর্যের প্রতিবিম্ব।

কিন্তু ওখানে যাওয়া খুব কঠিন, ক্যাসাডো একথাও বলেছে, মনে করিয়ে দিল। মুসা। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, নানারকম হিংস্র জানোয়ার আছে, বিষাক্ত পোকামাকড় আছে। যেতে অনেক সময়ও লাগবে।

লাগুক না, কিশোর বলল। সময়ের তোয়াক্কা কে করছে? সময়টা আমাদের। জন্যে কোন সমস্যা না, যত খুশি লাগুক। হ্যাঁ, এবার তৃতীয় ধাঁধাটা কি বলে দেখি।

নোটবুকটা নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছে পুমকা। সাদা কাগজে বিজিবিজি কালো অক্ষরগুলো খুদে গোবরে পোকার মত লাগছে তার কাছে, ব্যাপারটা ভারি মজার আর রহস্যময় মনে হচ্ছে।

তার হাত থেকে নোট বই নিয়ে ধাঁধাটা বের করে পড়ল কিশোর, তারও পরে রয়েছে হলুদ দেবী, তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে সবুজ চোখে।

এটা সহজ, জিনা বলল।

তাই মনে হচ্ছে? মুসার কাছে সহজ লাগছে না।

 তাই তো।

কি?

গুপ্তধন। হলুদ দেবী মানে হলুদ কোন মূর্তিতি হবে, আইডল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, জিনার কথায় সায় দিল রবিন। হলুদ বলেছে তো, তার মানে। সোনার মূর্তি।

আর সবুজ চোখ কোন মূল্যবান পাথর? মুসার প্রশ্ন।

সম্ভবত পান্না, কিশোর জবাব দিল। ব্রাজিলে এক সময় খনি থেকে দারুণ। দারুণ পান্না তোলা হত। হয়তো প্রাচীন সেই সভ্যতার যুগে—

আর কিছু শোনার দরকার মনে করল না মুসা। হুররে! বলে চেঁচিয়ে উঠে নাচতে শুরু করল। হয়ে গেছে কাজ। সমাধান করে ফেলেছি আমরা।

 কিছুই বুঝল না পুমকা, কিন্তু মুসার আনন্দ সংক্রামিত হলো তার মাঝে। সে ও, লাফাতে শুরু করল। যোগ দিল রাফিয়ান। জিনা আর বসে থাকে কি করে? রবিনই বা কেন বসে থাকবে? বসে রইল শুধু কিশোর। সে বুঝতে পারছে, আসলে কোন সমাধান হয়নি। এত সহজ নয় ব্যাপারটা। কিন্তু সেটা বলে বন্ধুদের আনন্দে বাধা দিতে চাইল না।

কুঁড়ের দরজায় বসে ছেলেদের আনন্দ দেখে ক্যাসাডোর মুখও উজ্জ্বল হলো। সে ধরেই নিল, ধাঁধার সমাধান হয়ে গেছে। উঠল। পায়ে পায়ে এগোল সে, জানার জন্যে।

.

উত্তেজনা চরমে পৌঁছল। হামু দলবল নিয়ে তৈরি।

ওঝা বিটলাঙগোরার নির্দেশ মত ওভদিন ওভক্ষণ দেখে বেরিয়ে পড়ল দলটা।

জিভারো গায়ের মাহল কয়েক পর থেকেই শুরু হলো ঘন জঙ্গল। লতা এমন ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে হাটাই মুশকিল।

শুরুতে যা ছিল, তার চেয়ে গতি অনেক কমে গেল।

আগে আগে চলেছে কয়েকজন জিভারো যোদ্ধা, ওরা পথ-প্রদর্শক। তাদের পেছনে সর্দার হাম আর তার ছেলে, ঠিক পেছনেই ওঝা। তার পরে মালপত্র বাহকদের সঙ্গে ছেলেরা। রাফিয়ান তাদের পাশেই চলছে।

ওরা যেদিন রওনা হয়েছে, তার আগের দিন প্লেনে গিয়ে শেষবারের মত এস ও এস পাঠিয়েছে ক্যাসাডো, কিন্তু দুর্ভাগ্য, কোন জবাব মেলেনি।

হলো না। ফিরে এসে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলেছে বৈমানিক। যাকগে, যা হওয়ার হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না আমাদের। ফিরে এসে আবার যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাব। অবশ্য যদি ফিরতে পারি। যা ভয়ানক জঙ্গল।

সামনে যারা চলেছে, তাদের হাতে ভোজালির মত বড় ছুরি।, ওগুলো দিয়ে ঘন, ঝোপ আর লতা কেটে পথ করে নিচ্ছে। খুব কষ্টকর আর ধীর কাজ।

অসহ্য ভ্যাপসা গরমে ঘামছে ছেলেরা। আঠা আঠা হয়ে যাচ্ছে.সে ঘাম, ভীষণ অস্বস্তি হয়।

রাফিয়ানেরও জিভ বেরিয়ে পড়েছে, হাপাচ্ছে। এই গরম সে-ও সইতে পারছে

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে কুজো করে ফেলেছে পিঠ। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে। জঙ্গলের দিকে চেয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে, চাপা ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে গলার গভীর থেকে।

কুকুরটার মতই দাঁড়িয়ে গেছে জিভাবোরা। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিয়ানের মতই বিপদের গন্ধ পেয়েছে ওরাও।

জাগুয়ার! ফিসফিস করে বলল ক্যাসাডো।

ব্রাজিলের জঙ্গলের ভয়ঙ্করতম জানোয়ার জাগুয়ার, বলল মুসা। ইদানীং জন্তু জানোয়ার সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছে সে। কারণও আছে। তার বাবা মিস্টার রাফাত আমানের মাথায় ঢুকেছে, জানোয়ারের ব্যবসা সাংঘাতিক লাভজনক। দেশবিদেশ থেকে দুর্লভ জানোয়ার ধরে এনে বিভিন্ন চিড়িয়াখানা, সার্কাস পাটি আর জন্তু জানোয়ার পোষার সংগঠনগুলোতে বিক্রি করা যায়, যথেষ্ট চাহিদা। লস অ্যাঞ্জেলেসে মাত্র একজন ব্যবসায়ী আছে, তা-ও খুব ভাল ব্যবসায়ী নয়, চাহিদামত সরবরাহ করতে পারে না। ব্যবসাটা খুব মনে ধরেছে মূসার বাবার। সেটা আবার কথায় কথায় জানিয়েছেন কিশোরের চাচা রাশেদ পাশাকে। ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবসার। দিকে এমনিতেই ঝোঁক রাশেদ চাচার, মুসার বাবার কথায় লাফিয়ে উঠেছেন, পার্টনারশিপে ব্যবসা করবেন দু-জনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। স্যালভিজ ইয়ার্ডের দুই কর্মচারী বোরিস আর রোভারের সাহায্যে অনেকখানি জায়গার জঞ্জাল পরিষ্কার। করে সেখানে জানোয়ার রাখার খাঁচাও বসাতে শুরু করেছেন। পড়াশোনা শুরু করেছেন মিস্টার আমান, তার দেখাদেখি মুসাও। জন্তু-জানোয়ার সম্পর্কে যত বই পাচ্ছেন সর্ব কিনে এনে পড়ে ফেলছেন। কিভাবে ধরতে হবে, সেটা জানার জন্যে, প্র্যাকটিকাল ট্রেনিং নিচ্ছেন মাস্টার রেখে। ইতিমধ্যেই অনেক কিছু শিখে ফেলেছে মুসা। এই জন্তু জানোয়ার ধরে এনে বিক্রি করার ব্যবসা কতখানি। লাভজনক হবে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই কিশোর বা মুসার, কিন্তু। সাংঘাতিক সব অভিযানে বেরোতে পারবে বুঝতে পেরে ভীষণ আগ্রহী হয়েছে ওরাও রাশেদ চাচার সংগ্রহ করা বইগুলো প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছে কিশোর।

কত বড় হয়? জানতে চাইল জিনা।

পূর্ণবয়স্ক জাগুয়ার দেড়শো কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়, গড়গড় করে মুখস্থবিদ্যা, ঝাড়ল মুসা। প্রচণ্ড শক্তি গতি আর ক্ষিপ্রতা চমকে দেয়ার মত। আর রঙ..রঙ … চিতার মত। চিতা বাঘের মত ফুটকি…।

ভয়ঙ্কর শব্দ হলো। তুলনা করা কঠিন। নাম শুনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয়নি। ছেলেদের, কিন্তু ডাক শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল বুক। ডাকই যার এমন, কতখানি ভয়ানক জানোয়ার সে!

ইশারায় সবাইকে চুপ থাকতে বলে হাতের রাইফেলটা শক্ত করে চেপে ধরল হামু। পা টিপে টিপে এগোল চিৎকারটা যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।

ভেবে অবাক হয় ক্যাসাডো, রাইফেল আর গুলি কোথা থেকে সংগ্রহ করে হামু? অনেক চেষ্টা করেছে বৈমানিক, রহস্যটা রহস্যই থেকে গেছে তার কাছে। জানতে পারেনি। ২ পাথর হয়ে গেছে যেন সবাই। চোখের পাতা নাড়তে ভয় পাচ্ছে। এক চিৎকারেই কাপুনি তুলে দিয়েছে জাগুয়ার।

গোঁ গোঁ করেই চলেছে রাফিয়ান, ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। শক্ত করে তার কলার চেপে ধরে রেখেছে জিনা। কোনভাবেই গোঙানি থামাতে না পেরে শেষে মুখ চেপে ধরল।

একটি মাত্র গুলির শব্দের পর অখণ্ড নীরবতা।

হাসিমুখে জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল হামু।

এই হাসির অর্থ জানা আছে জিভারোদের। শোরগোল তুলে ছুটে গিয়ে ঢুকল বনের ভেতরে। বেরিয়ে এল খানিক পরেই। টানতে টানতে নিয়ে এসেছে শিকার।

জানোয়ারটা আসলেই বড়!

অনেকক্ষণ ধরে নানাভাবে সর্দারের প্রশংসা করল যোদ্ধারা। তারপর জাগুয়ারের ছাল ছাড়িয়ে মাংস কেটে ভাগাভাগি করে কাঁধে তুলে নিল।

আবার শুরু হলো চলা। জাগুয়ারের ডাক আর চেহারা দেখে ভয় পেয়েছে ছেলেরা, চুপসে গেছে ফাটা বেলুনের মত। শুরুতে যে হাসি হাসি ভাবটা ছিল, এখন আর নেই।

দুই দিন পর শুরু হলো জলাভূমি।

গত দু-দিনের যাত্রাটা সুখকর হয়নি মোটেও। আঠাল, গরম, ভেজা পথ, মশা, তাড়ানোর জন্যে রাতে ক্যাম্পের আগুনের ধোয়া, সারাক্ষণ হিংস্র জানোয়ারের আনাগোনা, ভাল লাগার কথাও নয়। জাগুয়ারটা মারার পর থেকে হাটার সময়ও স্বস্তি পায়নি ছেলেরা। মনে হয়েছে, এই বুঝি অন্ধকার কোন ঝোপ থেকে লাফিয়ে। এসে ঘাড়ে পড়ল আরেকটা জাগুয়ার।

ব্রাজিলের জঙ্গলের জলা কেমন, অস্পষ্ট ধারণা আছে বটে ছেলেদের, কিন্তু এতখানি খারাপ, কল্পনাও করেনি। এখনও ভালমত শুরু হয়নি জলাভূমি, তাতেই এই অবস্থা, আসল জায়গায় গেলে কেমন হবে ভেবে ভয় পেল ওরা।

বড় বড় গাছ ডালপাতা ছড়িয়ে রেখেছে, প্রায় প্রতিটি গাছের নিচ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে অসংখ্য নালা, নালার জল বলা চলে। বনতলে আবছা অন্ধকার, বাষ্প। উঠছে। এত আঠা করে দেয় শরীর, গায়ে জামাকাপড় রাখাই দায় কেন শুধু পাতার আচ্ছাদন কোমরে জড়ায় এখানকার ইনডিয়ানরা, বোঝা গেল। য়েখানে। পানি নেই, সেখানটাও শুকনো নয়, প্যাঁচপেচে কাদা। পচা পাতার গন্ধে বাতাস ভারি। ওসব পাতার ভেতরে ভেতরে কিলবিল করছে জোক আর নানারকম পোকামাকড়, কোন কোনটা সাংঘাতিক বিষাক্ত।

আস্ত নরক? নাক কুঁচকাল জিনা। এসব জায়গায় মানুষ আসে নাকি!

তাহলে আমরা এলাম কেন? ভুরু নাচাল মুসা, আমরা কি মানুষ নই?

আমরা কি আর ইচ্ছে করে এসেছি? ঠেকায় পড়ে।

জবাব নেই মুসার। চুপ হয়ে গেল।

 চওড়া একটা খালের ভেজা তীর ধরে এগিয়ে চলল ওরা।

 হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে লাফিয়ে সরে এল রবিন। ঝপাং করে গিয়ে পানিতে পড়ল। একটা জীব। গাছের গুঁড়ি মনে করে ওটার ওপর পা দিয়ে ফেলেছিল সে।

অ্যালিগেটর। আবার বিদ্যা ঝাড়তে শুরু করল মুসা। খুব পাজি জীব। দেখেশুনে পা ফেলবে।

কিন্তু খানিক পরেই মুসা নিজে যখন একটা অ্যালিগেটরের ওপর পা ফেলল, আর ঝাড়া দিয়ে তাকে উল্টে ফেলে পালাল ওটা, হাত ধরে টেনে তুলে গম্ভীর মুখে বলল রবিন, অ্যালিগেটর যে কুমিরের এক প্রজাতি, তা কি জানো? বড়গুলো মানুষখেকোও হয়। ঠিকই বলেছ, খুব পাজি জীব। সুতরাং, সাবধান, কানার মত পা ফেলো না। শেষে অ্যালিগেটরের নাস্তা হয়ে যাবে।

হেসে উঠল জিনা আর কিশোর, খুব একহাত নিয়েছে রবিন।

ক্যাসাডোও হাসি চাপতে পারল না।

ইনডিয়ানরা তো দাঁত বের করে হাসছে মুসার অবস্থা দেখে।

বেশ অনেকখানি পথ পেরোল সেদিন দলটা। খালের পাড়ের কুচকুচে কালো মাটি নরম, স্পঞ্জের মত, পা পড়লে দেবে যায়। তোলার সময় আবার কামড়ে ধরে রাখে। কলা পাতা কেটে আনল ইনডিয়ানরা। সেগুলো দিয়ে পা মুড়ে লতা দিয়ে বাধল। এই আদিম জুতো বেশ কাজের। কাদা লাগে না, মাটির কামড় বসে না। তাছাড়া পোকামাকড়ের কামড়ও ঠেকায়।

রবিনের আহত গোড়ালি আবার ব্যথা শুরু করেছে। জ্বর জ্বর লাগছে তার।

পুকুরটা কোথায় পাওয়া যাবে? বিকেলের দিকে বলল সে। আর তো পারি। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার অবস্থা।

ডজন ডজন পুকুর আর ডোবা তো পেরিয়ে এলাম, বলল জিনা।

হ্যাঁ, কিশোর চিন্তিত। ওগুলোর কোনটাই নয়। এত কালো আর ঘোলা ওগুলোর পানি, চারপাশে জঙ্গল ঘিরে রেখেছে, ওগুলোতে রোদই পড়ে না। ঠিকমত। মাঝপরে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখা যাবে কি করে? তাছাড়া ওগুলোর ধারেকাছে কোন পাহাড় নেই।

তবে, রবিন বলল, মনে হয়, পেয়ে যাবই। কিশোর, আরেকটা কথা ভেবেছ? ধাঁধা অনেক পুরানো। যখনকার কথা, তখন হয়তো পুকুরপাড়ে গাছ ছিল। না। কিন্তু এতদিনে কি জন্মায়নি? কে সাফসুতরো করে রাখতে গেছে?

মাথা ঝাঁকাল ক্যাসাডো। যুক্তি আছে কথায়। কিন্তু আমার ধারণা, আরও বড় কোন পুকুর, কিংবা ছোটখাট হদের কথা বলা হয়েছে। যা দেখলাম ওগুলো সবই প্রায় ডোবা। যারা এই ধাঁধা বানিয়েছে, তারা যে বুদ্ধিমান ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। যখন দেখল, তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে, গুপ্তধনগুলো লুকিয়ে ফেলল। সেই তারা বোধহয় চন্দ্রমন্দিরের ধর্মগুরুর দল। কেন লুকিয়েছে, তারাই জানে। তবে নিশ্চয় এমন কোথাও লুকায়নি, সহজেই যেখানকার চিহ্ন মুছে যাবে, অল্প কিছুদিন পরেই আর চেনা যাবে না। তারমানে, ধরে নেয়া যায়, এমন কোথাও লুকিয়েছে, অনেক বছর পরেও যে জায়গাটা নষ্ট হবে না।

সেটা হলেই ভাল, জিনা বলল।

আপনি ঠিকই বলেছেন, ক্যাসাডোকে বলল কিশোর। তা-ই করা হয়েছে।

পরদিন ইয়াপুরার একটা শাখা-নদীর তীরে পৌঁছল ওরা।

সরু নদী, খালই বলা চলে। এক ধারে জলা, অন্য ধারে ঘন জঙ্গল, কোথাও কোথাও অনেক সরে গেছে গাছপালা। ওসব জায়গায় বনের সীমানা আর পানির। সীমানার মাঝে শুকনো চরা, আঠাল মাটির নাম নিশানাও নেই। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল। একই জায়গায় শতরূপ।

গত কয়দিনে কাহিল হয়ে পড়েছে গোয়েন্দারা। সেটা দেখে হামুর সঙ্গে পরামর্শ করল ক্যাসাডো। সর্দার দেখল, শুধু দেবতার ছেলেরাই নয়, তার নিজের ছেলেও কাহিল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া খাবার ফুরিয়ে এসেছে, শিকার করা দরকার। ভেবেচিন্তে পুরো একটা দিন বালির চরায় বিশ্রামের কথা ঘোষণা করল হামু। ছেলেরা বিশ্রাম করবে, তাদের সঙ্গে থাকবে কুলিরা। যোদ্ধারা শিকারে যাবে।

দলবল নিয়ে শিকারে চলে গেল হামু।

আগুন জ্বেলে রান্নায় ব্যস্ত হলো কুলিদের কেউ, কেউ স্রেফ হাত-পা ছড়িয়ে বসে রইল।

জায়গাটা সুন্দর। ঝকঝকে সাদা বালি। নদীর পানিও টলটলে পরিষ্কার।

ক্যাসাডো আর মুখোশ রাখতে পারছে না মুখে। কত আর পারা যায়? গাঁয়ে থাকতে তো রাতের বেলা অন্তত খুলে রাখতে পারত। কিন্তু অভিযানে বেরোনোর পর সবার সঙ্গে একসাথে ঘুমাতে হয়, ফলে খুলতে পারে না। 

কিন্তু এই গরমের মধ্যে নদীর পানির হাতছানি আর ঠেকাতে পারল না। কুলিদের কাছ থেকে সরে এল। এক জায়গায় পুমকা আর ছেলেরা বসে আছে। সেখানে এসে মুখোশ খুলে ফেলল সে।

ওঝার মুখ দেখতে পারায় নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করল পুমকা।

গোসল করবে নাকি? জিজ্ঞেস করল ক্যাসাডো।

ছেলেরাও সে-কথাই ভাবছিল; সে বলার পর আর দেরি করল না। জিনা ছাড়া বাকি সবাই টান দিয়ে দিয়ে কাপড় খুলে ফেলল। পুমকার কাপড়ই নেই, কোমরের আচ্ছাদন খোলার দরকার হয় না। কাপড়ের মত ভেজে না। পানি লাগলে ঝাড়া দিলেই পড়ে যায়।

নদীতে নামার আগে ভালমত দেখে নিল ওরা, নিশ্চিন্ত হয়ে নিল যে ওখানে অ্যালিগেটর নেই।

দাপাদাপি শুরু করল সবাই। ডুব দিচ্ছে, একে অন্যকে পানি ছিটাচ্ছে।

সব চেয়ে বেশি খুশি রাফিয়ান।

কুত্তাটা খুব ভাল, বলল পুমকা।

খুশি হলো জিনা। একটা ডাল ছুঁড়ে দিয়ে দেখো না, কেমন সঁতরে গিয়ে নিয়ে আসে। যত দূরেই ফেলো, নিয়ে আসবে।

নতুন ধরনের একটা খেলা পেয়ে গেল পুমকা। বার বার ডাল ছুঁড়ে ফেলে পানিতে, সাতরে গিয়ে নিয়ে আসে রাফিয়ান। নদীটা তেমন চওড়া নয়। জোরে একটা ভাল ছুঁড়ে মারল পুমকা। অন্য পাড়ের কাছে গিয়ে পড়ল ডালটা। চেঁচিয়ে বলল পুমকা, যাও তো দেখি, নিয়ে এসো। বাপের ব্যাটা বলব তাহলে।

এটা একটা কাজ হলো নাকি? এত সহজেই যদি বাপের ব্যাটা হওয়া যায়, ছাড়ে কে? রওনা হয়ে গেল রাফিয়ান। হাসিমুখে চেয়ে আছে সবাই।

অপর পাড়ে প্রায় পৌঁছে গেছে রাফিয়ান, হঠাৎ হাসি মুছে গেল পুমকার মুখ থেকে।

তার এই পরিবর্তন লক্ষ করল জিনা। পুমকার দৃষ্টি অনুসরণ করে চেয়ে তারও মুখের রঙ পাল্টে গেল। বড় বড় হয়ে গেল চোখ, তাতে আতঙ্ক।

মস্ত এক সাপ। একটা গাছের ডাল থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে রাফিয়ানের দিকে। কুকুরটা টের পায়নি।

মুসাও দেখেছে সাপটা। অ্যানাকোণ্ডা! ফিসফিসিয়ে বলল সে। দুনিয়ার সব। চেয়ে বড় সাপ। এক নম্বর হারামী।

ক্যানোডি…ক্যানোডি! অ্যানাকোণ্ডার জিভারো নাম। দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগছে পুমকার, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

 ঘেউ ঘেউ শুরু করল রাফিয়ান, দেখে ফেলেছে সাপটাকে।

খালি সাপের বয়ান দিচ্ছ তোমরা, চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কিছু একটা করা দরকার।

পাঁচ-ছয় মিটার লম্বা হবে সাপটা। ভীষণ মোটা। জলপাই-সবুজের ওপর কালো ফুটকি।

জলদি! মুসা বলল। পুমকা, কুলিদের ওখান থেকে লাঠি নিয়ে এসো কয়েকটা। কুইক! বইয়ে পড়েছে কি করে বড় সাপ তাড়াতে হয়।

এক দৌড়ে গিয়ে কয়েকটা লাঠি নিয়ে এল পুমকা।

একটা লাঠি নিয়ে বলল মুসা, আমি যা করব, সবাই করবে। ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করব।

লাঠি দিয়ে গায়ের জোরে পানি পেটাতে শুরু করল ছেলেরা, ক্যাসাডোও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। সেই সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল সকলেই।

মুসা, অযথা চেঁচাচ্ছি, জোরে বলল রবিন। সাপের কান নেই, শব্দ শোনে।

তাই তো! ঠিক আছে, পেটানো থামিও না। কম্পন টের পাবে। ভড়কে যেতে পারে।

ঠিকই বলেছে মুসা।

সাপটা বোধহয় ভাবল : আহ, এ-কি জালাতন! কি কাঁপাটা- না কাঁপছে। পানি। ঝড় উঠল নাকিরে বাবা? শুরু করেছে কি দু-পেয়ে জীবগুলো? যে চারপেয়েটাকে ধরতে যাচ্ছি, সেটাকেও তো চিনতে পারছি না। বানর কিংবা শুয়োরের মত মোটেও নয়। খেতে কেমন লাগবে কে জানে?

দ্বিধা করছে সাপটা। তারপর সিদ্ধান্ত নিল : এই জঘন্য জায়গা থেকে চলে যাওয়াই ভাল। খাওয়ার সময় এত গণ্ডগোল ভাল লাগে? যাই, অন্য কোথাও গিয়ে কিছু ধরে শান্তিতে খাই।

গাছের ডালে আর ফিরে গেল না সাপটা। পানিতে নেমেছে তো নেমেছেই। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল। ধীরে ধীরে ভেসে চলল ভাটির দিকে।

জিনার ডাকে ফিরে আসছে রাফিয়ান, নিরাপদ দূরতে চলে এসেছে।

মোড়ের কাছে গিয়ে কোণাকুণি সাঁতরাতে শুরু করল সাপটা। চিত হারিয়ে। গেল ওপাশে।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল জিনা। মুসা, তোমার জন্যেই রাফিয়ান বাচল আজ!

Categories: