১. বড় ম্যাপটা ভাঁজ করে পকেটে রাখল কিশোর পাশা

0 Comments

বড় ম্যাপটা ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বলল কিশোর পাশা, হ্যাঁ, যা চাই সবই আছে। বিশাল প্রান্তর, জলাভূমি, পাহাড়, জঙ্গল, মাঝে মাঝে ছোট খামার, বাড়ি-ঘর। কয়েকটা সরাইখানাও আছে। কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব আমরা। রাফিয়ানের খুব মজা হবে।

ওর তো পোয়াবারো, বলল পাশে বসা মুসা আমান। শুনেছি, অনেক খরগোশ আছে ওদিকে। হলিও।

খোলা জানালা দিয়ে হু-হু করে বাতাস আসছে, কোঁকড়া লম্বা চুল উড়ছে কিশোরের। বার বার এসে পড়ছে কপালে, চোখেমুখে, সরাতে হচ্ছে। মুসার সে ঝামেলা নেই, খাটো করে ছাটা চুল, খুলি কামড়ে রয়েছে যেন।

গাঁয়ের দিকে ছুটে চলেছে বাস।

স্কুল পালিয়েছ বুঝি? টিকিট বাড়িয়ে দিয়ে হাসল কণ্ডাকটার।

হ্যাঁ, তা বলতে পারেন, মাথা কাত করল মুসা। শহরের গ্যাঞ্জাম আর ভাল্লাগছিল না, স্কুলও ছুটি। পালিয়ে এসেছি।

শেষ স্টপেজে থামল বাস। আর সামনে যাবে না। বাস বদলাতে হবে।

সামনের দরজা দিয়ে নামল কিশোর আর মুসা। পেছনের দরজা দিয়ে রবিন, জিনা আর রাফিয়ান।

বদলানো বাসের যাত্রাও শেষ হলো। কিশোরকে বলল কণ্ডাকটার, শেষ। এবার ফিরে যাব।…তা কোথায় যাবে তোমরা? টিংকার ভিলেজ?

নামল পাঁচ অভিযাত্রী।

ছড়ানো সবুজ মাঠ, ছোট্ট পুকুরে হাঁস, মেঘের ছায়া।

আনন্যে পাগল হয়ে উঠল রাফিয়ান। চার বন্ধুকে ঘিরে নাচানাচি করছে, ছুটে গিয়ে এক দৌড়ে ফিরে আসছে আবার। লাফাচ্ছে। ঘেউ ঘেউ করছে হাঁসের দিকে চেয়ে। ঘাত ঘ্যাঁত করে তাকে ধমক দিল মস্ত এক রাজহাঁস।

খাবার-টাবার কিছু কিনে নেয়া দরকার, বলল কিশোর।

একটা দোকান দেখিয়ে জিনা বলল, চলো না, গিয়ে দেখি, কি পাওয়া যায়।

আরে, আরে! ভেতরের আরেকটা ঘর থেকে দরজায় বেরিয়ে এসেছেন এক মহিলা, দোকানের মালিক, কুত্তাটাকে ঢুকিয়েছ কেন? আরে কেমন লাফাচ্ছে। পাগলা নাকি? বের করো, বের করো।

না না, পাগল না, হেসে বলল জিনা। বেশি খুশি। খাওয়ার গন্ধ পেয়েছে তো।

অ। তাই বলো। তা কিছু মনে কোরো না। খাবারের দোকান, পরিষ্কার রাখি। ওটাকে বাইরে রেখে এসো, প্লীজ।

এই রাফি, আয়, কুকুরটার গলার বেল্ট ধরে টেনে নিয়ে চলল কিশোর। তুই বাইরেই থাক। আমরাই আনতে পারব সব।

কাউন্টারের পেছনে একটা তাক দেখিয়ে বলল মুসা, বাহ, দারুণ তো দেখতে। টেস্টও খুব ভাল হবে মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ, ভাল, বললেন মহিলা। আমি বানিয়েছি। আমার ছেলে স্যাণ্ডউইচ খুব পছন্দ করে। এই তো, আসার সময় হয়ে এল তার। গ্রীন ফার্মে কাজ করে।

আমাদের কয়েকটা বানিয়ে দিতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর। চিনি না জানি না, কোথায় আবার কোন গাঁয়ে গিয়ে খুঁজব। লাঞ্চের ব্যবস্থা সঙ্গেই নিয়ে যেতে চাই।

হ্যাঁ, তা পারব। কি কি নেবে? পনির, ডিম, শুয়োর, গরু?

শুয়োর বাদে আর সবই দিন। চারটে কোক দেবেন?

নাও না, নিয়ে খাও, বললেন মহিলা। ওই যে গেলাস।

আচ্ছা। আর হ্যাঁ, ভাল পাউরুটিও দেবেন।

খারাপ জিনিস আমি বানাই না। তোমরা কোক খাও। কেউ এলে ডেকো। ভেতরের ঘরে চলে গেলেন আবার মহিলা।

ভালই হলো, বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল কিশোর। খাওয়ার ভাবনা না থাকলে নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারব। আজ একদিনেই অনেক জায়গা দেখা হয়ে যাবে।

কতগুলো লাগবে? হঠাৎ দরজায় দেখা দিলেন মহিলা। আমার ছেলে এক বেলায়ই ছটা স্যাণ্ডউইচ খেয়ে ফেলে। বারো টুকরো রুটি লাগে বানাতে।

অ্যাঁ…আমাদের একেকজনের জন্যে আর্টটা করে বানান, মহিলার চোখ বড় বড় করে দিল কিশোর। পাচ-আটে চল্লিশটা। সারা দিন চলে যাবে আমাদের।

মাথা ঝাঁকিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে গেলেন মহিলা।

ভারি কাজ দিয়ে ফেলেছি, সহানুভূতির সুরে বলল রবিন। মাকে বেশি খাটতে দেখলে কষ্ট লাগে তার, নিজেও গিয়ে সাহায্য করে। আটটা স্যাণ্ডউইচ তারমানে যোলোটা করে রুটির টুকরো, পাঁচ-যোলো আশি.নাহ, ভাবতেই খারাপ লাগছে, রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকতে ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু মহিলা আবার কিছু মনে করে বসেন। ভেবে গেল না।

আরে অত ভেব না, প্রথমে এক চুমুকে আধ গেলাস কোকাকোলা খালি করেছে মুসা, আরেক চুমুকে বাকিটা শেষ করে ঠকাস করে গেলাস নামিয়ে রাখল টেবিলে। দেখো, কে আসছে।

দরজার বাইরে সাইকেল থেকে নামল লম্বা এক লোক, হ্যাণ্ডেল ধরে রেখেই ডাকল, মা?

কে লোকটা, চিনিয়ে দিতে হলো না। ওরা বুঝল, মহিলার ছেলে, যে গ্রীন ফার্মে কাজ করে। খেতে এসেছে।

আপনার মা ভেতরে, বলল মুসা। ডাকব?

থাক। সাইকেল রেখে ভেতরে ঢুকল লোকটা, তাক থেকে স্যাণ্ডউইচগুলো একটা প্যাকেটে নিয়ে আবার রওনা দিল। দরজার কাছে গিয়ে চেয়ে বলল, মাকে বোলো, আমি নিয়ে গেছি। তাড়াহুড়ো আছে। ফিরতেও দেরি হবে। কিছু জিনিস। নিয়ে যেতে হবে জেলে।

জোরে জোরে প্যাডাল ঘুরিয়ে চলে গেল লোকটা।

হঠাৎ দরজায় উদয় হলেন আবার মহিলা, হাতে ইয়া বড় এক রুটি কাটার ছুরি। আরেক হাতে রুটি। ডিকের গলা শুনলাম…ও-মা, স্যাণ্ডউইচও নিয়ে গেছে। ডাকোনি কেন?

তাড়াহুড়ো আছে বলল, জানাল কিশোর। ফিরতেও নাকি দেরি হবে আজ। কি নাকি নিয়ে যেতে হবে জেলে।  আমার আরেক ছেলে আছে জেলখানায়।

মহিলার কথায় এক সঙ্গে তার দিকে ঘুরে গেল চার জোড়া চোখ। জেলখানায়? কয়েদী? কোন জেলে?

ওদের মনের কথা বুঝে হাসলেন মহিলা। না না, রিক কয়েদী নয়। ওয়ারডার। খুব ভাল ছেলে আমার। ওর চাকরিটা আমার মোটেই ভাল্লাগে না। চোর-ডাকাতের সঙ্গে বাস, কখন কি হয়!

হ্যাঁ, ম্যাপে দেখলাম, বলল কিশোর। বড় একটা জেলখানা আছে এদিকে। আমরা ওটার ধারে-কাছেও যাব না।

না, যেয়ো না, মহিলাও হুশিয়ার করলেন, ঢুকে গেলেন ভেতরে।

দাঁড়িয়ে আছে ছেলেরা। অনেকক্ষণ। মাত্র একজন খরিদ্দারের দেখা পেল। বিষণ্ণ চেহারার এক বৃদ্ধ, পাইপ টানতে টানতে ঢুকল। দোকানের চারদিকে তাকিয়ে মহিলাকে খুঁজল। তারপর এক প্যাকেট পাউডার নিয়ে পকেটে ঢোকাল। কিশোর লক্ষ করল, পাউডারটা পাচড়ার ওষুধ।

পকেট থেকে পয়সা বের করে কাউন্টারে ফেলল লোকটা। পাইপ দাঁতে কামড়ে ধরে রেখেই বলল, মহিলাকে বোলো, নিয়ে গেলাম, বেরিয়ে গেল সে। –

লোকটার গায়ে-কাপড়ে দুর্গন্ধ, কদিন গোসল করে না, কাপড় ধোয় না কে জানে। বুড়োর ভাবভঙ্গি আর গন্ধ কোনটাই পছন্দ হলো না রাফিয়ানের, চাপা গোঁ গো করে উঠল।

অবশেষে স্যাণ্ডউইচ তৈরি শেষ হলো। বেরিয়ে এলেন মহিলা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সুন্দর করে প্যাকেট করে দিলেন সব খাবার, প্রতিটি প্যাকেটের ওপর পেনসিল দিয়ে লিখে দিলেন কোনটাতে কি আছে। পড়ে, অন্যদের দিকে চেয়ে চোখ টিপল মুসা, ঝকঝকে সাদা দাঁত আর একটাও লুকিয়ে নেই, বেরিয়ে পড়েছে। হাসিতে। খাইছে! আল্লাহরে, নিশ্চয় কোন পুণ্য করে ফেলেছিলাম। এত খাবার?… আরে, ওটাতে কি?

ফ্রুট কেক, হেসে বললেন মহিলা। বেশি নেই, চার টুকরো ছিল। দিয়ে দিলাম। ফাউ। পয়সা লাগবে না। খেয়ে ভাল লাগলে ফেরার পথে জানিয়ে যেয়ো।

অনেক চাপাচাপি করেও কেকগুলোর জন্যে পয়সা দিতে পারল না কিশোর। কাউন্টারের দিকে চোখ পড়তেই বললেন, পয়সা এল কোত্থেকে?

বলল কিশোর।

ও, রিকেট বুড়ো, মাথা দোলালেন মহিলা। ঠিক আছে, তোমাদের যাত্রা শুভ হোক। ফেরার পথে দেখা করে যেয়ো। আর, খাবারের দরকার পড়লেই চলে এসো এখানে।

ঘাউ! মহিলার কথা বুঝেই যেন সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল রাফিয়ান, দরজার বাইরে থেকে।

ও, তুই। ভুলেই গিয়েছিলাম। রান্নাঘর থেকে বেশ বড় এক টুকরো হাড় এনে ছুঁড়ে দিলেন কুকুরটার দিকে।

মাটিতে আর পড়তে পারল না। শূন্যেই লুফে নিল রাফিয়ান।

মহিলাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।

আহ, ছুটির কি আনন্দ! অনেক পেছনে ফেলে এসেছে স্কুল। অক্টোবরের রোদে উষ্ণ আমেজ। শরতের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে প্রকৃতি, গাছে গাছে হলুদ, লাল, সোনালি রঙের সমারোহ। রোদে যেন জ্বলছে। জোরে বাতাস লাগলে বোটা থেকে খসে, যাচ্ছে মরা পাতা, ঢেউয়ে নৌকা যেমন দোলে, তেমনি দুলতে দুলতে নামছে মাটিতে।

ছোট্ট যে গাঁয়ে বাস থেকে নেমেছিল ওরা, সেটা পেছনে ফেলে এল। খুব ভাল লাগছে হাঁটতে। আঁকাবাঁকা সরু পথে নেমেছে এখন। দু-ধারে পাতাবাহারের ঝাড় এত ঘন হয়ে জন্মেছে, আর এত উঁচু, ওপর দিয়ে দেখা যায় না ওপাশে কি আছে। মাথার ওপরে ডালপাতা দু-পাশ থেকে এসে গায়ে গায়ে লেগে চাদোয়া তৈরি করে দিয়েছে, তার ফাঁক-ফোকর দিয়ে চুইয়ে আসছে যেন আলো।

এ-তো দেখি একেবারে সুড়ঙ্গ, বলল মুসা। নাম কি জায়গাটার?

এটার নাম কি ঠিক বলতে পারছি না, বলল কিশোর। তবে এটা হরিণ পাহাড়ে চলে গেছে।

হরিণ পাহাড়? ভুরু কোঁচকাল রবিন। ডিয়ার হিল। বাংলা করলে হরিণ পাহাড়ই পঁড়ায়, নাকি?

হ্যাঁ, তা হয়, তার বাংলা শব্দের সীমিত ভাণ্ডার খুঁজল রবিন। শুনতেও ভাল লাগছে।

ঐখানের নামগুলোই সুন্দর। অন্ধ উপত্যকা, হরিণ পাহাড়, কুয়াশা হ্রদ, হলুদ দীঘি, ঘুঘুমারি…

ওফ, দারুণ তো! বলে উঠল জিনা। অরিজিনাল নামগুলো কি?

ব্লাইন্ড ভ্যালি, ডিয়ার হিল, মিসটি লেক, ইয়েলো পণ্ড, ডাভ ডেথ…

অপূর্ব! বলল রবিন। বাংলা ইংরেজি দুটোই।

বাংলাটাই থাক না তাহলে? দ্বিধা করছে কিশোর, যার যার মাতৃভাষা তার কাছে প্রিয়, বন্ধুরা আবার কি মনে করে। বাইরের কারও সঙ্গে বলার সময় লাগছেন করুক, ইংরেজিই বলতে হবে, আমরা নিজেরা নিজেরা…

আমি রাজি। আমার কাছে বাংলাই ভাল লাগছে, সঙ্গে সঙ্গে বলল মুসা। নিজের ভাষা কিছু কিছু জানি, কিন্তু সেটা না জানারই শামিল, বাংলার চেয়েও কম জানি। সেই কবে কোন কালে আফ্রিকা ছেড়ে চলে এসেছিল আমার দাদার দাদা…ভুল বললাম, চলে আসেনি, জোর করে ধরে আনা হয়েছিল, গোলাম করে রাখার জন্যে…শ্বেতাঙ্গরা…

আড়চোখে জিনার দিকে চেয়ে তাড়াতাড়ি হাত তুলল কিশোর, থাক থাক, পুরানো ইতিহাস ঘাটাঘাটির দরকার নেই, ঝগড়া লেগে যাবে এখন। ছুটির আনন্দই মাটি হবে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম…

কথা বলতে বলতে এগোচ্ছে ওরা।

হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল রাফিয়ান। খরগোশের গন্ধ পেয়েছে।

আরিব্বাপরে! জিন অবাক। এত্তো খরগোশ! এই দিনের বেলায়? আমার গোবেল দ্বীপেও তো এত নেই।

হরিণ পাহাড়ে এসে উঠল ওরা। বসল, খরগোশ দেখার জন্যে। রাফিয়ানকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল, কিছুঁতেই আটকে রাখা যাচ্ছে না। খরগোশের গন্ধে পাগল হয়ে গেছে যেন সে। এক ঝাড়া দিয়ে জিনার হাত থেকে বেল্ট ছুটিয়ে নিয়েই দিল দৌড়।

রাফি! রাফি! চেঁচিয়ে উঠল জিনা।

কিন্তু কে শোনে কার কথা? রাফিয়ানের কানেই ঢুকল না যেন ডাক, তার এক চিন্তা, খরগোশ ধরবে।

এত বোকা নয় খরগোশেরা যে চুপচাপ বসে থেকে কুকুরের খপ্পরে পড়বে। সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল গর্তে। ভোজবাজির মত, এই ছিল এই নেই।

অনেক চেষ্টা করেও একটা খরগোশ ধরতে পারল না রাফিয়ান। তার কাণ্ড দেখে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল মুসা আর জিনা।

অবশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল ব্যর্থ রাফিয়ান, জিভ আধহাত বেরিয়ে পড়েছে।

ভুল নাম রেখেছে, বলল রবিন। নাম রাখা উচিত ছিল আসলে খরগোশ পাহাড়। চলো, উঠি।

চূড়া পেরিয়ে পাহাড়ের উল্টোদিকের ঢাল ধরে নামতে শুরু করল ওরা। এদিকে খরগোশ যেন আরও বেশি। রাফিয়ান বোধহয় ভাবল, অন্যপাশের চেয়ে এপাশের ওরা বোকা, তাই আবার তাড়া করল।

সেই একই কাণ্ড। সুড়ুৎ।

রেগে গেল রাফিয়ান। গর্তে ঢোকা? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা। বড় একটা খরগোশকে বাইরে দেখে তাড়া করল। খরগোশটাও সেয়ানা। এঁকেবেঁকে এপাশে ওপাশে লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল বড় একটা গর্তের ভেতর।

কোন রকম ভাবনাচিন্তা না করেই মাথা ঢুকিয়ে দিল রাফিয়ান, ঢুকে গেল গর্তে। তারপরই পড়ল বিপদে। আটকে গেল শরীর। না পারছে ঢুকতে, না বেরোতে। অসহায় ভাবে পেছনের পা ছুঁড়তে লাগল শুধু।

আরে! দৌড় দিল জিনা। এই রাফি, রাফি, বেরিয়ে আয়। আয় জলদি।

বেরোতে পারলে তো বাঁচে এখন রাফিয়ান, জিনার ডাকের কি আর অপেক্ষা করে? কিন্তু পারছে তো না। পেছনের পায়ের নখ দিয়ে আঁচড়ে ধুলোর ঝড় তুলেছে, বেরোনোর চেষ্টায়।

পুরো বিশ মিনিট লাগল রাফিয়ানকে বের করে আনতে। প্রথমেই গর্তে ঢোকার চেষ্টা করল মুসা। তার বিরাট শরীর ঢুকল না। কিশোর আর জিনাও ঢুকতে পারল না। রোগা-পটকা ক্ষীণ দেহ একমাত্র রবিনের, তাকেই মাথা ঢোকাতে হলো অবশেষে।

রাফিয়ানের পেছনের পা ধরে টানতে লাগল রবিন, তার অর্ধেক শরীর গুহার বাইরে, অর্ধেক ভেতরে। কুকুরটার কাঁধের পেছন দিক আটকে গেছে একটা মোটা শেকড়ে, টেনেও বের করা যাচ্ছে না। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল।

আহ, এত জোরে টেনো না, চেঁচিয়ে উঠল জিনা। ব্যথা পাচ্ছে তো।

জোরে টেনেও তো বের করতে পারছি না, গর্তের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিল রবিন। জোর পাচ্ছি না। আমার পা ধরে টানো।

অনেক টানা-হেঁচড়ার পর বের করা গেল অবশেষে। বিধ্বস্ত চেহারা, কুঁইকুই করে গিয়ে জিনার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ল রাফিয়ান। খুব ভয় পেয়েছে বেচারা।

সাংঘাতিক ব্যথা পেয়েছে কোথাও, কুকুরটার সারা গা টিপেটুপে দেখতে শুরু করল জিনা। চারটে পা-ই টেনে টেনে দেখল। ভাঙেনি। জখমও দেখা যাচ্ছে না। ব্যথা পেয়েছেই। নইলে এমন কো কো করত না। কিন্তু লাগল কোথায়?

ভয়ে অমন করছে, কিশোর বলল। জখম থাকলে তো দেখতামই। পা-ও ভাঙেনি।

কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারল না জিনা। পশু ডাক্তারকে দেখালে হয় না?

এখানে পশু ডাক্তার পাবে কোথায়? খামোকা ভাবছ। রাফিয়ান ঠিকই আছে। চলো, হাঁটি।

ঘুঘুমারিও পেরিয়ে এল ওরা। আলাপ-আলোচনা আর হাসিঠাট্টা তেমন জমছে। গুম হয়ে আছে জিনা। বার বার তাকাচ্ছে পাশে রাফিয়ানের দিকে। কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে।

ব্যথা পেয়েছে, এমন কোন ভাব দেখাচ্ছে না রাফিয়ান, ঠিকমতই হাঁটছে, মাঝে মাঝে গুঙিয়ে উঠছে শুধু।

এখানেই লাঞ্চ সারা যাক, কি বলো? আরেকটা পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হ্যাঁ, তা যায়, মাথা কাত করল মুসা। নাম কি এটার?

ম্যাপে কোন নাম নেই। তবে আমি রাখতে পারি..ঢালু পাহাড়? খুব মানাবে। দেখেছ, কেমন ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেক দূর… স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে কিশোরের অপূর্ব সুন্দর দুই চোখ।

ভাল লাগার মতই দৃশ্য। মাইলের পর মাইল একটানা ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল নিঃসঙ্গ প্রান্তর, ঘন সবুজ ঘাস চকচক করছে রোদে। তাতে চরছে লাজুক হরিণ আর উদ্দাম ছোট ছোট বুনো ঘোড়া। যেন পটে আঁকা ছবি।

বসে পড়ল ওরা ঘাসের গুচ্ছের নরম কার্পেটে।

অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধূলি, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি, দিগন্তের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল কিশোর, মন চলে গেছে তার হাজার হাজার মাইল দূরের আরেক স্বপ্নরাজ্যে, তার স্বপ্নের বাংলাদেশে। সেই দেশটাও কি এত সুন্দর, ভাবল সে, কবিতা পড়ে তো মনে হয় এর চেয়েও সুন্দর।

দেশটা সত্যি ভারি সুন্দর, কিশোরের মতই দূরে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। এই সবুজ একদিন ঢেকে যাবে ধবধবে সাদা বরফে, তুষার ঝরবে পেঁজা তুলোর মত, আকাশের মুখ অন্ধকার, মেরু থেকে ধেয়ে আসবে হাড় কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডা…

ওদিকে স্যাণ্ডউইচগুলো তো কাঁদতে শুরু করেছে, খাচ্ছি না বলে, বেরসিকের মত বাধা দিল মুসা। কাব্যচর্চা রেখে আগে পেটচৰ্চা সেরে নাও। আরে এই জিনা, এত গভীর হয়ে আছো কেন? তোমার মুখ কালো দেখলে তো আমার বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে…

অন্য সময় হলে কথার-করাত চালাত জিনা, এখন শুধু মাথা নাড়ল। রাফি…

দূর, তুমি খামোকা ভাবছ। কিচ্ছু হয়নি। দেখো, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। পেটে বোধহয় খিদে দেখছ না আমার কেমন খারাপ লাগছে? ওরও বোধহয় তেমনি…

মুসার কথায় হেসে ফেলল জিনা। অন্যদের মুখেও হাসি ফুটল।

হুঁ, সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মুসা, দারুণ হয়েছে। ডিকের মায়ের হাতে যাদু আছে। নে, রাফি, এই কাবাবটা চেখে দেখ।

কাবাব চিবাতে চিবাতে আস্তে মাথা নাড়ল রাফিয়ান, গোঁ করে উঠল। ব্যথায়,

কেন, সে-ই জানে। কিন্তু এটাকেই সম্মতি ধরে নিয়ে মুসা হাসল, কি, বলেছি না ভাল?

সবার চেয়ে অনেক বেশিই খেলো রাফিয়ান, তবে চুপচাপ রয়েছে। এই ব্যাপারটাই ভাল লাগছে না জিনার।

একেক জনের ভাগে তিনটে করে স্যাণ্ডউইচ বাঁচল। আর অর্ধেক টুকরো করে কেক। বাকি সব সাবাড় করে ফেলেছে।

ডিকের চেয়ে কম কি আমরা? ভুরু নাচাল মুসা। ও ছ-টা খায়, আমরা পাঁচটা…

তুমি সাতটা খেয়েছ, শুধরে দিল রবিন। নিজেদেরগুলো সেরেও আমাদের ভাগ থেকে মেরেছ তুমি আর রাফি…

ঘউ, করে স্বীকার করল যেন রাফিয়ান। কেকের টুকরোর দিকে চেয়ে লেজ নাড়ছে। জিভে লালা। তাকে কেক দেয়া হয়নি।

বলেছিলাম না, খেলেই ভাল হয়ে যাবে রাক্ষসটা, হেসে বলল মুসা। নে খা, তুই আমার কাছ থেকেই নে… খানিকটা কেক ভেঙে কুকুরটার মুখের কাছে ফেলল।

এক চিবান দিয়েই কোত করে গিলে ফেলল রাফিয়ান। করুণ চোখে তাকাল মুসার হাতের বাকি কেকটুকুর দিকে।

তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিল মুসা। না বাবা, আর দিচ্ছি না। রাতে খেতে হবে আমার। তুমি বাপু যত পাও ততই চাও…

হাসল সবাই। কেটে গেল নিরানন্দ ভাবটা।

চলো, ওঠা যাক, বলল কিশোর। পাঁচটার আগেই ফার্মটায় পৌঁছতে হবে। এখানে আবার তাড়াতাড়ি রাত নামে।

কোন ফার্ম? জানতে চাইল রবিন।

হলুদ দীঘি।

যদি থাকার জায়গা না থাকে?

জিনাকে একটা ঘর দিতে পারলেই হলো। আমরা গোলাঘরে খড়ের গাদায়ই ঘুমোতে পারব।

কেন, আমি পারব না কেন? গলা লম্বা করে ঝাঁকি দিল জিনা।

কারণ, তুমি মেয়ে। ছেলের পোশাক পরে আছে বটে, কিন্তু মেয়ে তো।

দেখো, মেয়ে মেয়ে করবে না। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কম কিসে?

তাহলে ছেলে সেজে থাকো কেন? ফস করে বলে বসল মুসা।

থাকি, থাকি, আমার খুশি,রেগে উঠল জিনা। তোমার কি?

এই তো রেগে গেল, বিরক্ত হয়ে উঠল কিশোর। তোমাদের জ্বালায় বাপু শান্তিতে পরামর্শ করারও জো নেই। জিনা, খামাকো জেদ করছ। তুমি মেয়ে, কিছু অসুবিধে তোমার আছে, ছেলেদের যা নেই। এটা কি অস্বীকার করতে পারবে?

চুপ করে রইল জিনা। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবে আর তর্ক করল না। আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখল।

মালপত্রের বোঝা পিঠে তুলে নিয়ে আবার রওনা হলো ওরা। রাফিয়ান শান্ত। লাফঝাপ সব যেন ভুলে গেছে, জোরে হাঁটার চেষ্টাও করছে না। পা ফেলছে অতি সাবধানে, মেপে মেপে।

ব্যাপারটা জিনার চোখ এড়াল না। কি হয়েছে রাফি? খারাপ লাগছে?

জবাবে শুধু কাঁউ করল কুকুটা।

আরও খানিক দূর যাওয়ার পর খোড়াতে শুরু করল রাফিয়ান। পেছনের বাঁ পা ঠিকমত ফেলতে পারছে না।

থামল সবাই।

বসে পড়ে পা-টা ভালমত দেখল জিনা। মনে হয় মচকেছে, রাফিয়ানের পিঠে হাত বোলাল সে।

মৃদু গাউক করে উঠল রাফিয়ান।

যেখানে হাত লাগলে ব্যথা পায় কুকুরটা, সে জায়গার নোম সরিয়ে দেখল জিনা। আরে, যখম! রঞ্জু জমেছে, ফুলেছেও। ওইটানাটানির সময়ই লেগেছিল।

দেখি তো, বসে পড়ে কিশোরও দেখল। না, বেশি না। সামান্য। রাতে ঘুমোলেই সেরে যাবে।

কিন্তু শিওর হওয়া দরকার, খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে জিনাকে। কিশোর, গ্রাম আর কদ্দূর?

এই সামনেই। র‍্যাংকিন ভিলেজ। গায়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, পশু ডাক্তার কোথায় পাওয়া যাবে।

জলদি চলো। ইস, কেন যে এত বড় হলো কুকুরটা, নইলে কোলে করেই নিতে পারতাম। হাঁটতেই পারছে না বেচারা।

যা পারে হাঁটুক এখন, বলল মুসা। একেবারে না পারলে তো বয়ে নিতেই হবে। সে তখন দেখা যাবে।

খুব আস্তে আস্তে হাঁটছে রাফিয়ান। বেশি খোড়াচ্ছে। শেষে আর পা-ই ফেলতে পারল না। মচকানো পা-টা তুলে তিন পায়ে লাফিয়ে এগোল।

ইস, কি কষ্ট বেচারারকেঁদে ফেলবে যেন জিনা।

র‍্যাংকিন ভিলেজে এসে ঢুকল বিষণ্ণ দলটা। গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে একটা সরাইখানা, নাম র‍্যাংকিন রেস্ট।

ঝাড়ন দিয়ে জানালার কাচের ধুলো ঝাড়ছে এক মহিলা।

কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ম্যাডাম। কাছাকাছি পশু ডাক্তার কোথায় আছে?

রাফিয়ানের দিকে তাকাল মহিলা। কাছাকাছি বলতে তো ছ-মাইল দূরে, ডারবিনে।

শুকিয়ে, এতটুকু হয়ে গেল জিনার মুখ। ছয় মাইল! কিছুঁতেই হেঁটে যেতে পারবে না রাফিয়ান।

বাস-টাস কিছু আছে? জিজ্ঞেস করল জিনা।

না, বলল মহিলা। তবে মিস্টার নরিসকে বলে দেখতে পারো। তার ঘোড়ার গাড়ি আছে। কুকুরটার পা বেশি খারাপ?

হ্যাঁ। ম্যাডাম, তার বাড়ি কত দূর?

এই আধ মাইল। ওই যে পাহাড়টা, ওখান থেকে ডানে চাইলেই বাড়িটা দেখতে পাবে। বড় বাড়ি। দেখলেই চিনবে। চারপাশে আস্তাবল, ঘোড়া পালে মিস্টার নরিস। খুব ভাল মানুষ। যদি বাড়িতে না পাও, বোসসা কিছুক্ষণ। রাতে বাইরে থাকে না, যেখানেই যাক ফিরে আসবে।

দ্রুত পরামর্শ করে নিল চারজনে। কিশোর বলল, মিস্টার নরিসের কাছেই যেতে হবে বোঝা যাচ্ছে। তবে সবার যাওয়ার দরকার নেই। মুসা, রবিনকে নিয়ে তুমি হলুদ দীঘিতে চলে যাও। রাতে থাকার ব্যবস্থা করে রাখখাগে। আমি জিনার সঙ্গে যাচ্ছি। ফিরতে কত রাত হয় কে জানে।

ঠিক আছে, বলল মুসা। টর্চ আছে তো তোমার কাছে? গাঁয়ে তো রাস্তায় বাতি নেই, রাতে খুব অন্ধকার হবে।

আছে, জানাল কিশোর।

চলো, কিশোর, তাড়া দিল জিনা। রবিন আর মুসার দিকে চেয়ে হাত নেড়ে বলল, রাতে দেখা হবে।

জিনা আর কিশোর পাহাড়ের দিকে রওনা হলো। পাশে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে রাফিয়ান।

সেদিকে চেয়ে আনমনে বলল মুসা, ভাল হয়ে গেলেই বাঁচি। নইলে ছুটিটাই মাটি হবে।

ঘুরে আরেক দিকে রওনা হলো সে আর রবিন।

নির্জন পথ।

এক জায়গায় একটা লোকের সঙ্গে দেখা হলো। টমটম চালিয়ে আসছে। বিষণ্ণ চেহারা, মাথাটা অনেকটা বুলেটের মত।

ডাকল মুসা।

ঘোড়ার রাশ টেনে থামাল লোকটা।

এ-রাস্তা কি ইয়েলো পণ্ডে গেছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।

আ, মাথা নুইয়ে বলল লোকটা।

সোজা? নাকি ডানে বাঁয়ে আর কোন গলি আছে?

আ, আবার মাথা নোয়াল লোকটা।

এটাই পথ তো? মানে ওদিকে যেতে হবে? গলা চড়িয়ে হাত নেড়ে দেখাল মুসা।

আ, বলে চাবুক তুলে পেছন দিক দেখাল লোকটা, তারপর পশ্চিমে দেখাল।

ডানে ঘুরতে হবে?

আ, মাথা নোয়াল লোকটা। হঠাৎ খোঁচা মারল ঘোড়ার পেটে। লাফিয়ে সামনে বাড়ল ঘোড়া, আরেকটু হলেই দিয়েছিল মুসার পা মাড়িয়ে।

খালি তো আ আ করল, মুসার মতই রবিনও অবাক হয়েছে লোকটার অদ্ভুত ব্যবহারে। কি বোঝাল সে-ই জানে।

হঠাৎ করেই নামল রাত। সূর্য ডোবার পর অন্ধকার আর সময়ই দেয়নি সাঁঝকে। কাল মেঘ জমেছে আকাশে।

এ কি কাণ্ড দেখো, গম্ভীর হয়ে বলল মুসা। দিনটা কি ভাল গেল। বোঝাই যায়নি বৃষ্টি আসবে।

তাড়াতাড়ি চলো, বলল রবিন। ভিজে চুপচুপে হয়ে যাব। মাথা বাঁচানোরও জায়গা নেই।

মোড় নিয়ে কয়েক কদম এগিয়েই থমকে গেল দুজনে। খুব সরু পথ, পাতাবাহারের ঝোপের সুড়ঙ্গ। সকালে এমন একটা পথে হেঁটে এসেছে। দিনের বেলায়ই আবছা অন্ধকার ছিল ওটাতে। এটাতে এখন গাঢ় অন্ধকার।

ঠিক পথেই যাচ্ছি তো? মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।

কি জানি। রবিনও বুঝতে পারছে না।

যা থাকে কপালে, ভেবে রবিনের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল মুসা। কয়বার মোড় নিয়েছে পথ, কতখানি এঁকেবেঁকে গেছে, কিছুই বোঝা গেল না। অন্ধের মত এগিয়ে চলেছে দুজনে। জুতোর তলায় ছপছপ করছে কাদা-পানি।

নর্দমায় নামলাম না তো? মুসা বলল। জুতোর ভেতর পানি ঢুকছে।

আমারও সুবিধে লাগছে না, মুসা। যতই এগোচ্ছি, পানি কিন্তু বাড়ছে। শেষে গিয়ে কুয়া-টুয়ায় না পড়ে মরি।

টর্চটা কোথায় রাখলাম? ব্যাগের ভেতরে খুঁজছে মুসা। ফেলে এলাম, না কি? রবিন, তোমারটা বের করো তো।

টর্চ বের করে দিল রবিন।

জ্বালল মুসা। আলোর চারপাশ ঘিরে যেন আরও ঘন হলো অন্ধকার। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল সে। সামনে একটু দূরে, এক জায়গায় কাঠের বেড়া শুরু হয়েছে রাস্তার এক পাশ থেকে, ওখানে খানিকটা জায়গায় পাতাবাহার নেই, কেটে সাফ করা হয়েছে বোধহয়। পথটা সরু খালের মত, দু-ধারে উঁচু পাড়।

বেড়াটা নিশ্চয় কোন ফার্মে গিয়ে শেষ হয়েছে, বলল মুসা। আস্তাবল কিংবা গরুর খোঁয়াড় পেলেও মাথা বাঁচাতে পারি, ভিজতে হবে না। চলো, দেখি।

পাড়ে উঠে বেড়া ধরে ধরে এগোল ওরা। ফসলের খেতের মাঝখান দিয়ে সরু পথ।

মনে হচ্ছে এটা শর্টকাট, আন্দাজ করল মুসা। ফার্ম হাউসটা বোধহয় আর বেশি দূরে না।

একটা দুটো করে ফোঁটা পড়তে শুরু করল, যে কোন মুহূর্তে ঝুপঝুপ করে নামবে বৃষ্টি।

মুসার কথায় আশ্বস্ত হতে পারল না রবিন। সত্যিই পাবে তো ফার্মটা?

জোরে নামল বৃষ্টি। বর্ষাতি বের করা দরকার। দ্রুত এদিক ওদিক তাকাল ওরা। কোথায় ঢুকে বের করা যায়? ব্যাগের মধ্যে পানি ঢুকলে সব ভিজে যাবে, দুর্ভোগ পোহাতে হবে তখন।

মাঠের মধ্যেই দুটো আলের মিলনস্থলে ঘন একটা পাতাবাহারের ঝোপ চোখে পড়ল। দৌড়ে এসে তার ভেতরে ঢুকল দুজনে। ব্যাগ খুলে বর্ষাতি বের করল।

বৃষ্টি নামায় আরও ঘন হলো অন্ধকার। টর্চের আলো বেশি দূর যাচ্ছে না।

আলো তো দেখছি না, বলল রবিন। কই ফার্মটা?

কি জানি। বুঝতে পারছি না। ফিরে গিয়ে আবার সুড়ঙ্গে নামব? নাহ, তা-ও বোধহয় ঠিক হবে না।

পথ যখন রয়েছে, নিশ্চয় কোথাও গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু কোথায়?

না বুঝে আর এগোনোর কোন মানে হয় না। দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে ভাবছে। ওরা, কোন দিকে যাবে? কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেল রবিন।

হঠাৎ করে এমনভাবে শুরু হলো শব্দটা, চমকে উঠল দুজনে। একে অন্যের হাত চেপে ধরল। নির্জন মাঠে, অন্ধকার রাতে এই দুর্যোগের মাঝে অদ্ভুত শোনাচ্ছে।

ঘণ্টার শব্দ।

বেজেই চলেছে। প্রলয়ের সঙ্কেত যেন। অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল দুই কিশোরের।

কোথায় বাজছে? এভাবে? ফিসফিস করল রবিন, জোরে বলার সাহস নেই।

কোথায় বাজছে মুসা জানবে কি করে? সে-ও রবিনের মতই চমকে গেছে। কাছাকাছি নয়, দূরে কোথাও বাজছে। কখনও জোরে, কখনও আস্তে। এলোমেলো বাতাস বইছে, একবার এদিক থেকে, একবার ওদিক। বাতাস সরে গেলে শব্দও কমে যাচ্ছে, যে-ই বাড়ছে, অমনি যেন তাদেরকে ঘিরে ধরছে বিচিত্র ঘণ্টা-ধ্বনি।

ইস, থামে না কেন? দুরুদুরু করছে মুসার বুক। গির্জার ঘণ্টা নয়।

না, তা-তো নয়ই, কেঁপে উঠল রবিনের গলা। কোন ধরনের সঙ্কেত হতে পারে…আমি শিওর না। অস্বস্তিতে হাত নাড়ল সে। বিড়বিড় করল, যুদ্ধ?.. বীকন কই?

কি বিড়বিড় করছ?

অ্যাঁ?…বীকন। পুরানো আমলে যুদ্ধ লাগলে ওভাবে ঘণ্টা বাজিয়ে হুঁশিয়ার করা হত গাঁয়ের লোককে। সেই সঙ্গে আলোর সঙ্কেত-বীকন বলা হত।

এখন তো পুরানো আমল নয়… চমকে থেমে গেল মুসা।

রবিনের কথার মানে বুঝে ফেলেছে। কি বলতে চাইছ?

বুঝেছ তুমিও। এখন পুরানো আমল নয়, তাহলে অন্ধকারে ঝড়-বৃষ্টির মাঝে ওই ঘণ্টা…

চুপ চুপ ! আর বোলো না, ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাল মুসা। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না। টর্চের রশ্মির সামনে শুধু অগুনতি বৃষ্টির ফোঁটা।

যেমন শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল শব্দ।

এরপরও কান পেতে রইল দুজনে। কিন্তু আর শোনা গেল না।

চলো, হাঁটি, বলল মুসা। ফার্মটা খুঁজে বের করা দরকার। আবার কখন শুরু হয়ে যায়…

বেড়ার ধার ধরে আবার এগিয়ে চলল ওরা।

কতক্ষণ পর বলতে পারবে না, আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ওই যে।

মুসাও দেখল। আলো। না, বীকন নয়, জ্বলছে-নিভছে না। একভাবে জ্বলছে টিমটিম করে।

পাওয়া গেল বাড়িটা, জোরে নিঃ বাস ফেলল মুসা।

কাঠের বেড়া শেষ। একটা পাথরের দেয়ালের কাছে চলে এল ওরা। ওটার পাশ দিয়ে এল ভাঙাচোরা একটা গেটের কাছে।

ভেতরে পা রেখেই লাফিয়ে সরে এল রবিন।

কি হলো? জিজ্ঞেস করল মুসা।

আলো ফেলো তো। ডোবায় না পড়ি।

দেখা গেল, ডোবায়,পা ডোবেনি রবিনের, বৃষ্টির পানি জমেছে ছোট একটা গর্তে। গর্তটার পাশ কাটিয়ে এল দুজনে।

কাদা প্যাঁচপ্যাঁচ করছে সরু পথে। পথের শেষ মাথায় বাড়ির সাদা দেয়াল, ছোট একটা দরজা। পেছনের দরজা হবে, ভাবল মুসা। পাশের জানালা দিয়ে আলো আসছে।

জানালার কাছে এসে ভেতরে উঁকি দিল ওরা। মাথা নিচু করে সেলাই করছে এক বৃদ্ধা।

দরজার পাশে ঘণ্টার দড়ি-টুড়ি কিছু দেখতে পেল না মুসা। জোরে ধাক্কা দিল। সাড়া নেই। বন্ধ রইল দরজা। উঁকি দিল আবার জানালা দিয়ে। তেমনি ভাবে সেলাই করছে মহিলা, নড়েওনি।

কানে শোনে না নাকি? বলতে বলতেই দরজায় কিল মারল মুসা। সাড়া মিলল না এবারও। খবরই নেই যেন মহিলার।

এভাবে কিলাকিলি করে কিছু হবে না, দরজার নব ধরে মোচড় দিল মুসা।

ঘুরে গেল নব। ঠেলা দিতেই পাল্লাও খুলল।

পা মোছার জন্যে হেঁড়া একটা মাদুর বিছানো রয়েছে পাল্লার ওপাশে। তারপরে সরু প্যাসেজ। প্যাসেজের মাথায় পাথরের সিঁড়ি। সদর দরজার কাছেই ডানে আরেকটা দরজা, পান্না সামান্য ফাঁক। হারিকেনের স্নান আলো আসছে।

ঠেলে পাল্লা পুরো খুলে ভেতরে পা রাখল মুসা। তার পেছনে রবিন।

তবু তাকাল না মহিলা। সেলাই করেই চলেছে।

একেবারে তার সামনে এসে দাঁড়াল মুসা।

এইবার দেখতে পেল বৃদ্ধা। চমকে এত জোরে লাফিয়ে উঠল, ঠেলা লেগে উল্টে পড়ে গেল তার চেয়ার।

সরি, এভাবে চমকে যাবে বৃদ্ধা, ভাবেনি মুসা। দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলাম। শোনেননি।

বুকে হাত চেপে ধরে আছে মহিলা। ইস্, কি ভয়ই না দেখালে!…কে তোমরা? এই অন্ধকারে কোত্থেকে?

চেয়ারটা তুলে আবার জায়গামত সোজা করে রাখল মুসা। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। এটা কি ইয়েলো পণ্ড ফার্ম? এর খোজেই এসেছি আমরা। রাতটা কাটানো যাবে? আরও দুজন আসছে।

তর্জনীর মাথা দিয়ে বার দুই কানে টোকা দিল মহিলা, মাথা নাড়ল। শুনি না। ইশারায় বলো। পথ হারিয়েছ?

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

এখানে তো থাকতে পারবে না, আমার ছেলে পছন্দ করে না এসব। ও এল বলে। সাংঘাতিক বদরাগী। চলে যাও।

মাথা নাড়ল মুসা। জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টিভেজা রাত দেখল। তার আর

রবিনের ভেজা জুতো আর কাপড় দেখাল।

হুঁ, পথ হারিয়েছ তোমরা। ভিজেছ। ক্লান্ত। যেতে চাও না, এই তো? আমার ছেলেকে নিয়ে যে বিপদ। অচেনা কাউকে সহ্য করতে পারে না।

রবিনকে দেখাল মুসা, তারপর হাত তুলে কোণের একটা সোফা দেখাল। নিজের বুকে হাত রেখে সরিয়ে এনে নির্দেশ করল দরজার দিকে।

বুঝল মহিলা। তোমার বন্ধু সোফায় থাকবে বলছ। তুমি বাইরে কোন ছাউনি কিংবা গোলাঘরে কাটিয়ে দিতে পারবে।

আবার মাথা ঝাঁকাল মুসা।

কিন্তু সেই একই ব্যাপার, আমার ছেলে পছন্দ করে না… রবিন আর মুসার ভেজা মুখের দিকে চেয়ে অবশেষে বোধহয় করুণা হলো মহিলার। হতাশ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে এগোল একটা দেয়াল-আলমারির দিকে।

দরজা খুলল। আলমারি মনে করেছে দুই গোয়েন্দা, আসলে ওটা ঘরের আরেকটা দরজা। ওপাশ থেকে খুব সরু কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে।

রবিনকে বলল মহিলা, তুমি ওপরে চলে যাও। কাল সকালে আমি না ডাকলে আর নামবে না। আহ, যাও দেরি কোরো না।

মুসার দিকে চেয়ে দ্বিধা করছে রবিন। তুমি?

তুমি যাও তো, রবিনের হাত ধরে ঠেলে দিল মুসা। আমি গোলাঘরে গিয়ে থাকি। গিয়ে দেখো জানালা-টানালা আছে কিনা। রাতে বেকায়দা দেখলে ডেকো। নিচেই থাকতে হবে আমাকে।

ঠিক আছে, গলা কাঁপছে রবিনের, অনিচ্ছাসত্ত্বেও পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে।

নোংরা পুরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল খুদে একটা চিলেকোঠায়। একটা মাদুর আছে, পরিষ্কারই, আর একটা চেয়ার। একটা কম্বল ভঁজ করা রয়েছে চেয়ারের হেলানে, বসার জায়গায় এক জগ পানি।

ছোট জানালাও আছে একটা। ওটা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ডাকল রবিন, মুসা? মুসা?

হ্যাঁ, শুনছি, নিচ থেকে সাড়া দিল মুসা। চুপচাপ শুয়ে থাকো। অসুবিধে না হলে আর ডেকো না।

Categories: