৪. টেরি গভীর ঘুমে অচেতন, পাসেই শুয়ে পাহারা দিচ্ছে রাফি

0 Comments

জিনার সেই দ্বীপ – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ: জুলাই, ১৯৯৪

অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করেও টেরির কাছ থেকে কোন তথ্য আদায় করা গেল না। আসলেই কিছু জানে না সে।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, রাতে যে একটা জাহাজ এসে সঙ্কেত দেয়, এ ব্যাপারেও কিছু জানো না?

মাথা নাড়ল টেরি। সঙ্কেতের কথা কিছু জানি না। তবে মাকে বলতে শুনেছি, আজ রাতে যোগাযোগ করার কথা মারিয়ার।

মারিয়া!কি ওটা? জাহাজ, বোট, না কোন মানুষ?

 জানি না। জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম, মাথায় গাট্টা মারল বাবা।

তারমানে গুরুত্ব আছে। গোপন ব্যাপার, তোমাকে জানাতে চায়নি। বেশ, আজ রাতে নজর রাখব আমরা।

সারাটা দিন গুহা থেকে বেরোল না ওরা, বেরোতে পারল না, টোডদের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে।

বহুযুগ পরে যেন অবশেষে সন্ধ্যা হলো। রাত নামল। তাড়াতাড়ি খাওয়ার পাট চুকিয়ে নিল সবাই। ভাল খাবার পেয়ে এত খাওয়া খেলো টেরি, পেট ভারী করে ফেলল। তারপর আর বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারল না। বালিতেই শুয়ে নাক ডাকাতে শুরু করল, অনেকটা বাপের মত করে।

দু-জন দু-জন করে পালা করে পাহারা দেবে, চোখ রাখবে সাগরের ওপর, ঠিক করল কিশোর। প্রথম উঠে গেল সে আর জিনা। রাত সাড়ে বারোটায় নেমে এসে মুসা আর রবিনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে জানাল, কিছু দেখেনি। ওদেরকে যেতে বলল।

টেরি গভীর ঘুমে অচেতন। তার কাছেই শুয়ে আছে রাফি। পাহারা দিচ্ছে।

ফোকরের বাইরে বেরোল দুই গোয়েন্দা।

চাঁদ উঠেছে। ঘোলাটে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিয়েছে সাগরের ওপর। আকাশে প্রচুর হালকা মেঘ, ছুটছে দিগ্বিদিক, আপাতত বৃষ্টি হওয়ার কোন লক্ষণ নেই।

আধঘণ্টা মত গেছে, হঠাৎ কানে এল কথার শব্দ।

রবিনের কানে কানে বলল মুসা, টোডরা বেরিয়েছে। ভাঙা জাহাজে যাচ্ছে বোধহয়।

দাঁড়ের শব্দ শোনা গেল। খানিক পরেই নৌকাটাও নজরে এল দু জনের।

মুসার গায়ে কনুই দিয়ে গুঁতো মারল রবিন। নীরবে হাত তুলে দেখাল সাগরের দিকে।

বেশ অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে আলো। আগের রাতের মতই জ্বলছে নিভছে। চাঁদের আলোয় বড় একটা বোটের অবয়বও দেখা যাচ্ছে, সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে ওটা থেকেই।

মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল চাঁদ। অন্ধকার হয়ে গেল সাগর। আর কিছু চোখে পড়ছে না।

একটু পরেই মেঘ সরে গেল।

ওই যে, আরেকটা নৌকা, মুসা বলল। বোটের কাছ থেকে আসছে।

নিশ্চয় দেখা করবে একটা আরেকটার সঙ্গে। মাল পাচার করে এভাবেই।

ঠিক এই সময় নিতান্ত বেরসিকের মত আবার মেঘের আড়ালে চলে গেল চাঁদ। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না গোয়েন্দারা। দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। গলা বাড়িয়ে দিয়েছে বকের মত। কিন্তু আলো না থাকলে কিছু করেই লাভ নেই।

কোন জায়গায় মিলিত হলো নৌকাদুটো, দেখতে পেল না ওরা। আবার যখন চাঁদ বেরোল, তখন দেখল, বোটের কাছ থেকে আসা নৌকাটা চলে যাচ্ছে।

বসেই রইল ওরা।

প্রায় বিশ মিনিট পর টোডদের নৌকাটাকে তীরে ভিড়তে দেখল।

কোন পথে ওপরে উঠল ওরা, দেখতে পেল না গোয়েন্দারা। দেখল, যখন একেবারে দুর্গের কাছে চলে এসেছে।

টোডের হাতে বড় বান্ডিলের মত একটা জিনিস।

অনেক মাল এনেছে আজ, ফিসফিস করে বলল মুসা।

এই সময় দুজনকেই চমকে দিয়ে শোনা গেল একটা চিৎকার, অনেকটা আর্তচিৎকারের মত। ভয়ে, বিরক্তিতে, যন্ত্রণায় কেঁদে উঠেছে যেন কোন ছোট্ট মেয়ে।

.

গুহায় ফিরে জিনা আর কিশোরকে সব জানাল দুজনে।

বুঝতে পেরেছি, বলে উঠল কিশোর, আর কোন সন্দেহ নেই!

কি বুঝেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।

বাচ্চাদের কম্বল, পুতুল, এসব।

আবার গ্রীক!

খুব সহজ করেই বলেছি। স্মাগলিং নয়, কিডন্যাপি।

তুমি বলতে চাইছ, রবিনের কণ্ঠে উত্তেজনা, কোন বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপ করে এনেছে টোডরা?

কিডন্যাপটা সম্ভবত জাহাজের লোকগুলো করেছে। মারিয়া ওটার নামও হতে পারে, মেয়েটার নামও হতে পারে। এনে তুলে দিয়েছে টোডদের হাতে। লুকিয়ে রাখার জন্যে। মেয়েটা যাতে শান্ত থাকে, সে জন্যে আগেই তার পুতুলগুলো এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কাপড়-চোপড়ও দরকার, সে জন্যে ওগুলো এনেছে।

খাইছে। তার মানে টোডের হাতের বান্ডিলটা মানুষ!

 হ্যাঁ। আমার অনুমান ঠিক হলে, ছোট্ট মেয়েটা। তাকে বের করে আনতে হবে আমাদের।

অনেক ঘুমিয়ে ঘুম পাতলা হয়ে গেছে টেরির। কথাবার্তায় জেগে গেল। কিশোরের শেষ কথাটা কানে গেছে। জিজ্ঞেস করল, কাকে বের করে আনবে?

সেটা তোমার জানার দরকার নেই।

ধাড়ি বেঙগুলো নিশ্চয় পাহারায় থাকবে, মুসা বলল। আনব কি করে?

একটা উপায় বেরিয়ে যাবেই।

রাত এখনও অনেক বাকি। আর কিছু করার নেই। রাফির ওপর টেরিকে পাহারা দেয়ার ভার দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা ও জিনা। কয়েক মিনিট জেগে জেগে মা-বাবার কথা ভাবল টেরি। ভীষণ কান্না পেতে লাগল তার। শেষে কাঁদতেই শুরু করল, নীরবে। রাফির ভয়ে জোরে কাঁদার সাহস পেল না।

.

১৪.

পরদিন সকালে সবার আগে ঘুম ভাঙল কিশোরের। দড়ি বেয়ে উঠে এল ফোকরের বাইরে। সময়মতই বেরিয়েছে। দেখল, সিঁড়ির গর্ত দিয়ে বেরিয়ে আসছে দুই টোড। ঝোপের আড়ালে আড়ালে ওদের কাছাকাছি চলে গেল সে, কি বলে শোনার জন্যে।

টেরির জন্যে অস্থির হয়ে আছে দু-জনে।

মিসেস বলল, ও পাতালঘরে নেই, কতবার বলব! খোঁজা কি আর বাকি রেখেছি?,

অনেক ঘর অনেক গলিঘুপচি আছে ওর মধ্যে, উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তায় অনেক বেশি খসখসে হয়ে গেছে টোডের কণ্ঠ। বাকি থাকলেও জানছি কি করে?

যে ভাবে চিৎকার করে ডেকেছি, তার কানে শব্দ যেতই।

না-ও যেতে পারে। মাটির নিচের এসব ঘরগুলো ভয়ানক…

তোমার মাথায় গোবর ভরা আছে, মিস্টার টোড! রেগে গেল মিসেস। আমি বলছি ও এ দ্বীপে নেই। ওকে গায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

কারা নিল?

যারা জিনিসগুলো নিয়ে গেছে। গুরু-ছাগলের ডাক ডেকে ভয় দেখিয়েছে। নৌকায় তুলে ওরাই নিয়ে গেছে আমার টেরিকে…

নৌকাটা তাহলে কোথায় ছিল?

সেটা আমি কি জানি? ছিল নিশ্চয় কোথাও। লুকিয়ে রেখেছিল। পুরো। দ্বীপের কোথায় কি আছে না আছে সব কি আমরা জানি নাকি?

 কি করতে বলছ তাহলে?

গাঁয়ে গিয়ে খুঁজতে হবে। ভয় লাগছে আমার, জন। টেরির যদি কিছু হয়ে যায় আমি বাঁচব না…

তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। নিজের ছেলেকে যখন খুঁজে পাচ্ছে না, তখন কান্নাকাটি শুরু করেছে। যে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে ওরা, তার মায়ের কি অবস্থা, মা হয়েও একবার ভাবেনি।

এখুনি চলো, তাগাদা দিল মিসেস।

ডারবিকে কি করব?

এখানেই থাকবে। মেয়েটাকে পাহারা দিক।

অন্ধকারে একা থাকবে মেয়েটা, ভয় পাবে না?

ডারবি তো থাকছেই, ভয় কিসের? চলো, চলো, দেরি করলে কি হয়ে যায় কে জানে!

কি মহিলারে বাবা!–ভাবছে কিশোর। ছোট্ট একটা মেয়েকে অন্ধকার পাতালঘরে রেখে যেতে এতটুকু মন কাঁপছে না। তবে একদিক থেকে ভালই হবে। ওরা চলে গেলে নির্বিবাদে গিয়ে মেয়েটাকে বের করে আনা যাবে, ঝামেলা হবে না।

কুকুরটাকে রেখে চলে গেল টোডেরা।

দু-পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের চলে যেতে দেখল ডারবি। তারপর দৌড়ে ফিরে গেল চত্বরে, অলস ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল। দিনের আলোয় রোদের মধ্যে থেকেও ভারি অস্বস্তি বোধ করছে কুকুরটা। কান খাড়া, সারাক্ষণ তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। আজব এই দ্বীপটাকে মোটেও পছন্দ করতে পারছে না সে।

তাড়াতাড়ি এসে গুহায় ঢুকল কিশোর। বলল, বাইরে এসো সবাই। জরুরী কথা আছে। টেরি, তুমি বসে থাকো। এগুলো আমাদের কথা, তোমার শোনার দরকার নেই।

টেরির পাহারায় রইল রাফি। অন্যেরা কিশোরের সঙ্গে গুহার বাইরে বেরিয়ে এল।

শোনো, বলল কিশোর, টোডেরা নৌকায় করে গায়ে চলে গেছে। টেরিকে খুঁজতে। বাচ্চা মেয়েটাকে রেখে গেছে পাতালঘরে, ডার্টির পাহারায়। মিসেস টোড সাংঘাতিক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। তার ধারণা, কেউ তার সোনামানিককে ধরে নিয়ে চলে গেছে, তার দুধের শিশুটা ভয়েই আধমরা হয়ে এখন তার জন্যে কান্নাকাটি করছে।

আহারে! জিভ দিয়ে চুকচুক করল মুসা।

শয়তান মেয়েমানুষ! ফুঁসে উঠল জিনা। ছোট্ট মেয়েটাকে যে ধরে এনেছে, কষ্ট পাচ্ছে অন্ধকার পাতালঘরে বসে, সেটা একবার তাবেনি! ওটা, মহিলা না, ডাইনী!

ঠিকই বলেছ, মাথা কাত করল কিশোর। আমার প্ল্যান শোনো। এখুনি গিয়ে মেয়েটাকে বের করে আনব। তারপর গুহায় ফিরে নাস্তা সেরে নৌকায় করে তাকে নিয়ে যাব থানায়। পুলিশই তার বাবা-মাকে খুঁজে বের করবে।

টেরিকে কি করব? জানতে চাইল রবিন।

টেরিকে! একেবারে তিন গোয়েন্দার মনের কথাটা বলে ফেলল জিনা, ওকে রেখে যাব পাতালঘরে। মেয়েটার জায়গায়। ফিরে এসে তার জায়গায় ছেলেকে দেখে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে ধাড়ি বেঙগুলোর।

টেরির একটা ঠ্যাং-ঠুং ভেঙে দেব নাকি? পরামর্শ চাইল মুসা, য়াতে সারাজীবন খুঁড়িয়ে চলতে হয়…

না না, হাত নাড়ল কিশোর, ওসব ভাঙাভাঙির মধ্যে গিয়ে কাজ নেই। এমনিতেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে যাবে, দেখোই না খালি। এসো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

গুহায় ঢুকে টেরিকে বলল কিশোর, এই, এসো আমাদের সঙ্গে। রাফি, তুইও যাবি।

সন্দেহ ফুটল টেরির চোখে, কোথায়?

চমৎকার একটা জায়গায়, যেখানে এখানকার চেয়ে আরাম অনেক বেশি। মহাআনন্দে থাকতে পারবে। এসো।

সেখানে গরুগুলোও তোমাকে কামড়াতে পারবে না, হেসে বলল মুসা। নাও, ওঠো।

আমি যাব না।

রাফি, ওঠো তো, আদেশ দিল কিশোর।

গরগর করতে করতে এগিয়ে এল রাফি। নাক ঠেকাতে গেল টেরির পায়ে।

একলাফে উঠে দাঁড়াল সে।

দড়ি বেয়ে আগে আগে উঠে গেল মুসা ও জিনা। টেরিকে উঠতে বলল কিশোর। কিন্তু ভয়ে উঠতে চাইল না সে। আবার এগিয়ে এল রাফি। খাউ করে পায়ে কামড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল। লাফিয়ে উঠে দড়ি ধরে ফেলল টেরি। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে চলে গেল রাফির নাগালের বাইরে। তারপর চুপচাপ ঝুলে থেকে চেঁচাতে থাকল। বাধ্য হয়ে ওপর থেকে টেনে তাকে তুলে নিতে হলো মুসা ও জিনাকে।

রবিন আর কিশোরও উঠল।

জলদি করো, তাগাদা দিল কিশোর। ওরা ফিরে আসার আগেই কাজ সারতে হবে।

ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে প্রায় দৌড়ে এগোল ওরা। রাফি উঠে আসতে লাগল ঢাল বেয়ে। সবাই এসে দাঁড়াল দুর্গের চত্বরে।

ওদেরকে সিঁড়ির দিকে এগোতে দেখে ভয় পেয়ে গেল টেরি, আমি নিচে নামব না!

কেন, এত কিসের ভয়? তার মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল মুসা, গরুর? কিন্তু গরু তো বেঙাচি খায় না।

উদ্বিগ্ন হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে টেরি, আমার বাবা-মা কোথায়?

আছে, আছে, ভয় নেই। বাজারে গেছে তোমার জন্যে দুধের বোতল আনতে। চলে আসবে।

হেসে উঠল অন্য তিনজন। টেরির চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এমন বিপদে আর পড়েনি।

গর্তের মুখের ঢাকনাটা চাপা দিয়ে গেছে টোডেরা। তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে বড় বড় পাথর।

তোমার বাবা-মা কত্তবড় শয়তান, দেখো, জিনা বলল। ছোট্ট একটা মেয়েকে অন্ধকার ঘরে তো রেখেই গেছে, তার ওপর গর্তের মুখও বন্ধ করে গেছে, যাতে কোনমতেই বেরোতে না পারে। তোমার বিপদের জন্যেও ওরাই দায়ী, আর কাউকে দোষ দিতে পারবে না।

এটাকে দিয়েই পাথরগুলো সরানো যাক, টেরিকে দেখিয়ে প্রস্তাব দিল। মুসা। বাবা-মায়ের কাজ ছেলেরাই তো করে দেয়…

মাথা নাড়ল কিশোর, ও করে দেবে, আর লোক পেলে না। ও তো জানে খালি খাওয়া আর শয়তানি, অকাজের ধাড়ি। সময় নেই, এসো, হাত লাগাও সবাই।

পাথর সরানোর কাজে সাহায্য করতে টেরিকেও বাধ্য করল রাফি।

সিঁড়িতে পা রাখতে যাবে কিশোর, এই সময় একটা ঝোপের দিকে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল টেরি, ওই যে, ডারবি!

রাফির ভয়ে গিয়ে ওখানে ঢুকেছে নোংরা কুকুরটা। টেরিকে দেখে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। একবার মুখ বের করছে, আবার ঢুকে পড়ছে।

যেমন মনিব, তার তেমন কুকুর, হুহ! তীব্র ঘৃণা জিনার কণ্ঠে।. এই রাফি, ছেড়ে দে। ওটাকে কামড়ে মজা পাবি না। নিজের শরীরই দুর্গন্ধ করবি।

কিন্তু রাফি জানে, জিনা ভুল বলেছে, কামড়ে খুব মজা পাবে সে। বাধা দেয়ার কেউ নেই এখন, সহজেই কেটে নিতে পারে কুকুরটার একটা কান। মাঝে মাঝে জিনার এসব নির্দেশের কারণ বুঝতে পারে না সে। শত্রু কুকুরকে কামড়াতে মানা করে, খরগোশ তাড়া করতে দেয় নাঃ..এসব সময় মনে হয়, তার কুকুর-জন্মই বৃথা। মুখটাকে করুণ করে ফেলল সে।

কিন্তু তার অভিমান দেখার সময় নেই এখন জিনার। তাড়াহুড়ো করে অন্যদের সঙ্গে পাতালঘরে নেমে যেতে লাগল। দেয়ালে যে চকের চিহ্ন দিয়ে . রেখেছে কিশোর, তা দেখে সহজেই এগোতে পারছে ওরা।

যে ঘরে রাত কাটায় টোডরা সেটার সামনে এসে দাঁড়াল দলটা। দরজা লাগানো। বাইরে থেকে খিল তুলে দেয়া। ভেতরে কোন শব্দ নেই। দরজার গায়ে নখের আঁচড় দিতে দিতে মৃদু গোঁ গোঁ করতে লাগল রাফি। বুঝে গেছে, ভেতরে মানুষ আছে।

চিৎকার করে কিশোর বলল, কেউ আছ ভেতরে? আমরা তোমাকে বের করে নিয়ে যেতে এসেছি।

খসখস শব্দ হলো। উঠে দাঁড়াল যেন কেউ। দৌড়ে এল দরজার দিকে। জবার দিল একটা ছোট্ট কণ্ঠ, কে তোমরা! আমাকে বের করে নিয়ে যাও! আমার খুব ভয় লাগছে!

কথা শেষ হওয়ার আগেই খিল খুলতে শুরু করেছে কিশোর। ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা। ভেতরে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। সেই আলোয় দাঁড়িয়ে। থাকতে দেখল ছোট্ট মেয়েটাকে। কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে মুখ। বড় বড় বাদামী চোখে আতঙ্ক। কাঁদছিল, গালে পানির দাগ, তাতে ময়লা লেগে কালচে হয়ে আছে।

সোজা গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল মু। হেসে বলল, আর ভয় নেই, আমরা এসে গেছি। কেউ আর কিছু করতে পারবে না তোমার।

আমি মার কাছে যার! ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা। আমাকে এখানে। রেখেছে কেন? এখানে আমার ভাল লাগে না!

 তা তো লাগবেই না। এমন জায়গায় কি কারও ভাল লাগে? কোমল গলায় বলল কিশোর। তোমার মার কাছেই নিয়ে যাব আমরা। আগে চলো আমাদের গুহায়। নাস্তা খাবে। তারপর নৌকায় করে চলে যাব আমরা।

তোমাদের সঙ্গে যাব আমি, চোখ ডলতে ডলতে বলল মেয়েটা। তোমরা খুব ভাল। তোমাদেরকে আমার ভাল লাগছে। অন্য মানুষগুলোর মত খারাপ না তোমরা। ওদেরকে আমার ভাল লাগে না।

ওদেরকে কারোরই ভাল লাগে না, রবিন বলল।

রাফির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল জিনা, দেখো, ও হলো রাফি, আমাদের কুকুর। ও তোমার বন্ধু হতে চায়।

শরীর মুচড়ে মুসার কোল থেকে নেমে গেল মেয়েটা। রাফির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, খুব ভাল কুকুর, লক্ষ্মী কুকুর ও। কুকুর আমার খুব ভাল লাগে। আমারও আছে একটা।

গাল চেটে মেয়েটার মুখের পানি মুছিয়ে দিল রাফি।

তোমার নাম কি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

 ডরোথি হুবার্টসন। মা ডাকে, ডল।

ডলই তুমি, এক্কেবারে পুতুল। আদর করে ওর গাল টিপে দিল জিনা।

তুমিও খুব ভাল ছেলে।

 হাসল জিনা। আমি ছেলে নই, মেয়ে, তোমার মতই।

তাহলে ওরকম ছেলেদের মত কাপড় পরে আছ কেন?

পরে থাকতে আমার ভাল লাগে।

দাঁড়াও, আমিও পরব ওরকম। বাড়ি গিয়ে মাকে বলব এই কাপড় দিতে। তোমরা কে?

এক এক করে নিজেদের পরিচয় দিল গোয়েন্দারা।

 ও কে? টেরিকে দেখাল ডল।

ও? বেঙাচি, মুসা বলল। ও আমাদের কেউ নয়। ওর বাবা-মাই তোমাকে এনে আটকে রেখেছে এখানে। তোমার জায়গায় এখন ওকে রেখে যাব আমরা। ওর বাবা-মার জন্যে একটা সারপ্রাইজ।

পাতালঘরে একা থাকার কথা শুনেই চেঁচিয়ে গলা ফাটাতে শুরু করল টেরি। সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মুসার সঙ্গে কি আর পারে। একটানে তাকে ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

তোমাদের মত শয়তানদের এই শাস্তিও খুব কম হয়ে গেল। তবু যা হোক, তোমার বাবা-মার ছোট্ট একটা শিক্ষা অন্তত হবে। অন্যের বাচ্চাকে ধরে এনে আটকে রাখলে তাদের কেমন লাগে, বুঝতে পারবে। থাকো এখানে। একা থাকতে ডলের কেমন লেগেছিল, বুঝিয়ে বোলো বাবা-মাকে। চলি। গুডবাই।

অন্যেরা আগেই বেরিয়ে গেছে। বেরিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিল মুসা।

পাল্লার ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল টেরি। কিল মেরে মেরে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল, দোহাই তোমাদের, আমাকে বের করো! ভুতে খেয়ে ফেলবে আমাকে!

ভূতের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তোমাকে খেতে আসে! আর যদি তোমার মত কোন ছ্যাচড়া ভূত চলেই আসে, পচা পচা ছড়া শুনিয়ে দেবে। তোমার ওই জঘন্য ছড়া ভূতেরাও সইতে পারবে না।

গরুগুলো আসবে…

না, আসবে না। মানা করে দেব।

খিদেয় মারা যাব।

দু-একদিন না খেয়ে থাকলে মানুষ মরে না। চলি। যত খুশি চিল্লাও ওখানে বসে।

ফিরে চলল ওরা।

চিৎকার করে কাঁদতে লাগল টেরি।

লজ্জাও নেই! জিনা বলল, ঘেন্না লাগে এসব ছেলেকে দেখলে! এত্তবড় ছেলে, বাচ্চাদের মত কাঁদে, দেখো!

জলদি চলো, এতক্ষণে খিদে টের পাচ্ছে মুসা, আমার পেট জ্বলে গেল, খিদেয়।

আমারও খিদে পেয়েছে, মূসার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল ডল। ঘরটাতে যখন ছিলাম, তখন পায়নি। এখন খেতে ইচ্ছে করছে। তোমরা খুব ভাল, আমাকে বের করে এনেছ।

তোমাকে বের করে বেঙাচিটাকে যে রেখে আসতে পেরেছি, এতে আমরাও খুশি।

যেমন কুকুর তার তেমনি মুগুর, রবিন বলল। পাতালঘরে এসে ছেলেকে দেখলে আক্কেল হবে টোডদের।

যদি আক্কেল থাকে, জিনা বলল।

অনেক গলি-ঘুপচি আর ঘর পেরিয়ে অবশেষে সিঁড়ি বেয়ে আবার ওপরে উঠে এল ওরা।

উজ্জল রোদে বেরিয়ে যেন হা করে আলো-বাতাস গিলতে লাগল উল। ওহ, কি সুন্দর, কি সুন্দর! কোথায় আনা হয়েছে আমাকে?

একটা দ্বীপে, জবাব দিল জিনা, আমাদের দ্বীপ। এই যে ভাঙা দুৰ্গটা, এটাও আমাদের। কাল রাতে একটা নৌকায় করে তোমাকে এখানে আনা হয়েছিল। তোমার চিৎকার শুনতে পেয়েছি আমরা। তাতেই বুঝেছি, তোমাকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে।

একের পর এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে যেন ডলের জন্যে। ফোকর দিয়ে ঢুকে দড়ি বেয়ে গুহায় নেমে তাজ্জব হয়ে গেল।

কিশোরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল রবিন, সাহস আছে মেয়েটার! দেখলে, কেমন দড়ি বেয়ে নেমে পড়ল। ইকটু বাধাও দিল না। ভয় পেল না!

মুসা বলল, জিনার বোন হলে ভাল মানাত। এক্কেবারে এক চরিত্র মনে হচ্ছে।

জিনা নামটা কানে গেল জিনার। ঘুরে জিজ্ঞেস করল, আমার কথা কি বলছ?

না, কিছু না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল মুসা, তোমাকে কিছু বলছি না!

.

১৫.

ট্রাংকটার দিকে চোখ পড়ল ডলের। দেখল, পুতুলগুলো পড়ে আছে মাটিতে। চেঁচিয়ে উঠল, আমার পুতুল! কোথায় পেলে তোমরা? ইস, কত কেঁদেছি ওগুলোর জন্যে। ছুটে গিয়ে কুড়িয়ে নিতে নিতে বলল, আমার টিনা, আমার রুবি, আমার শেলিতোমরাও কেঁদেছ, না? …পিটার দুষ্টুটাও আছে দেখি, খেলনা ভালুকটাকে আদর করল সে। এ কি! জেনির পেট কে কাটল! হায় হায়!

কাটা পুতুলটাকে তুলে নিল ডল।

প্রমাদ গুণল কিশোর। এমন জানলে কি আর ফেলে রাখে ওখানে। তাড়াতাড়ি ঢলের পাশে এসে বুঝিয়ে বলল, আমিই কেটেছি। ওকে না কাটলে তোমাকে বের করে আনা যেত না…

কেন, যেত না কেন?

ওকে কেটে সূত্র বের করার চেষ্টা করেছি আমরা।

সূত্র তো বের করে গোয়েন্দারা। মা বলেছে আমাকে।

 আমরা গোয়েন্দা।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল ডলের। জেনির শোক ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, তোমরা গোয়েন্দা! কি মজা! তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল হলো। ইস্কুলের সবাইকে গিয়ে বলতে পারব। …আমার খিদে পেয়েছে। খাবার দাও।

হাঁপ ছেড়ে বাঁচল কিশোর। দাঁড়াও, এখনই দিচ্ছি।

খাবারের টিন কাটতে বসল রবিন। একটিন স্যামন, দুই টিন পিচ, একটিন দুধ কেটে রেখে, বড় একটা রুটি টেনে নিয়ে স্লাইস করল। মাখন মাখাল। বড় এক জগ কোকা গুলল।

 খেতে বসল সবাই। গপ গপ করে গিলতে লাগল ডল। আস্তে আস্তে গালের ফ্যাকাসে ভাব কেটে গিয়ে গোলাপী হয়ে উঠল।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, ডল, এখানে কি করে এলে তুমি, বলতে পারবে?

আমার নার্সের সঙ্গে বাগানে খেলছিলাম আমি। আমার দুধ আনতে ঘরে গেল নার্স। হঠাৎ একটা লোক দেয়াল টপকে ঢুকে, আমার গায়ে একটা কম্বল ফেলে দিল। সেটা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে তুলে নিয়ে চলে গেল। একটু পরে সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পেলাম। সাগর আমি চিনি। ছুটির দিনে আব্বা সৈকতে নিয়ে যায় আমাকে। আমার গা থেকে কম্বল সরিয়ে ফেলল লোকটা। তারপর একটা বোটে তুলল। একটা ঘরে বন্ধ করে রাখল দুদিন। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। কত কাঁদলাম, কেউ শুনল না।  

লোকটাকে তুমি চেনো?

না। আগে কখনও দেখিনি। এখানে আনার পর মহিলাটাকে চিনলাম। আমাদের বাড়িতে রান্না করত। মিসেস টোড। খুব খারাপ। আমার কোন কথাই শুনল না। আমাকে বের করে বাড়িতে নিয়ে যেতে বললাম। ধমক মারল। মারবে বলেও ভয় দেখাল।

হুঁ, তাহলে এই ব্যাপার! আসল কিডন্যাপার তাহলে অন্য লোক, যার একটা বোট আছে। তোমাকে কিডন্যাপ করতে তাকে সাহায্য করেছে টোডেরা। তোমাকে ওদের কাছে তুলে দিয়েছে লোকটা, এখানে এনে লুকিয়ে রাখার জন্যে।

তারমানে, রবিন বলল, সেদিন যে দ্বীপে ধোঁয়া উঠতে দেখেছিলাম, ওই লোকই নেমেছিল এখানে। জায়গাটা দেখেছে। এখানে ডলকে লুকিয়ে রাখা যাবে কিনা বুঝতে চেয়েছে। শলা-পরামর্শ করেছে টোডের সঙ্গে।

ধরতে পারলে ওকে আমি দ্বীপে নামা বার করব! দাঁতে দাঁত চেপে বলল জিনা।

নাস্তা শেষ হলো।

কিশোর বলল, ডলকে থানায় নিয়ে যেতে হবে। পত্রিকাগুলো নিশ্চয় ওকে নিয়ে খবর ছেপে গরম করে ফেলেছে। পুলিশ দেখলেই চিনতে পারবে।

কিন্তু ডলকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনলেই তো পালাবে টোডেরা। একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, রবিন বলল। ওদের ধরা দরকার।

দেখি, বুদ্ধি একটা বের করেই ফেলব।

চলো তাহলে, মুসা বলল। দেরি করে লাভ কি?

এখানে আমার খুব ভাল লাগছে, ডল বলল। গুহাটা খুব সুন্দর। আমার থাকতে ইচ্ছে করছে। আমাকে রেখে তোমরা আবার এখানে আসবে?

হাসল জিনা। আসব। কেন?

আমিও আসব তোমাদের সঙ্গে। উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে তার চোখ। কোনদিন গুহায় থাকিনি তো, থাকতে ইচ্ছে করছে। কি সুন্দর গুহা, দ্বীপ, রাফির মত ভাল কুকুর…জিনাআপু, আমি তোমার মত প্যান্ট-শার্ট পরে আসব।

লও ঠ্যালা! চট করে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল।

মুচকি হাসল তিন গোয়েন্দা।

কিন্তু তোমার আব্বা-আম্মা তো তোমাকে আসতে দেবে না, জিনা বলল। তবু, বলে দেখতে পারো। তুমি এলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। বরং মজাই হবে। তুমি খুব ভাল মেয়ে।

রতনে রতন চেনে, ফস করে বলে ফেলেই জিভ কামড়াল মুসা।

ভুরু কোঁচকাল জিনা, কি বললে?

না, কিছু না, আরেক দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।

জিনা রেগে গেলে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলা যায় না। তাড়াতাড়ি রবিন বলল, বসে আছি কেন আমরা এখনও, যেতে হবে নাঃ..

খাঁড়ির গুহা থেকে নৌকাটা বের করা হলো। সেটা দেখে আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল ডল। বার বার বলতে লাগল, যে ভাবেই হোক, এই দ্বীপে সে ফিরে আসবেই।

নৌকায় উঠল সবাই। পঁাড় তুলে নিল মুসা ও জিনা।

অবাক হয়ে ডল বলল, জিনাআপু, তুমি নৌকাও চালাতে পারো! দাঁড়াও, আমি তোমার কাছে দাঁড় বাওয়া শিখব।

.

ঘাটের কাছেই দেখা হয়ে গেল জেলের ছেলে ফগের সঙ্গে। জিনার নৌকাটা দেখে দৌড়ে এসে ওটা তীরে টেনে তুলতে সাহায্য করল।

 আমি এখনই রওনা হতাম, বলল সে। দ্বীপে যেতাম, তোমাদের খবর দেয়ার জন্যে। মাস্টার জর্জ, তোমার আব্বা চলে এসেছেন। কাল রাতে। তোমার আম্মা আসেননি। তবে তার শরীর এখন অনেক ভাল, তোমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ছয়-সাতদিনের মধ্যেই বাড়ি চলে আসবেন।

আব্বা এসেছে কেন? জানতে চাইল জনা।

আসবেন না? তোমাদের কাছে টেলিফোন করেন, কেউ ধরে না। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। আমার কাছে তোমাদের খবর জানতে এসেছিলেন। আমি বলিনি। কি রাগা যে রেগেছেন তোমাদের ওপর। বাড়ি ফিরে দেখেন, জিনিসপত্র সব তছনছ। তোমরা নেই, টোডেরা নেই। এখন গেছেন থানায়, রিপোর্ট করতে।

ভাল হয়েছে, ওখানেই দেখা হবে আমাদের সঙ্গে। আমার কথায় কান না দিয়ে মিসেস টোডকে বিশ্বাস করার ফল তো পেল। আক্কেল হয়েছে।

ডলকে জিনাদের সঙ্গে দেখে খুব অবাক হয়েছে ফগ। বার বার তার দিকে তাকাতে লাগল।

জিনা বলল, সব তোমাকে বলব, ফগ। এখন সময় নেই। আমরাও থানায় যাচ্ছি।

সারি দিয়ে থানার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল গোয়েন্দাদের বিচিত্র দলটা। গেটে ডিউটিরত সেন্ট্রি ওদের চেনে। ভুরু কুঁচকে তাকাল। কি ব্যাপার, জিনা? তোমার আব্বা এল একটু আগে, তুমিও…।

জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা, আব্বা কোথায়?

শেরিফের রুমে।

আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করল না জিনা। সোজা এসে ঢুকল শেরিফের ঘরে।

দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকালেন মিস্টার পারকার। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এসেছ, না! ছিলে কোথায়? বাড়িঘর সব খালি ফেলে..ডাকাতি করে তো সব নিয়ে গেছে…

করেছে তো তোমার সেই অতি বিশ্বাসী বেঙের দল

কার দল!

বেঙ, বেঙ! বাবার ওপর প্রচণ্ড অভিমানে খেপে আছে জিনা। টোড মানে যে বেঙ, ভুলে গেছ!…জাহান্নামে যাক ঘরবাড়ি! আম্মা কেমন আছে, বলো!

ভাল। আগের চেয়ে অনেক ভাল, জিনাকে রেগে উঠতে দেখে শান্ত হয়ে গেলেন মিস্টার পারকার। জিনা যেমন তাকে ভয় পায়, তিনিও তাকে ভয় পান। ও রেগে গেলে ওর মা ছাড়া আর কেউ ঠাণ্ডা করতে পারবে না, জানেন। ঝামেলার মধ্যে গেলেন না। বসে পড়লেন আবার। তোমার মা-ই তো আমাকে পাগল করে দিল। আসতে বাধ্য করল। খালি এককথা, ছেলেমেয়েগুলো কেমন আছে, কি খাচ্ছে না খাচ্ছে…আমি এদিকে ফোন করে জবাব পাই না। তাকে কি জবাব দেব? মিথ্যেই বলতে হলো, ভাল আছ। কিন্তু কত আর মিথ্যে বলা যায়। শেষে দেখতে এলাম। এসে তো দেখি এই অবস্থা। ছিলে কোথায়?

দ্বীপে। কিশোরের মুখেই সব শোনো।

বাপ-মেয়ের এই ঝগড়া খুব উপভোগ করেন শেরিফ লিউবার্তো জিংকোনাইশান। জিনার বাবার বন্ধু তিনি, বাড়িতে যাতায়াত আছে। মুচকি মুচকি হাসছেন।

পাল্লা আবার ঠেলে খুলে ডাক দিল জিনা, কিশোর, এসো।

নাটকীয় ভঙ্গিতে ডলের হাত ধরে ঘরে ঢুকল গোয়েন্দাপ্রধান। পেছনে তার দলবল।

ডলকে দেখে হাঁ হয়ে গেলেন শেরিফ। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। একে কোথায় পেলে! এই খুকি, তুমি ডরোথি না?

ডরোথি হুবার্টসন, জবাব দিল সে। আম্মা ডাকে ডল।

খোদা! পুরো এলাকা চষে ফেলেছে পুলিশ, হন্যে হয়ে খুঁজছে একে, আর ও নিজেই এসে হাজির।

কি বলছ, কিছুই তো বুঝতে পারছি না! অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছেন মিস্টার পারকার। কেন খুঁজছ?

খবরের কাগজ পড়ো না নাকি…

না, কদিন ধরে পড়তে পারছি না..জিনার মাকে নিয়েই ব্যস্ত…

এ জন্যেই জানো না। কোটিপতি হুবার্টসনের মেয়ে ও। সাংঘাতিক প্রভাবশালী লোক। গরম করে ফেলেছে সব। ধমক দিয়ে দিয়ে অস্থির করে ফেলেছে আমাদের। মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নোট পাঠিয়েছে, দশ লক্ষ ডলার দিলে ফিরিয়ে দেয়া হবে।…কিশোর, তোমরা একে পেলে কোথায়?

জিনার দ্বীপে, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর।

ছেলেমেয়েদের বসতে বললেন শেরিফ। একজন সহকারীকে ডাকলেন নোট নেয়ার জন্যে।

গোড়া থেকে সমস্ত কাহিনী বলে গেল কিশোর। কিছুই বাদ না দিয়ে। লিখে নিল শেরিফের সহকারী।

শুনতে শুনতে এমন অবস্থা হলো মিস্টার পারকারের, কোটর থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে চোখ।

শেরিফ জিজ্ঞেস করলেন, যে বোটটা দিয়ে আনা হয়েছে ডলকে, সেটার ক্যাপ্টেনের নাম কি?

বলতে পারব না, মাথা নাড়ল কিশোর। টেরি কেবল বলেছে, তার মাকে নাকি মারিয়া নামটা বলতে শুনেছে।

মারিয়া! ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিলেন শেরিফ। পুলিশের খাতায় নাম আছে ওটার, বদনাম। ক্যাপ্টেনের নাম হিউগো ব্রোকার, মারিয়া তার বোটের নাম। ডাকাতির দায়ে জেল খেটেছে বহুবছর হিউগে। বেরিয়েই আবার শুরু করেছে। টোডদের সঙ্গে জোট পাকিয়ে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেছে। কদিন ধরে এদিকের সাগরে তার বোটটাকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে, রিপোর্ট পেয়েছি। কিডন্যাপের খবরটা শুনেই সন্দেহ হয়েছিল আমার, তার কাজ হতে পারে। হলোও তাই।

ওকে ধরা দরকার, কিশোর বলল। টোডদেরকেও।

বোটটা আটকানো কোন ব্যাপারই না। এখনই অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি, আমি। টোডরাও পালাতে পারবে না। কিন্তু ওরা তো সব অস্বীকার করবে। প্রমাণ করব কি করে এই কিডন্যাপিঙে ওরা জড়িত?

আমরা সাক্ষি দেব। তবে স্বীকারোক্তির সহজ একটা পথ আমি বাতলে দিতে পারি…

কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন শেরিফ, কি ভাবে?

চমকে দিয়ে। ওদের ছেলেকে পাতালঘরে আটকে রেখে এসেছি আমরা। সেই খবরটা কোনভাবে ওদের কানে তুলে দিতে হবে। ওরা তখন ছেলেকে বের করে আনতে পাতালঘরে নামবে। ডলকে যে নিয়ে এসেছি। আমরা, সেটা ওদেরকে জানানো হবে না। ওখানে ছেলেকে দেখে, ভীষণ চমকে যাবে ওরা। ডল কোথায় জিজ্ঞেস করবে। কাছেই লুকিয়ে থাকবে পুলিশ। আড়াল থেকে সব শুনবে। পুলিশ অফিসারের সাক্ষি নিশ্চয় আদালত গ্রহণ করবে।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলেন শেরিফ। হাসি ফুটল মুখে। ধীরে ধীরে চওড়া হলো হাসিটা। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিলেন তাঁর সহকারীকে।

পুলিশকে সহায়তা করার জুন্যে বার বার ছেলেমেয়েদের ধন্যবাদ দিলেন তিনি। হাত বাড়ালেন ফোনের দিকে, ডলের বাবাকে খবর জানানোর জন্যে।

জিনার দিকে তাকিয়ে মিস্টার পারকার জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বাড়ি ফিরে যাবে?

গিয়ে আর কি করব এখন? কাজের মানুষ নেই, কিছু নেই…

আইলিনকে খবর পাঠিয়েছি। ও আজই চলে আসবে।

আম্মা না আসা পর্যন্ত আমরা দ্বীপেই থাকতে চাই, আব্বা। আম্মার ঘর খালি দেখলে ভাল লাগে না আমার। আইলিন যখন আসছে আর তো কোন চিন্তা নাই। ঘরদোর সে-ই দেখেশুনে রাখবে।

রাজি হয়ে গেলেন পারকার, বেশ। তবে তোমার আম্মা আসার পর আর একদিনও দেরি করতে পারবে না।

 দেরি করব মানে? তাকে দেখার জন্যে পাগল হয়ে আছি আমি।

খবর পাবে কি করে?

হাসল জিনা। সে তোমাকে ভাবতে হবে না। আম্মা আসার সঙ্গে সঙ্গে খবর পৌঁছে যাবে আমার কাছে।

পারকারের দিকে তাকিয়ে হাসলেন শেরিফ। গোয়েন্দাগিরি করে ওরা, ভুলে যাচ্ছ কেন, জনাথন। একআধজন স্পাই থাকবে না, এটা কি হয়?

.

১৬.

সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন মিস্টার পারকার। ডল ইচ্ছে করেই চলে এসেছে তাদের সঙ্গে। শেরিফকে অনুরোধ করে এসেছে, তার বাবা-মা এলে যেন গোবেল ভিলায় পাঠিয়ে দেন।

হাসিমুখে বাগানের গেট খুলে দিল আইলিন। জরুরী তলব পেয়ে ছুটতে ছুটতে চলে এসেছে। কি ব্যাপার, কিছুই জানতে চাইল না। সবাইকে হাত মুখ ধুয়ে এসে আগে খেতে বসতে বলল, রান্না শেষ।

খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করল ছেলেমেয়েদের। গোবেল বীচে আসার মজা এতদিনে আরম্ভ হয়েছে।

খেতে খেতে আইলিনকে তাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনাল ওরা।

 অবাক হলো না আইলিন। এরকম অ্যাডভেঞ্চার অনেক করেছে ওরা। এসব দেখতে দেখতে গা-সওয়া হয়ে গেছে তার।

হঠাৎ জানালার বাইরে চোখ পড়ল রবিনের। মুখের কাছে থেমে গেল চামচ। পাতাবাহারের বেড়ার ওপাশে উঁকিঝুঁকি মারছে একজন লোক।

এই, দেখো দেখো!

মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েই মুসা বলে উঠল, খাইছে! বড়-বেঙটা এখানে কি করছে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। তোমরা বসো এখানে। আমি আসছি। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

বেড়ার কাছে এসে ডাক দিল, মিস্টার টোড, শুনুন। টেরিকে খুঁজছেন?

 চমকে গেল টোড। তাকিয়ে রইল কিশোরের দিকে। কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

দুর্গের নিচে পাতালঘরে আছে ও, জানাল কিশোর। গেলেই পাবেন।

তাকাও এদিকে!ওর কথা তুমি জানলে কি করে? ছিলে কোথায় এ কদিন? বাড়ি যাওনি?

ওসব আপনার জানার দরকার নেই। টেরিকে পেতে চাইলে দ্বীপে চলে যান। পাতালঘরে আটকা পড়ে কান্নাকাটি করছে বেচারা।

চোখে চোখে তাকাল টোড। কিশোরের মনে কি আছে বোঝার চেষ্টা করল। তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল।

দৌড়ে ঘরে ফিরে এল কিশোর, থানায় ফোন করার জন্যে। সে নিশ্চিত, মিসেস টোডকে গায়ের ভেতর কোথাও রেখে এসৈছে টোড, টেরিকে খুঁজতে খুঁজতে নিজে চলে এসেছে এখানে। কিশোরদের এখানে দেখতে পাবে কল্পনাও করেনি। এখন গিয়ে মিসেসকে বলবে সব, যত তাড়াতাড়ি পারে চলে যাবে। দ্বীপে, টেরিকে বের করে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে।

খাওয়া শেষ করেই মিস্টার পারকার বললেন, হাসপাতালে চলে যাচ্ছেন। তিনি। খবর জানার জন্যে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছেন জিনার আম্মা।

তাকে বলব, পারকার বললেন, দ্বীপে চলে গেছ তোমরা। খুব ভাল আছ। তবে তোমাদের অ্যাডভেঞ্চারের কথা এখন বলা যাবে না, দুশ্চিন্তা করতে পারে। বাড়ি এলেই বলব সব।

গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন তিনি।

তখুনি দ্বীপে চলে যাবে কিনা, এ নিয়ে আলোচনা শুরু করল। গোয়েন্দারা। যেতে কোন বাধা নেই, অসুবিধে হলো ডলকে নিয়ে। তাকে কি করবে বুঝতে পারছে না।

সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে ওরা, এই সময় বিরাট একটা গাড়ি এসে থামল গেটের বাইরে। লাফ দিয়ে নামলেন লম্বা একজন ভদ্রলোক, সঙ্গে খুব সুন্দরী একজন মহিলা।

জিনা বলল, ডল, দেখো তোমার আব্বা-আম্মা বোধহয় এলেন।

.

আদরের চোটে দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হলো ডলের। জোর করেই শেষে বাবা-মা দুজনের কাছ থেকে সরে এল।

তাঁদেরকে জানানো হলো সব। মিনিটে অন্তত বিশবার করে গোয়েন্দাদেরকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন মিস্টার হুবার্টসন, তাতেও যেন মন ভরছে না, আরও বেশি করে দিতে চাইছেন।

যে কোন একটা পুরস্কার চাও তোমরা, বললেন তিনি। যা ইচ্ছে। কি খুশি যে হয়েছি আমি তোমাদের ওপর, বলে বোঝাতে পারব না।

আপনি যে খুশি হয়েছেন, এতেই আমরা খুশি, কিশোর বলল, এটাই আমাদের পুরস্কার। ডলকে শয়তানদের হাত থেকে বের করে আনতে পেরেছি, আর কি চাই।

কিন্তু আমার কাছ থেকে তোমাদের কিছু নিতেই হবে!

কি যেন ভাবছে জিনা। তার গা ঘেঁষে বসে আছে ডল। বাবা-মায়ের অলক্ষ্যে কনুই দিয়ে গুঁতো মারল জিনার পেটে।

সত্যিই দিতে চান? হঠাৎ প্রশ্ন করল জিনা।

চাই! কি চাও, বলো?

দেবেন তো?

দেব।

বেশ, ডলকে কয়েক দিন আমাদের সঙ্গে দ্বীপে থাকতে দিন।

থমকে গেলেন হুবার্টসন। বলো কি! কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল…এতদিন পর ফিরে পেলাম মেয়েকে, ছেড়ে দেব… না দেখে থাকব কি করে?

আব্বা, তুমি কথা দিয়েছ ওদেরকে, যা চায় দেবে। ছুটে এসে বাবার হাত চেপে ধরল ডল, আব্বা, আমাকে থাকতে দাও! দ্বীপটা যে কি সুন্দর। আর গুহাটা, উফ! দাও না, আব্বা! ওখানে যা একটা দুর্গ আছে না, মাটির নিচে ঘর…

 রাফিকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব আমরা, সুপারিশ করল রবিন, কোন ভয় নেই। বড় বড় চোর-ডাকাতকেও ঘায়েল করে ফেলতে পারে সে। ডলের কিছু করতে পারবে না কেউ। কি রে রাফি, পাহারা দিয়ে রাখতে পারবি না?

মাথা দোলাল রাফি। বলল, হাউ!

অবশেষে রাজি হলেন হুবার্টসন, এক শর্তে দিতে পারি। কাল আমি আর তোমার আম্মা দ্বীপে যাব দেখতে, জায়গাটা সত্যি থাকার মত কিনা। দিনটা তোমাদের সঙ্গে কাটাব। আমাদেরকে উৎপাত মনে করা চলবে না।

করব না আব্বা, করব না! খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল ডল। বাপের গা বেয়ে কোলে উঠে চপাৎ চপাৎ করে চুমু খেলো দুই গালে।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, আপনারা তো নিশ্চয় হোটেলে উঠবেন? ডল তাহলে আমাদের কাছেই থাক, নাকি?

এতক্ষণে কথা বললেন ডলের আম্মা, সঙ্গে নিতে পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু তোমাদের অখুশি করি কি করে। ঠিক আছে, থাক… হাসলেন তিনি।

গোয়েন্দাদের আরও কয়েকবার ধন্যবাদ জানিয়ে, গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন ডলের আব্বা-আম্মা।

মিনিটখানেক পর দরজায় টোকা পড়ল।

খুলে দিল জিনা। দেখে, একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, একটু আগে নৌকা নিয়ে দ্বীপে রওনা হয়েছে টোডরা। আমিও যাব। দ্বীপে ঢোকার রাস্তা চিনি না, পথটাও নাকি ভাল না শুনেছি। মিস জর্জিনা, তুমি তো সবচেয়ে ভাল চেনো। এলে ভাল হত।

আমি মাস্টার জর্জ, নট মিস জর্জিনা, গম্ভীর হয়ে বলল জিনা।

মুহূর্তের জন্যে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন পুলিশ অফিসার। সামলে নিয়ে বললেন, সরি, মাস্টার জর্জ। তো, আসবে?

খুশি হয়েই আসব। তবে একা নয়। আমার বন্ধুদেরও নিতে হবে।

কোন অসুবিধে নেই। এসো।

জিনার বোটে করে চলল সে আর তার বন্ধুরা। অফিসারও চললেন সেটাতে করেই। পেছনে বেশ কিছুদূর থেকে ওদেরকে অনুসরণ করে এল পুলিশের বোট।

 দ্বীপের একটা ধারে নৌকা নিয়ে এল জিনা, যেখান দিয়ে ডাঙায় উঠতে কষ্ট হয়, তবে ওঠা যায়। সহজ পথ গোপন সৈকতটা অফিসারকে চেনাল না। ওটা ওদের নিজস্ব বন্দর।

টোডরা নামল ভাঙা জাহাজটার কাছ দিয়ে ঘুরে গিয়ে, যেখানে ওরা নেমেছে এ কদিন। পুলিশকে দেখতে পেল না।

অফিসারকে নিয়ে নিঃশব্দে দুর্গের কাছে চলে এল গোয়েন্দারা।

সিঁড়িমুখে আগে নামল জিনা। টর্চ হাতে আগে আগে চলল। পেছনে

পুরো দলটা। এখানকার গলিঘুপচি সবচেয়ে বেশি চেনে সে।

যে ঘরটায় আটকে রেখে গেছে টেরিকে, সেখানে এসে দেখল, দরজা। বন্ধই আছে। খিল লাগানো।

ফিসফিস করে কিশোর বলল, টোডরা এখনও আসেনি। লুকিয়ে পড়তে হবে।

লুকানোর জায়গার অভাব নেই। প্রচুর থাম আছে, দেয়াল আছে।

 রাফিকে চুপ থাকতে বলল জিনা।

কয়েক মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। কথা বলতে বলতে আসছে টোডরা।

টেরিকে যদি ওখানে সত্যি আটকে রাখে, মিসেস টোড বলছে, যে রেখেছে, তার কপালে খারাপি আছে। দেখে নেব আমি! কিন্তু আটকাল কে, বলো তো? মেয়েটাই বা তাহলে কোথায়? আমার কি মনে হয় জানো, বস আমাদের সঙ্গে বেঈমানী করেছে। আমাদের যে দশ হাজার ডলার দেবে বলেছিল, দেবে না। বোটে যে তল্লাশি চালাবে পুলিশ, বুঝে গিয়েছিল। সে জন্যেই সরিয়ে ফেলেছিল মেয়েটাকে। পুলিশ দেখেটেখে সন্দেহমুক্ত হয়ে চলে গেছে। ও এসে চুরি করে নিয়ে গেছে মেয়েটাকে। মাঝখান থেকে আমার ছেলেটাকে আটকে রেখে গেছে। আমি বসকে ছাড়ব না!

কি করবে? খসখসে গলায় বলল টোড, ওর সঙ্গে পারা যাবে না। কিন্তু আমি ভাবছি, কিশোর ছেলেটা জানল কি করে টেরি কোথায় আছে? মাথায়ই কিছু ঢুকছে না আমার!

ঘরে ঢুকল ওরা। বন্ধ দরজার দিকে এগোল। পায়ে পায়ে রয়েছে ডারবি। লুকিয়ে থাকা গোয়েন্দাদের গন্ধ পেয়ে মৃদু গোঁ গোঁ করে উঠল।

লাথি মেরে ওকে সরিয়ে দিল টোড। শয়তান কুত্তা, কাজের কাজ কিচ্ছু নেই, খালি ভয়ে কেঁৎ-কোৎ করে!

বাবার গলা শুনেই ভেতর থেকে ককিয়ে উঠল টেরি, বাবা! এসেছ! জলদি খোলো! মরে গেলাম!

পাল্লার ওপর গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মিসেস টোড। টান দিয়ে খুলে ফেলল খিল।

মাকে এসে জড়িয়ে ধরল টেরি। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

কে রেখে গেছে তোকে এখানে! জলদি বল! তোর বাবা ওদের গুলি করে মারবে! মারবে না, জন? ছোট্ট একটা দুধের শিশুকে এভাবে আটকে রেখে যায়, কোন শয়তান! মায়াদয়া নেই প্রাণে!

থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন পুলিশ অফিসার। টর্চের আলো ফেললেন টোডের মুখে। এমন চমকান চমকাল দুই টোড, যেন ভূত দেখেছে।

ঠিকই বলেছ, ডোরিয়া টোড, ভারি গলায় বললেন তিনি, একটা দুধের শিশুকে এভাবে আটকে রেখে যাওয়াটা শয়তানের পক্ষেই সম্ভব, যাদের প্রাণে বিন্দুমাত্র মায়াদয়া নেই। তোমরা সেই শয়তান, তাই না? ডলের মত একটা শিশুকে এনে আটকে রেখেছিলে, টাকার লোভে। তারপর তাকে একা ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলে। একবারও ভাবনি, বাচ্চাটা এরকম জায়গায় একা থাকবে কি করে।

মাছের মত নিঃশব্দে মুখ হাঁ করে আবার বন্ধ করল মিসেস টোড। কথা। আটকে গেছে।

ফাঁদে আটকা পড়া ইঁদুরের মত চি-চি করে উঠল টোড, তাকাও এদিকে!

চার বছরের শিশুর মত কাঁদতে শুরু করল টেরি। এত্তবড় ছেলেকে এভাবে কাঁদতে দেখে ঘৃণায় আরেকবার মুখ বাকাল গোয়েন্দারা।

হঠাৎ ওদের ওপর চোখ পড়তেই হিসিয়ে উঠল মিসেস টোড, তোমরা! মেয়েটাও আছে দেখি! ও, তাহলে বসকে খামোকা দোষ দিয়েছি। সব শয়তানি তোমাদের! টেরিকে কে আটকেছিল, বলো, জলদি বলো!

থানায় চলে আগে, ধমকের সুরে বললেন অফিসার, সব প্রশ্নের জবাব পাবে। টোডের পিস্তলটা কেড়ে নিলেন তিনি।

আর কিছু করার নেই। বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে যেতে হলো টোডদের।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে টেরি। বুঝতে পারছে, তার মা আর বাবাকে জেলে দেয়া হবে। তাকে পাঠানো হবে হয়তো কোন কঠিন স্কুলে, যেখানকার নিয়ম-কানুন ভীষণ কড়া। কত বছর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হবে না, জানে না। ওদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াটা এক হিসেবে ভালই হবে ওর জন্যে, স্কুলে গেলে অন্তত মানুষ হওয়ার সুযোগ পাবে, কাছে থাকলে, যেটা হত না। ক্রিমিন্যালই হত বাবা-মার মত।

বাইরে বেরিয়ে অফিসারকে বলল কিশোর, আমাদের আর সঙ্গে যাওয়ার দরকার নেই নিশ্চয়। টোডদের বোটে করেই চলে যেতে পারবেন।

কুত্তাটাকেও নিয়ে যান, জিনা বলল। ওই নোংরা জানোয়ার আমার দ্বীপে রাখব না।

টোডদের নৌকাতেই তোলা হলো ওদেরকে। বলতে হলো না, টেরিকে উঠতে দেখেই লাফিয়ে তাতে চড়ে বসল ডারবি। রাফির জ্বলন্ত দৃষ্টির কাছ থেকে দূরে যেতে পারলে বাঁচে সে।

পুলিশের বোটের সঙ্গে নৌকাটা বাঁধা হলো, টেনে নিয়ে যাবে।

ঠেলা দিয়ে নৌকাটা পানিতে নামিয়ে দিল তিন গোয়েন্দা।

হাত নেড়ে বিদায় জানাল মুসা, বিদায় জনাব বেঙ, জেলে গিয়ে আবার কোনও বাচ্চাকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান করুন। বিদায় জনাবা বেঙনি, বেঙাচিকে কোলে বসিয়ে রাখবেন, যাতে আরও বেশি করে কাঁদতে পারে সে। বিদায় বেঙচি, স্কুলে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করে ভাল ছেলে হওয়ার চেষ্টা কোরো। বিদায় ডার্টি, তীরে নেমেই ভাল করে আগে গোসল করে নিবি। তোর গন্ধ রাস্তার কুত্তাও সহ্য করবে না, দূর দূর করে খেদাবে।

মুসার কথা আর বলার ভঙ্গি দেখে পুলিশরাও হাসতে শুরু করল।

হাত নেড়ে বিদায় জানালেন পুলিশ অফিসার।

গোমড়া মুখে নৌকায় বসে আছে দুই টোড, চোখ নামানো, তাকাতে পারছে না কারও দিকে।

পাহাড়ের একটা মোড়ের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল বোট দুটো।

Categories: