৩. রীতিমত ভূতুড়ে; গা ছমছম করে

0 Comments

কারোই পছন্দ হলো না জায়গাটা। নীরবে হাত তুলে দেখাল কিশোর। মূল বাড়িটা যেখানে ছিল তার দু-ধারে বিশাল দুটো গাছের পোড়া কাণ্ড।

ওই গাছগুলোর জন্যেই নিশ্চয় নাম রেখেছে টু-ট্রীজ, বলল সে। এতটা নির্জন হবে, ভাবিনি।

নির্জন কি বলছ? বলে উঠল মুসা। রীতিমত ভূতুড়ে। গা ছমছম করে।

সূর্য ডোবার অপেক্ষায়ই যেন ছিল কনকনে ঠাণ্ডা। ফিসফিসিয়ে কানাকানি করে গেল এক ঝলক বাতাস, হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে গেল অভিযাত্রীদের।

এসো, জরুরী কণ্ঠে বলল কিশোর, রাত কাটানোর জায়গা খোঁজা দরকার।

বিষণ্ণ বাড়িটায় নীরবে ঢুকল ওরা। দোতলার কিছুই অবশিষ্ট নেই। নিচতলার অবস্থাও শোচনীয়। তবে এক কোণে শোয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কালো ছাইতে মাখামাখি আধপোড়া একটা কার্পেট এখনও বিছানো রয়েছে মেঝেতে, বিরাট একটা টেবিলও আছে।

বৃষ্টি এলে ওটাতে উঠে বসতে পারব, টেবিলটা দেখিয়ে বলল কিশোর। তবে দরকার হবে বলে মনে হয় না।

একেবারেই বাজে জায়গা, রবিনও মুখ বাঁকাল। গন্ধ! থাকা যাবে না এখানে।

অন্য জায়গা খোঁজা দরকার, কিশোর বলল। অন্ধকারও হয়ে এসেছে। আগে লাকড়ি নিয়ে আসি, আগুনের ব্যবস্থা করে, তারপর…

জিনাকে রেখে লাকড়ি আনতে বেরোল অন্য তিনজন। শুকনো ডালের অভাব নেই। তিন আঁটি লাকড়ি নিয়ে ফিরে এল ওরা।

জিনা বসে থাকেনি। থাকার জন্যে আরেকটা জায়গা খুঁজে বের করে ফেলেছে, প্রথমটার চেয়ে ভাল।

ছেলেদের দেখাতে নিয়ে চলল সে। রান্নাঘরের এক ধারে মেঝেতে একটা দরজা, পাল্লা তুলে রেখেছে জিনা, নিচে ধাপে ধাপে পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে।

ভাড়ারে গিয়েছে, সিঁড়ি দেখিয়ে বলল জিনা। ঢুকেছিলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না, অনুমান। নিচে নিশ্চয় আগুন ঢুকতে পারেনি, ছাই থাকবে না। ওপরের ঘরের চেয়ে ওখানে ভাল হবে। থাকতে পারব।

টর্চ জেলে নামতে শুরু করল কিশোর, পেছনে অন্যেরা। রাফিয়ান চলেছে তার পাশে পাশে।

কয়েক সিঁড়ি বাকি থাকতেই এক লাফে গিয়ে মেঝেতে নামল কুকুরটা। ওপরেরটার চেয়ে অনেক ভাল ঘর। বিদ্যুতের তার, বোর্ড, সকেট, সুইচ সবই লাগানো আছে। জেনারেটর ছিল, বোঝাই যায়।

ছোট ঘর। মেঝেতে পোকায় খাওয়া কার্পেট। ঘুণে ধরা আসবাবপত্রে ধুলোর পুরু আস্তরণ। ভাড়ার-কাম-বসার ঘর ছিল এটা। সারাঘরে মাকড়সার জাল, গালে লাগতেই থাবা দিয়ে সরাল জিনা।

তাকে কিছু মোমবাতি পাওয়া গেল। ভালই হলো। অন্ধকারে থাকতে হবে।

লাকড়ি এনে ঘরের কোণে জড়ো করে রাখা হলো।

আসবাবগুলো কোন কাজের নয়। ঘুণে খেয়ে একেবারে নষ্ট করে ফেলেছে। একটা চেয়ারে গিয়ে বসেছিল মুসা, মড়মড় করে ভেঙে পড়ল ওটা। হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে চিতপটাং হলো গোয়েন্দা-সহকারী। হেসে উঠল সবাই।

তবে টেবিলটা মোটামুটি ঠিকই আছে। ধুলো পরিষ্কার করে ওটার ওপর রাখা হলো খাবারের প্যাকেট।

বাইরে অন্ধকার। চাঁদ ওঠেনি। শরতের শুকনো পাতায় মর্মর তুলে ঘুরেফিরে বইছে বাতাস, কিন্তু কালো হ্রদটা আগের মতই নিথর। ছলছলাৎ করে তীরে আছড়ে পড়ছে না ঢেউ।

ভাঁড়ারে আলমারিও আছে একটা। খুলে দেখল কিশোর। আরও মোমবাতি, বাহ, চমত্তার। প্লেট…কাপ…এই, কুয়া-টুয়া চোখে পড়েছে কারও?খাবার পানি লাগবে।

না, কুয়া দেখেনি কেউ। তবে রবিন একটা জিনিস দেখেছে, ওপরে রান্নাঘরের এক কোণে, সিংকের কাছে। বোধহয় পাম্প, বলল সে। চলো দেখি, ঠিক আছে কিনা।

মোমবাতি জ্বেলে ওপরে উঠে এল সবাই। ঠিকই বলেছে রবিন। পাম্প-ই। ট্যাংকে পানি তোলা হত হয়তো। বড় সিংকের ওপরে কলও আছে, ট্যাংক থেকেই পানি আসত।

হাতল ধরে ঠেলে জোরে জোরে পাম্প করল রবিন। কলের মুখ দিয়ে তোড়ে বেরিয়ে এল পানি, ভিজিয়ে দিল বহুদিনের শুকনো সিংক।

রবিনকে সরিয়ে হাতল ধরল মুসা। পাম্প করে চলল। অনেক বছর পর আবার পানি উঠছে ট্যাংকে। ধুলো-ময়লা আর মরচে মিশে কালচে-লাল হয়ে কলের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে পানি। ধুয়ে পরিষ্কার হতে সময় লাগবে।

একনাগাড়ে পাম্প করে চলেছে মুসা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে পানি।

একটা কাপ ধুয়ে পানি নিল তাতে কিশোর। বরফের মত ঠাণ্ডা পানি, লালচে, রঙ রয়েছে সামান্য, তবে সেটা কেটে গেলে স্ফটিকের মত হয়ে যাবে। চুমুক দিয়ে দেখল। আহ, দারুণ। এক্কেবারে যেন ফ্রিজের পানি।

থাকার চমৎকার জায়গা পাওয়া গেছে, খাবার পানি মিলেছে, আর খাবার তো সঙ্গে করে নিয়েই এসেছে। মোমবাতি আর লাকড়ি আছে প্রচুর। আর কি চাই? বিছানা পেতে আরাম করে জাঁকিয়ে বসল ওরা।

খিদে পেয়েছে কারও? জিজ্ঞেস করল কিশোর। এই মুসা, খাবে?

আমারই পেয়েছে, আর ওর পাবে না? হেসে বলল জিনা।

কিছু রুটি, মাখন আর এক টিন গোশত খুলে নিয়ে বসল ওরা। খেতে খেতেই আলাপ-আলোচনা চলল, আগামীদিন কি কি করবে।

কি খুঁজছি আসলে আমরা? জানতে চাইল রবিন। কিছু লুকানো-টুকানো আছে ভাবছ?

হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর। কি আছে, তা-ও বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি।

কী? একই সঙ্গে প্রশ্ন করল তিনজন।

ধরি, দলের নেতা জেরি। সে রয়েছে জেলে। তার যে বন্ধু পালিয়েছিল, তার কাছে একটা মেসেজ দিয়েছে অন্য দুই বন্ধু বা সহকারীকে দেয়ার জন্যে। সেই দুজনের একজন হলো ডারটি রবিন, অন্যজন টিকসি।

ধরা যাক, বেশ বড় ধরনের একটা ডাকাতি করেছে জেরি, একে একে তিনজনের মুখের দিকে তাকাল কিশোর, আগ্রহে সামনে ঝুঁকে এসেছে ওরা। রাফিয়ানও যেন গভীর আগ্রহে শুনছে, এমনি ভাবসাব, জিনার গা ঘেঁষে রয়েছে। কি ডাকাতি করেছে, জানি না, তবে সম্ভবত গহনা। টাকাও হতে পারে। সেগুলো লুকিয়ে রেখেছে কোথাও। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে এলে তারপর বের করবে। যে কারণেই হোক, ডাকাতির পর পরই ধরা পড়ে কয়েক বছরের জন্যে জেলে গেছে সে। ডাকাতির মাল কোথায় রেখেছে, কিছুঁতেই বলেনি পুলিশকে। কিন্তু পুলিশ ছাড়বে কেন? যেভাবেই হোক, কয়েদীর মুখ থেকে কথা আদায় করবেই। সেটা বুঝতে পেরেছে জেরি। কি করবে সেক্ষেত্রে?

জেল-পালানো বন্ধুর কাছে মেসেজ দিয়ে দেবে, বলল রবিন, অন্য দুই সহকারীকে জানানোর জন্যে, চোরাই মাল কোথায় আছে। পুলিশ আসার আগেই ওগুলো বের করে নিয়ে চম্পট দেবে ওরা।

ঠিক তাই, মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

তাহলে ডাকাতদের আগে আমরা খুঁজে বের করব মালগুলো, জ্বলজ্বল করছে। জিনার চোখ। কাল ভোরে উঠেই খোঁজা শুরু করব।

হুঁ, তাহলে মেসেজের কোড বুঝতে হবে আগে, বলল মুসা। টু-ট্রীজ আর ব্ল্যাক ওয়াটার তো বুঝলাম। কিন্তু ওয়াটার মেয়ার?

জলঘোটকী, বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর।

কি বললে?

আঁ…জলঘোটকী, মানে পানির ঘোড়া। বোট…এই কোন নৌকা বা লঞ্চ।

ঠিক বলেছ, তর্জনী দিয়ে জোরে বাতাস কোপাল জিনা। যে জন্যে হ্রদ, সে জন্যে নৌকা। গোসলই যদি না করল, সাঁতার না কাটল আর নৌকা নিয়ে মাছ। ধরতে না গেল, তাহলে এতবড় হ্রদের ধারে কেন বাড়ি করতে যাবে লোকে? নিশ্চয় একটা বোট আছে কোথাও, তাতে চোরাই মাল লুকিয়েছে ব্যাটারা।

কিন্তু অতি সহজে রহস্য ভেদ হয়ে গেল না? সন্দেহ যাচ্ছে না রবিনের। একটা বোটে চোরাই মাল লুকাবে…যে কেউ দেখে ফেলতে পারে বোটটা… তাছাড়া, মেসেজ লেখা কাগজটায় আঁকিবুকিগুলো কিসের?

মুসা, হাত বাড়াল কিশোর, নকশাটা দেখি?

পকেট থেকে চার টুকরো ছেড়া কাগজ বের করে দিল মুসা।

হাসি মুখে ব্যাগ খুলে এক রোল টেপ বের করে দিল জিনা। নাও, কাজে লেগেই গেল। মনে হয়েছিল লাগতে পারে, তাই নিয়েছিলাম।

কাজের কাজ করেছ একটা, কিশোরও হাসল।

টেপ দিয়ে জুড়ে চার টুকরো কাগজ আবার এক করে ফেলা হলো।

এই যে দেখো, নকশায় আঙুল রাখল কিশোর, এখানে চারটে লাইন মিশেছে। প্রত্যেকটা লাইনের শেষ মাথায় লেখা…এত অস্পষ্ট করে লিখেছে… নুয়ে ভালমত দেখে একটা পড়ল সে, টক হিল।…এটা, স্টীপল…

আর এটা চিমনী, রবিন পড়ল তৃতীয় শব্দটা।

আর এটা হলো টল স্টোন, চতুর্থটা পড়ল জিনা।

দিল মাথা গরম করে, হাত ওল্টাল মুসা। বলি, মানে কি এগুলোর?

কিছু তো একটা নিশ্চয়, বলল কিশোর। শব্দগুলো মাথায় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

সকাল নাগাদ পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে।

নকশাটা সাবধানে ভাঁজ করে নিজের কাছে রেখে দিল কিশোর।

আরেকটা অংশ কিন্তু আছে টিকসির কাছে, মনে করিয়ে দিল মুসা। সেটা ছাড়া সমাধান হবে?

হতেও পারে, বলল কিশোর। হয়তো তার কাছেও এটারই আরেক কপি পাঠানো হয়েছে।

তাহলে তো সেও খুঁজতে আসবে এখানে, বলল জিনা। এলে আসবে, মুসা বলল। লুকিয়ে থাকব।

তারও দরকার নেই, মাথা নাড়ল কিশোর। আমাদের কাছে নকশা আছে জানছে কি করে? দেখে ফেললে বলব, ছুটিতে বেড়াতে এসেছি।

তারপর চোখ রাখব তার ওপর, হাসল রবিন। বেটি অস্বস্তি বোধ করবে?

করলে করুক, আমাদের কি… কথা শেষ না করেই চুপ হয়ে গেল মুসা, কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে।

গম্ভীর হয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধান। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, টিকসি একা আসবে বলে মনে হয় না। হয়তো ডারটিকে নিয়েই আসবে। ডারটির কাছে মেসেজ নেই তো কি হয়েছে? টিকসির কাছে আছে। একই মেসেজ হলে ওই একটাতেই চলবে। ডারটি যদি ওদের সহকারী হয়, কিছুঁতেই তাকে ফেলে আসবে না টিকসি।

হ্যাঁ, তাই তো, মাথা দোলাল রবিন। আর ডারটি মেসেজ পায়নি শুনলে সন্দেহ জাগবে। হুঁশিয়ার হয়ে যাবে।

তার মানে যতটা সহজ মনে হয়েছিল, হাই তুলতে তুলতে বলল রবিন, তত সহজ নয় ব্যাপারটা…এহ্, বড্ড ঘুম পেয়েছে। যাই, শুয়ে পড়ি।

মুসাও হাই তুলল। আমিও যাই।

যার যার বিছানায় শুয়ে পড়ল মুসা আর রবিন। ওদের কাছ থেকে দূরে ঘরের এক কোণে বিছানা পাতল জিনা। শুয়ে পড়ল। তার পায়ের কাছে রাফিয়ান।

একটা রেখে বাকি মোমগুলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল কিশোরও।

দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল চারজনেই।

লম্বা হয়ে শুয়ে আছে রাফিয়ান, চোখ বন্ধ, কিন্তু কান খাড়া। সামান্যতম শব্দ হলেই নড়েচড়ে উঠছে।

একবার মৃদু একটা শব্দ হতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। নাক উঁচু করে বাতাস শুকল, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সিঁড়ির কাছে। একটা ফাটলে নাক নিয়ে গিয়ে কল, পরক্ষণেই শান্ত হয়ে ফিরে এল আগের জায়গায়। সাধারণ একটা ব্যাঙ।

মাঝরাতের দিকে আবার মাথা তুলল সে। ওপরে রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে উঠে এল ওপরে। চাদের আলোয় পান্নার মত জ্বলে উঠল তার সবুজ চোখ।

দ্রুত চলে যাচ্ছে একটা জানোয়ার। রোমশ মোটা লেজ। শেয়াল। কুকুরের গন্ধ পেয়েই পালাচ্ছে।

সিঁড়ির মুখে অনেকক্ষণ বসে বসে পাহারা দিল রাফিয়ান। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল আবার।

গলে গলে শেষ হয়ে গেছে মোমটা। ঘর অন্ধকার। অঘোরে ঘুমোচ্ছে সবাই। জিনার পায়ের কাছে এসে আবার শুয়ে পড়ল সে।

সবার আগে ঘুম ভাঙল কিশোরের। শক্ত মেঝেতে শুয়ে পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে। চোখ মেলে প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় আছে, আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। সবাইকে ডেকে তুলল সে।

তাড়াহুড়ো করে হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে নিল সবাই। অনেক কাজ পড়ে আছে।

হ্রদের দিকে চলে গেছে একটা সরু পথ। দুই ধারে নিচু দেয়াল ছিল এক সময়, এখন ধসে পড়েছে। শেওলায় ঢেকে গেছে ইট। পথ ঢেকে দিয়েছে লতার জঙ্গল, মাঝে মাঝে ছোট ঝোপঝাড়ও আছে। পথের অতি সামান্যই চোখে পড়ে।

তেমনি নিথর হয়ে আছে কালো হ্রদটা। তবে তাতে, প্রাণের সাড়া দেখা যাচ্ছে এখন। ওদের দেখে কঁক করে পানিতে ডুব দিল একটা জলমুরগী।

বোটহাউসটা কোথায়? আনমনে বলল মুসা। আছে না নেই, তাই বা কে জানে।

হ্রদের ধারের পথ ধরে দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করছে ওরা, পারছে না। নানা রকম বাধা। লতা, ঝোপঝাড় যেন একেবারে পানির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠে এসেছে ডাঙায়। বোটহাউস চোখে পড়ছে না।

এক জায়গায় হ্রদ থেকে একটা খাল বেরিয়ে ঢুকে গেছে জঙ্গলেন মধ্যে।

মানুষের কাটা খাল, বলল, কিশোর। নিশ্চয় বোটহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

খালের পাড় ধরে এগোল ওরা। খানিক পরেই চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, ওই যে! লাতাপাতায় এমন ঢেকে গেছে, বোঝাই যায় না। হাত তুলে দেখাল সে।

দেখল সবাই। সরু হতে হতে এক জায়গায় গিয়ে শেষ হয়েছে খাল। ঠিক সেখানে খালের ওপর নেমে গেছে সরু লম্বা একটা বাড়ি। লতাপাতা ঝোপঝাড়ে এমন ঢেকে ফেলেছে, ভালমত না দেখলে ঠাহরই করা যায় না, ওখানে কোন বাড়িঘর আছে।

মনে হয় ওটাই, খুশি হয়ে উঠেছে মুসা। ওয়াটার মেয়ারকে পেলে হয় এখন।

বৈঁচি আর এক জাতের কাঁটা-গাছই বেশি। ওগুলোর ভেতর দিয়ে পথ করে এগোতে গিয়ে কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে শরীর, কিন্তু উত্তেজনায় খেয়ালই করছে না ওরা।

বাড়ির সামনেটা পানির দিকে, ওটাই সদর। একটা চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে পানির ধার থেকে।

ওখান দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু পা রাখতেই ভেঙে পড়ল পচা তক্তা। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। না, হবে না এদিক দিয়ে। অন্য পথ খুঁজতে হবে।

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর কোন পথ পাওয়া গেল না।

পুরো বাড়িটাই কাঠ দিয়ে তৈরি। শেওলা জমে রয়েছে সবখানে। এক জায়গায় দেয়ালের তক্তা পচে কালো হয়ে গেছে।

লাথি মারল মুসা। জুতোশুদ্ধ পা ঢুকে গেল পচা কাঠে।

চারজনে মিলে সহজেই দেয়ালের তক্তা ভেঙে বড় একটা ফোকর করে ফেলল। আগে ঢুকল কিশোর। অন্ধকার। বাতাসে কাঠ আর পচা লতাপাতার ভেজা দুর্গন্ধ।

চওড়া সিঁড়িটার মাথায় এসে দাঁড়াল সে। নিচে কালো অন্ধকার পানি, একটা ঢেউও নেই। ফিরে ডাকল, এসো, দেখে যাও।

সিঁড়ির মাথায় এসে নিচে তাকাল সবাই। আবছা অন্ধকার। নৌকা রাখার ছাউনি এটা-বোটহাউস। পানির দিকে মুখ, কিন্তু এখন পুরোপুরি ভোলা নেই। আগাছা আর লতা অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। ছাত থেকে ঝুলছে লতা, নিচের পানির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে জলজ আগাছা, এরই ফাঁক দিয়ে যতখানি আলো আসতে পারছে, আসছে। তবে অন্ধকার তাতে কাটছে না বিশেষ।

চোখে সয়ে এল আবছা অন্ধকার। দেখতে পাচ্ছে এখন।

ওই যে নৌকা! নিচের দিকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

খুঁটিতে বাঁধা। ওই তো, আমাদের ঠিক নিচেই একটা।

মোট তিনটে নৌকা। দুটো অর্ধেক ডুবে রয়েছে পানিতে, দুটোরই গলুই পানির নিচে।

তলা ফুটো হয়ে গেছে বোধহয়, ঝুঁকে নিচে চেয়ে আছে কিশোর। কোমরের বেল্ট থেকে টর্চ খুলে নিয়ে জ্বালল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আলো ফেলে দেখল বোটহাউসের ভেতরে।

দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে অনেকগুলো দাঁড়। কতগুলো কালচে থকথকে নরম জিনিস রয়েছে কয়েকটা তাকে, পাটাতনে ফেলে বসার গদি, পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এক কোণে একটা নোঙর পড়ে আছে। দড়ির বাণ্ডিল সাজানো রয়েছে একটা তাকে। বিষণ্ণ পরিবেশ। কথা বললেই বিচ্ছিরি প্রতিধ্বনি উঠছে।

পরিত্যক্ত বোটহাউস ভূতের বাসা—মনে পড়ে গেল মুসার। ভয়ে ভয়ে তাকাল চারদিকে। সে-ও টর্চ খুলে নিল। আলো জ্বেলে ভূত তাড়ানোর ইচ্ছে। নিচু গলায় বলল, ওয়াটার মেয়ার কোনটা?

ওই যে, একটা নৌকার গলুইয়ের কাছে আলো ফেলে বলল কিশোর, ওয়াটার কি যেন? কয়েক ধাপ নামল সে। ও, ওয়াটার লিলি।

আরেকটা নৌকার গলুইয়ের কাছে আলো ফেলল মুসা।

অকটোপাস, বলে উঠল রবিন।

বাহুঁ, চমৎকার, বলল মুসা। একটার নাম ওয়াটার লিলি, আরেকটা একেবারে অকটোপাস। মালিকের মাথায় দোষ ছিল।

আর ওই যে, ওটার কি নাম? তৃতীয় নৌকাটা দেখাল জিন। ওটাই ওয়াটার মেয়ার?

দুটো টর্চের আলো এক সঙ্গে পড়ল নৌকাটার গলুইয়ের কাছে। শুধু এম অক্ষরটা পড়া যাচ্ছে। সাবধানে আরও নিচে নামল কিশোর। তক্তা ভেঙে পানিতে পড়ার ভয় আছে। রুমাল ভিজিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করল নামের জায়গাটা।

হুঁ, বিড়বিড় করল কিশোর, অকটোপাস, লিটল মারমেইড, ওয়াটার লিলি…অকটোপাস, জলকুমারী, জলপদ্ম শিওর, জলঘোটকীও, এই পরিবারেরই মেয়ে…

অকটোপাসটা ছেলে, না? বলল মুসা।

কি জানি, হাত ওল্টাল কিশোর। ওটার মালিকই জানে।

কিন্তু ওয়াটার মেয়ারটা কোথায়? জিনার প্রশ্ন।

পানিতে ওদিকে কোথাও ডুবে আছে? বোটহাউসের মুখের দিকে দেখাল মুসা।

মনে হয় না, মাথা নাড়ল কিশোর। দেখছ না, পানি কম? ডুবে থাকলেও দেখা যেত। তলার বালি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।

তবু, আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আলো ফেলে দেখল পানির যতখানি চোখে পড়ে। আর কোন নৌকা নেই এখানে।

গেল কোথায় জলঘোটকী, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। কখন? কিভাবে? কেন?

বোটহাউসের ভেতরটা আরেকবার ভালমত দেখল ওরা। সিঁড়ির কাছে, বোটহাউসের এক পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে কাঠের বড় একটা জিনিস।

কি ওটা? জিনা বলল। ওহহো, ভেলা।

কাছে গিয়ে ভেলাটা ভাল করে দেখল সবাই।

বেশ ভাল অবস্থায়ই আছে, ভেলার গায়ে হাত বোলাল কিশোর। ইচ্ছে করলে আমরা পাঁচজনেই চড়তে পারব এটাতে।

দারুণ মজা হবে, আনন্দে হাত তালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল জিনা। ভেলায় চড়তে যা ভাল্লাগে না আমার। নৌকার চেয়েও মজার।

নৌকাও একটা আছে অবশ্য, কিছু ভাবছে কিশোর। ইচ্ছে করলে ওটাতেও চড়া যায়।

আচ্ছা, তিনটে নৌকাই খুঁজে দেখলে হয় না? প্রস্তাব দিল মুসা। লুটের মাল আছে কিনা?

দরকার নেই, বলল কিশোর। তাহলে জলঘোটকীর নাম থাকত না মেসেজে। তোমার সন্দেহ থাকলে গিয়ে খুঁজে দেখতে পারো।

কিশোর পাশা যখন বলছে নেই, থাকবে না।

এক কাজ করো, আবার বলল কিশোর। সন্দেহ যখন হয়েছে, গিয়ে খুঁজে দেখো। এসব ব্যাপারে হেলাফেলা করা উচিত নয়। শিওর হয়েই যাই।

কিন্তু ওয়াটার মেয়ার গেল কোথায়? বলল সে। পরিবারের সবাই এখানে হাজির, আরেকটা গিয়ে লুকাল কোথায়? হ্রদের তীরে কোথাও লুকানো হয়েছে?

হ্যাঁ, তা হতে পারে, ভেলাটা ঠেলছে কিশোর, থেমে গেল। ডাঙায় না হোক, পাড়ের নিচে কোথাও কোন গলিঘুপচিতে লুকিয়ে রেখেছে হয়তো।

চলো না তাহলে, এখনি খুঁজে দেখি, ভেলায় চড়ার লোভ আপাতত চাপা দিল জিনা।

দেয়ালের ভাঙা ফোকর দিয়ে আবার বাইরে বেরোল ওরা। বুক ভরে টেনে নিল তাজা বাতাস। বোটহাউসের দুর্গন্ধ থেকে দূরে আসতে পেরে হাঁপ ছেড়েছে। সব চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে রাফিয়ান। অন্ধকার ওই ঘরটা মোটেও ভাল লাগছিল

তার। এই তো, কি চমৎকার উষ্ণ রোদ, কি আরামের বাতাস, লেজের রোম কি সুন্দর ফুলিয়ে দেয় ফুঁ দিয়ে।

কোনদিক থেকে শুরু করব? বলল রবিন। ডান, না বাম?

নীরবে পানির ধারে এগিয়ে গেল কিশোর, পেছনে অন্যেরা। ডানেও তাকাল, বায়েও। কিন্তু কোন দিকেই কোন পার্থক্য নেই, দু-দিকেই সমান ঘন ঝোপঝাড়।

পানির কাছাকাছি থাকাই মুশকিল, বলল কিশোর। দেখা যাক তবু। চলো, বাঁ দিক থেকেই শুরু করি।

শুরুতে জঙ্গল তেমন ঘন নয়, পানির কাছাকাছি থাকা গেল। পানির ওপর ঝুঁকে রয়েছে লতানো ঝোপ, যে কোনটার তলায় লুকিয়ে রাখা যায় নৌকা। উঁকি দিয়ে, পাড়ের নিচে নেমে, যতভাবে সম্ভব, নৌকা আছে কিনা দেখার চেষ্টা করল ওরা।

সিকি মাইল পর থেকেই ঘন হতে শুরু করল জঙ্গল। এত ঘন যে পথ করে এগোনোই কঠিন, থাক তো পানির ধারে গিয়ে উঁকি দেয়া। পানির ধারে মাটি রসাল বলেই বোধহয়, জঙ্গল ওখানে আরও বেশি ঘন।

নাহ্, এভাবে হবে না, এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে বলল কিশোর। যা কাঁটা। শেষে চামড়া নিয়ে ফিরতে পারব না।

হ্যাঁ, কাঁটা বেশিই, দুই হাতের তালু দেখছে মুসা, কেটে ছড়ে গেছে, কোন আঁচড়, এত গভীর, রক্ত বেরোচ্ছে। ঠিকই বলেছ, এভাবে হবে না।

অন্য দুজনেরও একই অভিমত। আনন্দ পাচ্ছে শুধু রাফিয়ান। বার বার উৎসুক চোখে তাকাচ্ছে বনের দিকে। বুঝতে পারছে না যেন, এত সুন্দর কাটা আর ঝোপকে কেন পছন্দ করছে না বোকা ছেলে-মেয়েগুলো?

ছেলেরা যখন ফিরল, রীতিমত আহত বোধ করল রাফিয়ান। হতাশ ভঙ্গিতে হেঁটে চলল ওদের পেছনে।

ডানে চেষ্টা করে দেখব নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

নাহ্‌ লাভ হবে না,মাথা নাড়ল কিশোর। ওদিকে আরও বেশি জঙ্গল। খামোকা সময় নষ্ট। তার চেয়ে এক কাজ করি এসো?…ভেলায় চড়ে ঘুরি?

ঠিক বলেছ। দারুণ হবে, সঙ্গে সঙ্গে বলল জিনা। কষ্টও হবে না, তাছাড়া পানির দিক থেকে দেখার সুবিধে অনেক। কোন ঘুপচিই চোখ এড়াবে না। সহজেই খুঁজতে পারব।

ইস্, আগে মনে পড়ল না কেন? আফসোস করল মুসা। তাহলে তো এভাবে হাত-পাগুলো ছুলতে হত না।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আবার বোটহাউসের দিকে রওনা হলো ওরা।

হঠাৎ থেমে গেল রাফিয়ান। চাপা গর্জন করে উঠল।

কি হয়েছে, রাফি? থেমে গিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল জিনা।

আবার গোঁ গোঁ করে উঠল রাফিয়ান।

সাবধানে পিছিয়ে গেল চারজনে। একটা ঝোপের ভেতর থেকে মাথা বের করে তাকাল বোটহাউসের দিকে। কই, কিছুই তো নেই? এমন করছে কেন তাহলে রাফিয়ান?

সবার আগে দেখল মুসা। কিশোরের পাঁজরে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল।

এক তরুণী, আর একটা লোক। কথা বলছে।

নিশ্চয় টিকসি, ফিসফিস করে বলল কিশোর।

আর ওই ব্যাটা ডারটি রবিন, মুসা বলল, আমি শিওর।

ওই দুজন আসবে, জানাই আছে ছেলেদের, তাই চমকাল না।

।ডারটিকে চিনতে কোন অসুবিধে হয়নি মুসার। রাতে দেখেছে, সকালেও দেখেছে—চওড়া কাঁধ, সোজা হয়ে দাঁড়ালে সামান্য কুঁজো মনে হয়, মাথায় ঝাকড়া চুল। তবে, তার বাড়িতে তাকে যেমন লেগেছিল, এখন ঠিক ততটা ভীষণ মনে হচ্ছে না।

তবে মেয়েমানুষটাকে কেউই পছন্দ করতে পারছে না, একটুও না। পরনে ডোরাকাটা প্যান্ট, গায়ে রঙিন শার্টের ওপর আঁটসাট জ্যাকেট, চোখে বেমানান রকমের বড় সানগ্লাস, দাঁতের ফাঁকে চুরুট। ওর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, তীক্ষ্ণ স্বর।

ও-বেটিই তাহলে টিকসি, ভাবল কিশোর। জেরি ডাকাতকে দেখিনি, তবে ভালই সঙ্গিনী জুটিয়েছে ডাকাতটা।

সঙ্গীদের দিকে ফিরল গোয়েন্দাপ্রধান। রাফিয়ানের গলার বেল্ট টেনে ধরে রেখেছে জিনা, বেরোতে দিচ্ছে না। শোনো, কিশোর বলল, ওদেরকে না চেনার ভান করবে। কথা বলতে বলতে বেরোব আমরা, যেন জঙ্গল দেখতে ঢুকেছিলাম। যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, বলবে বেড়াতে এসেছি। উল্টো-পাল্টা যা খুশি বলবে। বোঝাব, আমরা মাথামোটা একদল ছেলে-মেয়ে, স্রেফ ছুটি কাটাতে এসেছি। আর বেকায়দ কোন প্রশ্ন যদি করে, চুপ করে থাকবে, আমি জবাব দেব। ও-কে?

মাথা ঝাঁকাল তিনজনেই।

ঝোপের ভেতর থেকে বেরোল কিশোর হুড়মুড় করে। ডাকল, মুসা, এসো। ওই যে, বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। মাই গড়, সকালের চেয়েও খারাপ দেখাচ্ছে এখন।

জিনা আর রাফিয়ান একসঙ্গে লাফিয়ে বেরোল, তাদের পেছনে এল রবিন।

থমকে দাঁড়িয়ে গেল দুই ডাকাত। দ্রুত কি যেন বলল একে অন্যকে। ভুরু কুঁচকে তাকাল লোকটা।

বকবক করতে করতে ওদের দিকে এগোল ছেলেরা।

তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মেয়েমানুষটা, কে তোমরা? এখানে কি করছ?

বেড়াতে এসেছি, জবাব দিল কিশোর। ঘোরাফেরা করছি। স্কুল ছুটি।

এখানে কেন এসেছ? এটা প্রাইভেট প্রপার্টি।

তাই নাকি? বোকার অভিনয় শুরু করল কিশোর। পোড়া, ভাঙাচোরা বাড়ি, জঙ্গল:যার খুশি এখানে আসতে পারে। আসলে লেকটা দেখতে এসেছি। খুব নাম শুনেছি তো।

পরস্পরের দিকে তাকাল দুই ডাকাত। ছেলেদের দেখে অবাক হয়েছে, বোঝা যায়।

কিন্তু এ-হ্রদ দেখতে আসা উচিত হয়নি, বলল মেয়েমানুষটা। খুব বাজে জায়গা, বিপদ হতে পারে। সাঁতার কাটা কিংবা নৌকা-চড়া এটাতে নিষেধ।

তা-তো বলেনি আমাদেরকে! যেন খুব অবাক হয়েছে কিশোর। নিষিদ্ধ, তাও বলেনি। আপনারা ভুল খবর পেয়েছেন।

বাহ, কি সুন্দর একটা ডাহুক গো! হাত তালি দিয়ে নেচে উঠল রবিন। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে হ্রদের দিকে চেয়ে। কি ভাল জায়গা। কত জানোয়ার আর পাখি যে আছে।

বুনো ঘোড়াও নাকি অনেক, মুসা যোগ করল। গতকালই তো দেখলাম কয়েকটাকে। খুব সুন্দর ছিল, না?

দ্বিধায় পড়ে গেল দুই ডাকাত।

কড়া গলায় ধমক দিল ডারটি, চুপ! যত্তোসব! এখানে আসা নিষেধ, শুনছ? ঘাড়ে হাত পড়ার আগে কাটো।

নিষেধ? কণ্ঠস্বর হঠাৎ পাল্টে ফেলল কিশোর, কঠিন হয়ে উঠেছে চেহারা। তাহলে আপনারা এখানে কি করছেন? আর, ভদ্রভাবে কথা বলুন।

তবে রে আমার ভদ্রলোক! চেঁচিয়ে উঠল ডারটি, গেছে মেজাজ খারাপ হয়ে। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে আগে বাড়ল।

রাফিয়ানের বেল্ট ছেড়ে দিল জিনা।

সামনে এগোল কুকুরটা। ভয়ানক হয়ে উঠেছে চেহারা, ঘাড়ের নোম খাড়া। চাপা ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে গলার গভীরে।

চমকে গেল ডারটি। পিছিয়ে গেল আবার। ধরো, কুত্তাটাকে ধরো! হারামী জানোয়ার!

হারামী লোকের জন্যে হারামী জানোয়ারই দরকার, শান্ত কণ্ঠে বলল জিনা। তুমি যেমন কুকুর, ও-ও তেমন মুগুর। তোমরা যতক্ষণ কাছে-পিঠে থাকছ, ওকে ছেড়ে রাখব।

চাপা গর্জন করে আরও দুই কদম এগোল রাফিয়ান। চোখে আগুন।

চেঁচিয়ে উঠল মেয়েলোকটা, হয়েছে হয়েছে, রাখো। এই মেয়ে, তোমার কুত্তাটা ধরো। আমার এই বন্ধু না…ওর মেজাজ ভাল না।

আমার এই বন্ধুটিরও মেজাজ খারাপ, রাফিয়ানকে দেখাল জিনা। তোমাদের সইতে পারছে না। ঘাড়ে কামড় দিতে চায়। কতক্ষণ আছ তোমরা?

সেটা তোমাকে বলব কেন? গর্জে উঠল ডারটি।

তার গর্জনের জবাবে দ্বিগুণ জোরে গর্জে উঠল রাফিয়ান। আরেক পা পিছিয়ে গেল ডারটি।

চলো, খিদে পেয়েছে, সঙ্গীদের বলল কিশোর। এদের নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আমরা যেমন অন্যের জায়গায় এসেছি, ওরাও এসেছে।

সহজ ভঙ্গিতে হাটতে শুরু করল অভিযাত্রীরা। দুই পা এগিয়ে ফিরে চেয়ে সঁতমুখ খিচিয়ে আরেকবার শাসাল রাফিয়ান, তারপর চলল বন্ধুদের সঙ্গে।

দুই ডাকাতের চোখে তীব্র ঘৃণা, কিন্তু বিশাল কুকুরটার ভয়ে কিছু করতে পারল, দৃষ্টির আগুনে ছেলেদের ভস্ম করার চেষ্টা চালাল শুধু।

ওদেরকে আরও রাগিয়ে দেয়ার জন্যে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল জিনা, রাফি, খেয়াল রাখবি। ব্যাটাটাকে ধরবি আগে।

পোড়া বাড়িটায় পৌঁছল ওরা। বলতে হলো না, রান্না ঘরের দরজায় পাহারায় বসল রাফিয়ান। দুই ডাকাতের দিকে ফিরে মুখ ভেঙচাল একবার, বুঝিয়ে দিল, কাছে এলে ভাল হবে না।

ভাঁড়ারে ঢুকল অন্যেরা। যেটা যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনিই আছে, কেউ

হাত দেয়নি।

ঢোকেইনি হয়তো এখনও, বলল কিশোর। দেখেনি। যতটা ভেবেছি, তার চেয়েও বাজে লোক ওই দুটো, টিকসি আর ডারটি।

হ্যাঁ, একমত হলো মুসা, জঘন্য। মেয়েমানুষটা বেশি খারাপ। চেহারাটাও জানি কেমন রুক্ষ।

আমার কাছে ডারটিকেই বেশি খারাপ লেগেছে, রবিন বলল। আস্ত একটা গরিলা। চুল কাটে না কেন?

কি জানি, একটা রুটির মোড়ক খুলতে শুরু করল জিনা। হয়তো ভাবছে সিনেমায় চান্স-টান্স পাবে। টারজানের বিকৃত সংস্করণ।

রাফি না থাকলে কিন্তু বিপদে পড়তাম, বলল রবিন। ও-ই ঠেকিয়েছে ব্যাটাদের।

কি করছে ব্যাটারা, দেখে আসা দরকার, প্রায় অর্ধেকটা পাউরুটি আর এক খাবলা মাখন তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল মুসা।

আধ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল সে। রুটি আর মাখন শেষ। ব্যাটাকে দেখলাম বোটহাউসের দিকে যাচ্ছে। ওয়াটার মেয়ারকে খুঁজতে বোধহয়।

হুঁ, খেতে খেতে বলল কিশোর। ব্যাপারটা নিয়ে আরও ভালমত ভাবতে হবে। কি করবে ওরা এখন? জানা আমাদের জন্যে খুব জরুরী। হয়তো মেসেজের পাঠোদ্ধার করে ফেলেছে ওরা, কঠিন শব্দ ব্যবহার শুরু করল সে। ওদের ওপর চোখ রাখতে হবে। দুর্বল মুহূর্তে কিছু ফাঁস করে দিতে পারে আমাদের কাছে।

মেসেজের সঙ্গে যে নকশাটা দিয়েছে জেরি, নিশ্চয় তার কোন মানে আছে, আপনমনে বলে যাচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধান। হয়তো সেটা বুঝতে পেরেছে ডারটি আর টিকসি। রুটি চিবাতে চিবাতে ভাবনার অতলে তলিয়ে গেল সে। দীর্ঘ নীরবতার পর ভেসে উঠল আবার। আজ বিকেলেই কিছু একটা করতে হবে আমাদের। ভেলাটা ভাসিয়ে বেরিয়ে পড়ব হদে। যে কোন ছেলেমেয়েই তা করতে পারে, এতে কিছু সন্দেহ করবে না দুই ডাকাত। নৌকাটা খুঁজব আমরা। আর যদি হদে বেরোয় টিকসি আর ডারটি, একই সঙ্গে ওদের ওপরও চোখ রাখতে পারব।

চমত্তার বুদ্ধি, আঙুলে চুটকি বাজাল জিনা। দারুণ সুন্দর বিকেল। হদে ভেলা ভাসিয়ে দাঁড় টানা…আউফ! এখুনি বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।

আমারও, মাথা কাত করল মুসা। ভেলাটা আমাদের ভার সইতে পারলেই হয়.জিনা, আরেক টুকরো কেক দাও তো। বিস্কুট আছে?

অনেক, জবাব দিল রবিন। চকলেটও আছে।

খুব ভাল, এক কামড়ে এক সুইস কেকের অর্ধেকটা কেটে নিয়ে চিবাতে শুরু করল মুসা। এখানেই থাকতে হবে মনে হচ্ছে। খাবারে টান না পড়লেই বাঁচি।

যে হারে গেলা শুরু করেছ, জিনা ফোড়ন কাটল, শেষ না হয়ে উপায় আছে? বিদেশ-বিভুঁই, খাবারের সমস্যা আছে, একটু কম করে খাও না বাবা…

জিনা, হাত বাড়াল কিশোর, জগটা দাও তো, পানি নিয়ে আসি। আর রাফির জন্যে কি দেবে দাও।

ধীরে সুস্থে পুরো আধ ঘণ্টা লাগিয়ে লাঞ্চ শেষ করল ওরা। এবার বোটহাউসে গিয়ে ভেলা নিয়ে বেরোনো যায়।

বোট হাউসের দিকে রওনা হলো ওরা।

হদের দিকে চেয়ে হঠাৎ বলে উঠল কিশোর, দেখো দেখো, ওই যে। নৌকা নিয়ে বেরিয়েছে ব্যাটারা। নিশ্চয় জলকুমারী, ওটাই একমাত্র ডোবেনি। শিওর, জলঘোটকীকে খুঁজছে ওরা।

দাঁড়িয়ে গেল সবাই। মুসার মুখ গোমড়া হয়ে গেল। এত কষ্ট কি শেষে মাঠে মারা যাবে? তাদের আগেই ওয়াটার মেয়ারকে পেয়ে যাবে ওই দুই ডাকাত? ওরা কি জানে, নৌকাটা কোথায় লুকানো।

দেয়ালের ফোকর দিয়ে বোটহাউসে ঢুকল ওরা। সোজা এগোল ভেলার দিকে। ঠিকই আন্দাজ করেছে কিশোর, লিটল মারমেইডকেই নিয়ে গেছে।

ভেলার কোণার চার ধারে দড়ির হাতল লাগানো রয়েছে, ধরে নামানোর জন্যে। চারজনে চারটে হাতল ধরে ভেলাটা তুলে নিয়ে চওড়া সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। সতর্ক রয়েছে, ভারের চোটে না আবার ভেঙে পড়ে পুরানো সিঁড়ি।

ভাঙল না। পানির কিনারে চলে এল ওরা।

এবার ছাড়ো, বলল কিশোর। আস্তে।

যতটা পারল আস্তেই ছাড়ল ওরা, কিন্তু ভারি ভেলা। ঝপাত করে পড়ল পানিতে, পানি ছিটকে উঠে ভিজিয়ে দিল ওদের শরীর।

দাঁড়গুলো খুলে নিয়ে এসো, এক কোণার হাতল ধরে রেখেছে কিশোর, নইলে ভেসে যাবে ভেলা। জলদি।

Categories: