ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের দাঁড় ঝোলানো রয়েছে দেয়ালে। ভেলা বাওয়ার জন্যে বিশেষভাবে তৈরি চারটে ছোট দাড়ি রয়েছে ওগুলোর মধ্যে। খুলে নিয়ে আসা হলো ওগুলো।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে রাফিয়ান। কোন কাজে সহায়তা করতে পারছে না। খারাপ লাগছে তার, বুঝিয়ে দিচ্ছে ভাবেসাবে।
কোণের হাতল ধরেই রয়েছে কিশোর। দাঁড় হাতে আগে উঠল মুসা। বালিতে দাড়ের ঠেকা দিয়ে ভেলা আটকাল। এরপর উঠল জিনা। দুজনেই দাঁড় বাওয়ায় ওস্তাদ। রবিন উঠল। সব শেষে উঠল কিশোর…না না, ভুল হলো, রাফিয়ানের আগে উঠল সে।
রাফি, আয়, হাত নেড়ে ডাকল জিনা। এ-রকম নৌকায় চড়িসনি আগে, কিন্তু অসুবিধে হবে না। আয়।
সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পানির কিনারে নেমে এল রাফিয়ান। কালো পানি শুকল একবার, পছন্দ হচ্ছে না। তবে আর ডাকের অপেক্ষা করল না। মস্ত এক লাফ দিয়ে হঠাৎ করে এসে পড়ল ভেলায়।
জোরে ঝাঁকি দিয়ে এক পাশে কাত হয়ে গেল ভেলা।
দ্রুত আরেক পাশে একেবারে কিনারে চলে গেল রবিন, ভারসাম্য ঠিক করল। হেসে বলল, চুপ করে বোস। যা একখান বপু তোমার, নড়াচড়ারই আর জায়গা নেই। ডুবিয়ে মেরো না সব্বাইকে।
রবিনের কথায় কিছু মনে করল না রাফিয়ান। চুপ করে বসল।
বালিতে দাঁড়ের মাথা ঠেকিয়ে লগি-ঠেলার মত করে ভেলাটাকে বোটহাউস থেকে বের করে আনতে শুরু করল মুসা। জিনাও হাত লাগাল। বোটহাউসের মুখের লতাপাতা অনেকখানি পরিষ্কার করে নিয়েছে দুই ডাকাত, নৌকা বের করার সময়। কাজেই ছেলেদের আর কিছু পরিষ্কার করতে হলো না। সহজেই খালে বেরিয়ে এল ওরা।
শান্ত পানি, ভেলাটাও শান্তই রইল। ঢেউ থাকলে অসুবিধে হত, বোঝা বেশি।
এক সঙ্গে দাঁড় বেয়ে চলল চারজনে।
রাফিয়ান দাঁড়িয়ে দেখছে। ভেলার পাশ দিয়ে সাঁ সঁ করে সরে যাচ্ছে পানি, বেশ মজা পাচ্ছে সে। ভাবছে বোধহয়, এটাও কোন ধরনের নৌকা। সাবধানে সামনের এক পা বাড়িয়ে পানি ছুঁল সে, ঠাণ্ডা, সুড়সুড়ি দিল যেন পায়ে। কুকুরে-হাসি হেসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে, ভোতা নাকটা পানি ছুঁই ছুঁই করছে।
মজার কুকুর তুই, রাফি, বলল রবিন। শুয়েছিস, ভাল। দেখিস, লাফিয়ে উঠিস না হঠাৎ। ভেলা উল্টে যাবে।
খালের মুখের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে ভেলা। নৌকাটা দেখা যাচ্ছে না।
ওই যে, ভেলা আরও খানিক দূর এগোনোর পর হাত তুলল কিশোর। হ্রদের মাঝেই আছে এখনও নৌকাটা। লিটল মারমেইড। পিছু নেব নাকি? দেখব কোথায় যায়?
অসুবিধে কি? বলল মুসা।
জোরে জোরে দাঁড় বাইতে শুরু করল সবাই। দুলে উঠল ভেলা।
আরে, ও কি করছ? কিশোরকে বলল মুসা। উল্টোপাল্টা ফেলছ তো। ভেলা এগোবে না, ঘুরবে খালি। এভাবে ফেলো, এই এভাবে, দেখিয়ে দিল সে।
যতই দেখিয়ে দেয়া হোক, বিশেষ সুবিধে করতে পারল না কিশোর আর রবিন। বিরক্ত হয়ে শেষে বলল মুসা, না পারলে চুপ করে বসে থাকো। আমি আর জিনাই পারব। খালি খালি অসুবিধে করবে আরও।
সানন্দে হাত গুটিয়ে বসল কিশোর। দাঁড় বাওয়ার চেয়ে মাথা খাটানো অনেক
বেশি পছন্দ তার। তা-ই করল।
জিনা আর মুসাও খুব খুশি, মনের মত কাজ পেয়ে গেছে। ঘেমে উঠছে শরীর। উষ্ণ কোমল রোদ, বাতাস নেই, শরতের নির্মল বিকেল।
দাঁড় বাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, নৌকাটার দিকে ইশারা করে বলল জিনা। খুঁজছে। কিশোর, কি মনে হয়? আমাদেরটার মতই মেসেজ আছে ওদের কাছে? ইস্ যদি দেখতে পারতাম।
কিশোরের নির্দেশে দাঁড় বাওয়া বন্ধ করল মুসা আর টিকসি। এতই ঝুঁকেছে, কপালে কপাল লেগে গেছে প্রায়।
আস্তে দুই টান দাও তো, বলল কিশোর। আরেকটু কাছে এগোই। দেখি, কি দেখছে ব্যাটারা।
নৌকার একেবারে পাশে চলে এল ভেলা। ঘেউ ঘেউ করে উঠল রাফিয়ান। চমকে মুখ তুলে তাকাল দুই ডাকাত। ছেলেদের দেখে কালো হয়ে গেল মুখ।
হাল্লো, দাঁড় তুলে নাড়ল মুসা, হাসি হাসি মুখ। চলেই এলাম। খুব ভাল চলছে ভেলা। তোমাদের নৌকা কেমন?
রাগে লাল হয়ে গেল টিকসির মুখ। চেঁচিয়ে বলল, কাকে বলে ভেলা বের করেছ? বিপদে পড়বে।
তাই তো জিজ্ঞেস করতে এলাম, কিশোর বলল, তোমরা কাকে জিজ্ঞেস করে নৌকা বের করেছ। গিয়ে অনুমতি নিয়ে আসব তার কাছ থেকে।
হেসে উঠল জিনা, গা জ্বালিয়ে দিল দুই ডাকাতের।
কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে রাগে ফুলতে শুরু করল টিকসি। ডারটির ভাব দেখে মনে হলো, দাড়ই ছুড়ে মারবে কিশোরের মুখে। গর্জে উঠল, কাছে আসবি না বলে দিলাম। মেরে তক্তা করে দেব।
রাগ করছ কেন, ভাই? মোলায়েম গলায় বলল মুনা। আমরা তো ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে এলাম। ভাব করে নেওয়া ভাল না?
আবার হেসে উঠল জিনা, বিছুটি ডলে লাগাল যেন ডাকাতদের চামড়ায়। .
পারলে ছেলেদের এখন টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে ওরা। কিন্তু সামলে নিল টিকসি। নিচু গলায় দ্রুত কিছু পরামর্শ করল ডারটির সঙ্গে। রাগে বার দুই মাথা ঝাঁকাল গরিলাটা, কিন্তু শেষে মেনে নিল টিকসির কথা। পঁাড় তুলে নিয়ে ঝপাং করে ফেলল পারিতে, দ্রুত বেয়ে চলল।
চালাও, বলল কিশোর। পিছু নাও, সে-ও নিষ্ক্রিয় রইল না আর, অসুবিধে করে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতে চায় দাঁড় বাওয়ায়। …
পশ্চিম তীরের দিকে নৌকা নিয়ে যাচ্ছে ডারটি। ভেলাটাও পিছে লেগে রইল। মাঝপথেই সাঁই করে নৌকার মুখ ঘোরাল।
নৌকা হালকা, ভেলা ভারি, চলনও নৌকার চেয়ে ভারি। ফলে, চারজনে বেয়েও একজনের সঙ্গে তাল রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। ঘনঘন ওঠানামা করছে বুক।
ডান তীরে নৌকা নিয়ে গেল ডারটি। ভেলাটা কাছাকাছি হওয়ার অপেক্ষায় রইল।
ভাল এক্সারসাইজ, তাই না? ডেকে বলল টিকসি। স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল।
আবার হ্রদের মাঝখানে রওনা দিল নৌকা।
খাইছে! হুঁসস করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল মুসা। হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে আমার। কি করছে ব্যাটারা?
খামোকা খাঁটিয়ে নিচ্ছে, দাঁড় তুলে ফেলেছে কিশোর। আমরা থাকলে জলঘোটকীকে আর খুঁজবে না। খেলাচ্ছে আমাদের।
তাহলে আর খেলতে যাচ্ছি না আমি, বুড়ো আঙুল নাড়ল মুসা। দাঁড় তুলে রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল, হাঁপাচ্ছে।
অন্যেরাও বিশ্রাম নিতে লাগল।
বন্ধুদের অবস্থা দেখে করুণা হলো যেন রাফিয়ানের, উঠে এসে এক এক করে গাল চেটে দিল চারজনেরই। তারপর ভুল করে বসে পড়ল জিনার পেটের ওপর।
হেই রাফি! আরে, দম বন্ধ হয়ে গেল তো আমার। কুকুরটাকে জোরে ঠেলে দিল জিনা। ভারিও বটে! বাপরে বাপ!
খুব অন্যায় হয়ে গেছে, বুঝতে পারল রাফিয়ান। আরেকবার জিনার গাল চেটে দিতে গেল।
এত বেশি শ্রান্ত, এসব ভাল লাগছে না জিনার। থাপ্পড় দিয়ে সরিয়ে দিল কুকুরটার মুখ।
নৌকাটা কই? উঠে বসে দেখার শক্তিও নেই যেন রবিনের।
গোঙাতে গোঙাতে উঠে বসল কিশোর। ওফফ, বিকৃত করে ফেলল মুখ, পিঠটা গেছে। ব্যথাআ! গেল কই হতচ্ছাড়া নৌকা…ও, ওই যে, খালের দিকে যাচ্ছে। আপাতত জলঘোটকী খোঁজা বাদ।
আমাদেরও বাদ দেয়া উচিত, হাতের পেশী টিপতে টিপতে বলল রবিন। যা ব্যথা হয়েছে, কালও বেরোতে পারব কিনা…হেই রাফি, সর! আমার ঘাড়ে কি মধু? যা, চাটতে হবে না।
চলো, আমরাও ফিরে যাই, বলল কিশোর। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আর নৌকা খোঁজার সময় নেই।
চলো, জিনা বলল। দাঁড়াও আরেকটু জিরিয়ে নিই। আরি, আবার বসল দেখি পায়ের ওপর….এই রাফি, সর। লাথি মেরে ফেলে দেব কিন্তু পানিতে।
কিন্তু লাথি আর মারতে হলো না। পানিতে পড়ার শব্দ হলো। লাফিয়ে উঠে বসল জিনা। ভেলায় নেই রাফিয়ান।
পানিতে সাঁতার কাটছে। খোশমেজাজেই আছে।
কি আর করবে বেচারা? হেসে বলল মুসা। সবাই খালি দূর দূর করছ। ভেলায় নেই জায়গা। বসবে কোথায় ও? মনের দুঃখে তাই আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়োতে চাইছে।
তুমি ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছ, রেগে উঠল জিনা।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল মুসা। খেয়েদেয়ে তো আর কাজ নেই আমার।
তাহলে পড়ে কি করে?
আমি কি জানি?
দেখো, আমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলবে না…
তো কিভাবে…
আহ, কি শুরু করলে? ধমক দিল কিশোর। চুপ করো। রাফিকে টেনে তোলা দরকার। নিজে নিজে উঠতে পারবে না ও।
টেনেহিঁচড়ে ভেলায় তোলা হলো রাফিয়ানকে। মুসাই সাহায্য করল বেশি। লজ্জিত হয়েছে জিনা। এখন আবার মুসার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে।
উঠেই জোরে গা ঝাড়া দিল রাফিয়ান। পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিল সবার চোখমুখ। এহহে, পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে হেসে উঠল রবিন, ব্যাটা নিজেও ভিজেছে, আমাদেরও ভেজাচ্ছে।
দেখতে দেখতে আবার সহজ হয়ে এল ওরা। তখন এত বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, মেজাজ ঠিক রাখতে পারছিল না কেউই।
খুব সুন্দর বিকেল। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে কিশোরের চোখ। ধীরে ধীরে দাঁড় টানছে জিনা আর মুসা। হ্রদের কালচে নীল পানিতে ঢেউয়ের রিঙ তৈরি হচ্ছে, বড় হতে হতে ছড়িয়ে গিয়ে ভাঙছে সোনালি ঝিলিক তুলে। ভেলার দুপাশেও সোনালি : ফেনা। পাশে সঁতার কাটছে দুটো জলমোরগ, বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা ঘোরাচ্ছে আর কিক কিক করছে, আসছে ভেলার সঙ্গে সঙ্গে।
পানির কিনারে পাড়ের ওপর গড়িয়ে ওঠা বড় বড় গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে চলে গেছে রবিনের নজর। সিঁদুর-লাল আকাশ। মাইলখানেক দূরের পাহাড়ী ঢালে বিশেষ একটা জিনিস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার।
উঁচু একটা পাথর।
সেটার দিকে হাত তুলে বলল রবিন, কিশোর, দেখো? ওই যে পাথরটা। সীমানার চিহ্ন? অনেক বড় কিন্তু।
কই? কিশোর বলল। ও, ওটা? কি জানি, বুঝতে পারছি না।
অনেক লম্বা… বলতে গেল মুসা।
কথাটা ধরে ফেলল কিশোর। কি যেন মনে পড়ে গেছে। লম্বা! টল স্টোন। নকশায় লেখা রয়েছে না?
হ্যাঁ, তাই তো, মাথা ঝাঁকাল মুসা। চেয়ে আছে দূরের পাথরটার দিকে।
চার জোড়া চৌখই এখন ওটার দিকে। ভেলা চলছে। আস্তে আস্তে গাছপালার আড়ালে হারিয়ে গেল পাথরটা।
টল স্টোন, আবার বিড়বিড় করল কিশোর। ভুলেই গিয়েছিলাম।
তোমার কি মনে হয়, জিনা বলল, ওটার তলায়ই লুকানো আছে লুটের মাল?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। হয়তো একটা দিক-নির্দেশ…এই, জলদি বাও। তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার, রাতের আগে।
বোটহাউসে ঢুকল ভেলা। খুঁটিতে আগের জায়গায় বাঁধা রয়েছে লিটল মারমেইড, ডারটি আর টিকসি নেই।
গেল কোথায়? টর্চ জ্বেলে দেখছে কিশোর। শোনো, ভেলাটা এখানে রাখা ঠিক না। চলো, কোন ঝোপের তলায় লুকিয়ে রাখি।
ঠিকই বলেছে কিশোর। অন্যেরাও একমত হলো। হাত অবশ হয়ে গেছে। তবু কোনমতে ভেলাটা আবার বের করে এনে পানির ওপর এসে পড়া কিছু ডালপাতার তলার শেকড়ে শক্ত করে বাঁধল।
লতা আর শেকড় ধরে ধরে পাড়ে উঠে রওনা হলো আস্তানায়। চোখ চঞ্চল দুই ডাকাতকে খুঁজছে। ছায়াও দেখা যাচ্ছে না ওদের। পোড়া বাড়িতে ভাড়ারে ঢুকে বসে নেই তো?
আগে রাফিয়ানকে ঢুকতে বলল ওরা।
সিঁড়িমুখে মাথা ঢুকিয়ে দিল রাফিয়ান। শব্দ করল না। সিঁড়ি টপকে নেমে গেল নিচে।
নেমেই গোঁ গোঁ করে উঠল।
কি ব্যাপার? বলল কিশোর। বসে আছে নাকি নিচে?
মনে হয় না, মাথা নাড়ল জিনা। অন্য কিছু। কী?
চলো না, নেমেই দেখি, সিঁড়িতে পা রাখল জিনা।
বিছানা যেভাবে করে রেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি রয়েছে। ব্যাজ আর কাপড় চোপড়ও রয়েছে জায়গামত। মোম জ্বেলে টর্চ নিভিয়ে দিল কিশোর।
কি হয়েছে, রাফি? জিজ্ঞেস করল জিনা। এমন করছিস কেন?
গোঙানি থামছে না রাফিয়ানের।
গন্ধ পেয়েছে নাকি? চারপাশে তাকিয়ে বলল মুসা। ওরা এসেছিল এখানে?
আসতেও পারে, রবিন বলল।
মরুকগে, হাত নাড়ল মুসা। খিদে পেয়েছে। কিছু খেলে কেমন হয়?
ভালই হয়, আমারও খিদে পেয়েছে, বলতে বলতে আলমারির দিকে এগোল কিশোর। কিন্তু টান দিয়ে দরজা খুলেই স্থির হয়ে গেল।
নেই!
অথচ ওখানেই রেখে গিয়েছিল সব খাবার। থালা-বাসন, প্লেট-কাপ, সব সাজানোই রয়েছে আগের মত, নেই শুধু খাবারগুলো। রুটি নেই, বিস্কুট নেই, চকলেট নেই…কিচ্ছু নেই।
কিশোরের ভাব দেখেই বুঝল অন্যেরা, কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। এগোল আলমারির দিকে।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। কিছুই তো নেই। একটা বিস্কুটও না। ইস আগেই ভাবা উচিত ছিল। আল্লাহরে, কি খেয়ে বাঁচি এখন!।
খুব চালাকি করেছে, রবিন বলল। জানে, খাবার ছাড়া থাকতে পারব না এখানে। আমাদের তাড়ানোর এটাই সবচেয়ে ভাল কৌশল। রাতে খিদেয় মরব, সকালে উঠেই দৌড়াতে হবে গায়ে, অনেক সময় পাবে ওরা।
মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে তালমারির কাছেই বসে পড়ল মুসা। গায়ে। যাওয়ারও সময় নেই এখন। যা পথ-ঘাট, অন্ধকার! উফ, খিদেও পেয়েছে। নাহ্ রাতটা টিকব না।
মন খারাপ হয়ে গেছে সবার। কতক্ষণ আর খিদে সওয়া যায়? ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর, ভেবেছিল খেয়েদেয়ে চাঙা হবে, তার আর উপায় নেই।
বিছানায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন। একবার ভেবে ছিলাম, কয়েকটা চকলেট সরিয়ে রেখে যাই, রাখলাম না…রাফি, ওভাবে আলমারির দিকে চেয়ে লাভ নেই। কিচ্ছু নেই ওতে।
আলমারি শুকছে, আর করুণ চোখে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে রাফিয়ান।
হারামীগুলো কোথায়? হঠাৎ রেগে গেল কিশোর। ব্যাটাদের একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। বুঝিয়ে দেয়া দরকার লোকের খাবার চুরি করার ফল।
হুফ, পুরোপুরি একমত হলো রাফিয়ান।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল কিশোর। দুই ডাতাক কোথায়? ভাঙা, শূন্য দরজার কাছে গিয়ে দূরে তাকাল।
বনের মাঝে এক জায়গায় দুটো তাবু খাটানো হয়েছে। তাহলে ওখানেই ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে, ভাবল সে। চোরগুলোকে গিয়ে গালাগাল করে আসবে নাকি? হ্যাঁ, তাই যাবে।
আয়, রাফি, বলে পা বাড়াল কিশোর।
কিন্তু তাঁবুতে কেউ নেই। কয়েকটা কম্বল, একটা প্রাইমাস স্টোভ, একটা কেটলি আর অন্যান্য কিছু দরকারী জিনিস অগোছাল হয়ে পড়ে আছে। একটা তাঁবুর কোণে গাদা করে রাখা আছে কি যেন, কাপড় দিয়ে ঢাকা।
টিকসি আর ডারটি গেল কোথায়?
খুঁজতে বেরোল কিশোর।
পাওয়া গেল হ্রদের ধারে গাছের তলায়, পায়চারি করছে। কথা বলছে। বাহ, সান্ধ্যভ্রমণ, মুখ বাঁকাল সে। দাঁড়িয়ে পড়ল। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে, ভাবছে কিছু। যে কাজে এসেছিল, সেটা না করে ফিরে চলল আস্তানায়।
পেছনে রাফিয়ান, বাতাসে কি যেন শুকতে শুকতে চলেছে।
তাঁবু খাঁটিয়েছে, বন্ধুদের জানাল কিশোর। ব্যাটারা রয়েছে লেকের পাড়ে। লুটের মাল না নিয়ে যাবে না।
আরে রাফি কোথায়? সিঁড়িমুখের দিকে চেয়ে আছে জিনা। কিশোর, কোথায় ফেলে এলে ওকে?
পেছনেই তো আসছিল: দেখি তো, সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল কিশোর। ওপরে মেঝেতে পরিচিত নখের শব্দ।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল রাফিয়ান।
আরে, দেখো, মুখে করে কি জানি নিয়ে এসেছে। বলে উঠল জিনা।
তার কোলের কাছে এনে জিনিসটা রাখল রাফিয়ান।
বিস্কুটের টিন! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। পেল কই?
নীরব হাসিতে ফেটে পড়ল কিশোর। বলল, আমি যা করব ভাবছিলাম, রাফিই। সেটা করে ফেলল। তাঁবুতে কাপড়ে ঢাকা রয়েছে খাবার, অনেক খাবার। ফিরে এসেছি, সবাই মিলে গিয়ে লুট করে আনার জন্যে। আর দরকার হবে না।
আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে রাফিয়ান।
ওরা যেমন করমচা, আমরা তেমনি বাঘা তেঁতুল, হাসতে হাসতে বলল মুসা। কারও চেয়ে কেউ কম নই।…রাফিটা আবার গেল?
যাক, বলল জিনা।
এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল রাফি। মুখে বাদামী কাগজে মোড়া মস্ত এক প্যাকেট।
বিশাল কেক।
হেসে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল গোয়েন্দারা।
রাফি, তুই একটা বাঘের বাচ্চা, হাসি থামাতে পারছে না মুসা।
আরে না, সিংহের, শুধরে দিল জিনা।
আমার তো মনে হয় ওর বাপ বাবুর্চি ছিল, পেট চেপে ধরেছে রবিন, চোখের কোণে পানি। বেছে বেছে পছন্দসই খাবারগুলো আনছে।
আবার চলে গেছে রাফিয়ান। ফিরে এল শক্ত মলাটের একটা বাক্স নিয়ে। গরুর মাংসের বড়া।
তাজ্জব করে দিল দেখি। বলল মুসা। কোথায় পেটে পাথর বাঁধার কথা ভাবছিলাম, আর হাজির হয়ে গেল একেবারে রাজকীয় ভোগ…
দারুণ হয়েছে, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমাদেরগুলো ব্যাটারা নিয়েছে, আমরা ওদেরগুলো নিয়ে এসেছি। রাফি, আবার যা।
কিশোরের বলার আগেই রওনা দিয়েছে রাফিয়ান।
কি আনে, দেখার জন্যে উৎসুক হয়ে রইল চারজন।
নিয়ে এল আরেক বাক্স মাংসের কাবাব।
তুই একটা সাংঘাতিক লোক, রাফি! উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল মুসা, খুব ভাল মানুষ। এত সুগন্ধ, তা-ও ছুঁয়েও দেখছিস না। আমি হলে তো চাখার লোভ সামলাতে পারতাম না।
খাবার চুরি করার নেশায় পেয়েছে রাফিয়ানকে। যাচ্ছে-আসছে, যাচ্ছেআসছে, প্রতিবারেই মুখে করে নিয়ে আসছে একটা কিছু।
এবার ওকে থামানো দরকার, বলল কিশোর। যথেষ্ট হয়েছে। যা নিয়েছিল ব্যাটারা, তার তিনগুণ এসেছে।
থাক, শুধু আরেকবার, হাত তুলল জিনা। দেখি, এবার কি আনে।
টেনে-হিঁচড়ে ইয়া বড় এক বস্তা নিয়ে হাজির হলো রাফিয়ান।
আবার হাসাহাসি শুরু হলো। না ঠেকালে সব নিয়ে আসবে। কিছু রাখবে না, শূন্য করে দিয়ে আসবে।
রাফি, বেল্ট টেনে ধরল জিনা, আর না। শুয়ে পড়, জিরিয়ে নে। বাঁচালি আমাদের।
প্রশংসায় খুব খুশি হলো রাফিয়ান। জিনার গালটা একবার চেটে দিয়ে গড়িয়ে পড়ল তার পায়ের কাছে। জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে।
বস্তাটা খুলল মুসা। ঘরে বানানো পাউরুটি আর বনরুটি। হুররে… আনন্দে নাচতে শুরু করল সে। রাফি, তো পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে ইচ্ছে করছে।
কি বুঝল কুকুরটা কে জানে, একটা পা বাড়িয়ে দিল।
নাও, করো এবার, হা-হা করে হেসে উঠল কিশোর। সবাই যোগ দিল হাসিতে।
পেট পুরে খেলো ওরা। রাফিয়ানের পেট ফুলে ঢোল, নড়তে পারছে না ঠিকমত। হাস্যকর ভঙ্গিতে পেটটাকে দোলাতে দোলাতে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে, পানি খাওয়ার জন্যে। কল ছেড়ে দিল জিনা। সামনের দুই পা সিংকে তুলে দিয়ে পানি খেলো রাফিয়ান।
সিংক থেকে থাবা নামিয়েই স্থির হয়ে গেল সে। ঘুরে বনের দিকে চেয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
ছুটে এল সবাই। ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে ডারটির মাথা দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে।
কাছে এসে চেঁচিয়ে উঠল সে, আমাদের খাবার চুরি করেছ?
কে বলল? চেঁচিয়ে জবাব দিল কিশোর, আমাদের খাবারই আমরা ফিরিয়ে এনেছি।
এত্তবড় সাহস, আমার তাঁবুতে হানা… রাগে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ডারটির। ঝাঁকড়া চুল নাড়ল, সঁঝের আবছা আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে তার চেহারা, চুলের জন্যে।
না আমরা যাইনি, সহজ কণ্ঠে বলল কিশোর, রাফি গিয়েছিল। আমরা বরং ঠেকিয়েছি, নইলে রাতে তোমাদের খাওয়া জুটত না। আমাদের তো উপোস। রাখতে চেয়েছিলে, আমরা তোমাদের মত অত ছোটলোক নই…না, না, আর কাছে এসো না, রাফি রেগে যাবে। আর হ্যাঁ, সারা রাত পাহারায় থাকবে ও। গায়ে ওর সিংহের জোর, মনে রেখো।
গরররর, এত জোরে গর্জন করল রাফিয়ান, লাফিয়ে উঠল ডারটি। তার মনে হলো সিংহেরই গর্জন।
ভীষণ রাগে হাত নেড়ে ঝটকা দিয়ে ঘুরল সে। চলে গেল।
সিঁড়িমুখে রাফিয়ানকে মোতায়েন করে ভাঁড়ারে ফিরল চারজন।
ব্যাটাদের বিশ্বাস নেই, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর।
নিশ্চয় পিস্তল-টিস্তল কিছু আনেনি, নইলে এতক্ষণে গুলি করে মারত রাফিকে।
তাড়াতাড়ি করা দরকার আমাদের, বলল রবিন। মালগুলো খুঁজে বের করে নিয়ে পালানো দরকার। ঠিকই বলেছ, ব্যাটাদের বিশ্বাস নেই। কখন যে কি করে…আচ্ছা, নকশা নিয়ে বসলে কেমন হয়? টল স্টোন তো দেখেছি।
নকশা বের করে সমাধান করতে বসল ওরা।
এই যে, একটা রেখার মাথায় আঙুল রাখল কিশোর। তাহলে, এটার উল্টো দিকে টক হিল, এই যে, আরেক মাথায় আঙুল রাখল।
তুমি ভাবতে থাকো, চিত হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা। আমি একটু গড়িয়ে নিই। গতর খাটানোর দরকার পড়লে ডেকো।
মোমের আলোয় গভীর মনোযোগে নকশাটা দেখছে কিশোর। ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। বিড়বিড় করল, চারটে…টল স্টোন…টক হিল-চিমনি… স্টীপল। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ইউরেকা! ইউরেকা!
লাফিয়ে উঠে বসল মুসা। আমেরিকা আবিষ্কার করলে নাকি?
না, লুটের মাল।
কোথায়? ঘরের চারদিকে তাকাল গোয়েন্দা-সহকারী। চোখে বিস্ময়।
আরে ওখানে না, এখানে, নকশাটায় হাত রাখল গোয়েন্দাপ্রধান। বুঝে গেছি।
এক এক করে ধরা যাক, উত্তেজনায় মৃদু কাঁপছে কিশোরের গলা। টু-ট্রীজ। এই যে, এখানে। ব্ল্যাক ওয়াটার। যেখানে লুটের মাল লুকানো রয়েছে। ওয়াটার মেয়ার। যার মধ্যে লুকানো রয়েছে। হ্রদের পানিতে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে নৌকাটা।
বলে যাও, জিনা আর রবিনকে ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে বসল মুসা।
টিকসি হয়তো জেরির পুরানো বান্ধবী, বলল কিশোর, তাহলে জেরির কাজকর্মের সঙ্গে পরিচয় আছে তার। নকশার মানে বুঝে ফেলেছে। বুঝেছে, কোথায় লুকানো রয়েছে নৌকাটা।
কাগজের এক জায়গায় তর্জনী দিয়ে খোঁচা মারল সে। এখন দেখি, আমরা কি বুঝেছি। টল স্টোন তো দেখেছি আমরা, নাকি? বেশ। লেকের এমন কোন জায়গা আছে, যেখান থেকে শুধু টল স্টোন নয়, টক হিল, চিমনি, স্টীপলও দেখা যাবে। চারটে জিনিসই এক জায়গা থেকে দেখা যাবে। এবং ওই জায়গায়ই লুকানো রয়েছে লুটের মাল।
অন্য তিনজন নীরব।
আমি একটা গাধা, সরল মনে স্বীকার করল মুসা। এই সহজ ব্যাপারটা বুঝলাম না। লুটের মাল রয়েছে, তারমানে ওয়াটার মেয়ারকেও ওখানেই পাওয়া যাবে। গিয়ে খালি তুলে নেয়া।
হ্যাঁ, বলল কিশোর। তবে ডারটি আর টিকসির কথা ভুলো না। আমাদের আগে ওরাও গিয়ে হাজির হতে পারে, তুলে নিতে পারে জিনিসগুলো। কেড়ে নিতে পারব না, আমরা পুলিশ নই। নিয়ে সোজা চলে যাবে, রুখতেও পারব না।
সবাই উত্তেজিত।
তাহলে তো কাল ভোরেই যাওয়া উচিত, বলল রবিন। আলো ফুটলেই বেরিয়ে পড়ব। ডারটি আর টিকসির আগেই গিয়ে তুলে নেব। ইস, একটা অ্যালার্মব্লক থাকলে ভাল হত।
ভেলায় করে চলে যাব, মুসা বলল। বাকি তিনটে চিহ্ন খুঁজে বের করে…
তিনটে নয়, দুটো, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। চিমনিটা টু-ট্রীজেই রয়েছে। খেয়াল করোনি, এ-বাড়িটার বায়ে উঁচু একটা চিমনি?
আমি করেছি, রবিন বলল।
আরও কিছুক্ষণ পরামর্শ আর আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো, ভোরে উঠেই বেরোবে। রাত বেশি না করে শুয়ে পড়ল ওরা, নইলে সকাল সকাল উঠতে পারবে না।
সিঁড়িমুখের কাছে শুয়ে আছে রাফিয়ান, চোখ বন্ধ, কান সজাগ।
সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছে, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল ছেলেরা।
কেউ বিরক্ত করল না সে-রাতে। খাবারের গন্ধে লোভ সামলাতে না পেরে চুপি চুপি এসে উঁকি দিল একবার সেই শেয়ালটা। নড়লও না. রাফিয়ান, চোখও মেলল না, চাপা গলায় গরগর করল শুধু একবার। তাতেই যা বোঝার বুঝে নিয়ে ফোলা লেজ আরও ফুলিয়ে পালাল শেয়াল মহাশয়। কর্কশ চিল্কার করে উঠল একটা হুতুম পেঁচা। ওটার সঙ্গে গলা মিলিয়ে কা-কা করল একটা দাড়কাক, ঘুমিয়ে পড়ল আবার।
হামাগুড়ি দিয়ে এল যেন আবছা আলো, বনের কালো অন্ধকারকে কঠিন হাতে তাড়ানোর সাহস নেই বুঝি। উঠে গা ঝাড়া দিয়ে ভাঙা দরজার কাছে এগোল রাফিয়ান। তঁাবু দুটো দেখল। চোখে পড়ল না কাউকে। ফিরে এসে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে এল ভাড়ারে।
সঙ্গে সঙ্গে জেগে গেল মুসা আর কিশোর।
কটা বাজে? ঘড়ি দেখেই চমকে উঠে বসল কিশোর। সাড়ে সাতটা।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। এই ওঠো ওঠো। দুপুর হয়ে গেছে।
দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে, দাঁত মেজে, চুল আঁচড়ে নিল ওরা। পরনের কাপড় ঝেড়ে নিল হাত দিয়ে। তাড়াতাড়ি খাবার বেড়ে দিল রবিন আর জিনা। নাকেমুখে কোনমতে খাবারগুলো খুঁজে দিয়ে সিংকের কল থেকে পানি খেলো।
বেরোনোর জন্যে তৈরি।
তাবুর কাছে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
গুড, বলল কিশোর। ঘুম থেকে ওঠেনি। আমরাই আগে যাচ্ছি।
ভেলায় চড়ে বসল অভিযাত্রীরা। দাঁড় তুলে নিল হাতে। সবাই উত্তেজিত, রাফিয়ানও।
আগে টল স্টোনটা বের করি, ঝপাত করে পানিঙে দাঁড় ফেলল কিশোর।
হ্রদের মাঝখানে চলে এল ওরা। টল স্টোন চোখে পড়ছে না। চেয়ে চেয়ে চোখ ব্যথা করে ফেলল। গেল কোথায় উঁচু পাথরটা?
সবার আগে দেখল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, ওই যে, ওইই, উঁচু গাছগুলোর পরে…
টল স্টোন তো পাওয়া গেল, বলল কিশোর। এই, তোমরা উল্টোদিকে চাও তো, টক হিল দেখা যায় কিনা? কোন পাহাড়-টাহাড়? আমি টল স্টোনের ওপর চোখ রাখলাম। দরকার হলে ভেলটা সামনে পেছনে কোরো।
টক হিলও মুসাই আগে দেখল। পেয়েছি। বলল সে। ওটাই। দেখো দেখো, অদ্ভুত একটা পাহাড়, পিরামিডের মত চূড়া: কিশোর, টল স্টোন এখনও দেখা যাচ্ছ?
হ্যাঁ, বলল কিশোর। তুমি পাহাড়টা থেকে চোখ সরিও না। জিনা, দেখো তো স্টীপল দেখা যায় কিনা? টল স্টোনের ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যে চোখ সরাচ্ছে না সে। দেখো, পুরানো বাড়ি, গির্জা, মন্দিরের চূড়া বা স্তম্ভ…
দেখেছি, দেখেছি! এত জোরে চেঁচিয়ে উঠল জিনা, যার যার চিহ্ন থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল মুসা আর কিশোর। রবিন আগেই সরিয়েছে।
সকালের রোদে ঝলমল করছে গির্জার পাথরে তৈরি চুড়া।
চমৎকার, বলল কিশোর। রবিন, দেখো তো, চিমনিটা দেখা যায়?
না, রবিন বলল। মুসা আরেকটু বাঁয়ে সরাও…আরেকটু…হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখছি। আর না, আর না…।
দাঁড় বাওয়া বন্ধ। কিন্তু এক জায়গায় স্থির থাকল না ভেলা, আপনগতিতে অল্প অল্প করে সরে গেল। পানিতে বার দুই দাঁড়ের খোঁচা মেরে আবার সরাতে হলো ভেলাটা। ইতিমধ্যে গির্জা হারিয়ে ফেলেছে জিনা।
একটু ওদিক, একটু ওদিক করে করে আবার জায়গামত আনা হলো ভেলা, আবার চারটে চিহ্ন চোখে পড়ল।
কিছু একটা মারকার ফেলে জায়গাটার চিহ্ন রাখা দরকার, টল স্টোন থেকে চোখ সরাল না কিশোর। জিনা, দেখো তো, চূড়া আর পাথরের ওপর একসঙ্গে চোখ রাখতে পারো নাকি?
দেখি চেষ্টা করে, চুড়া থেকে চোখ সরিয়ে চট করে পাথরটার দিকে তাকাল জিনা, তারপর আবার চুড়ার দিকে। কাজটা সহজ নয়। ভেলা খালি নড়ছে, স্থির রাখা যাচ্ছে না পুরোপুরি, যাবে বলেও মনে হয় না।
দ্রুত হাত চালাল কিশোর। একটা টর্চ আর পকেট-ছুরি বের করল। জিনা, তোমার ব্যাগে ফিতা আছে?
দেখো, আছে কয়েকটা, দুটো চিহ্নের ওপর চোখ রাখতে হিমশিম খাচ্ছে জিনা।
একটার সঙ্গে আরেকটা ফিতের মাথা বেঁধে জোড়া দিয়ে লম্বা করল কিশোর। ছুরি আর টর্চ এক করে ফিতের একমাথা দিয়ে পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধল। তারপর ফিতে ধরে ছেড়ে দিল পানিতে, আস্তে আস্তে ছাড়তে লাগল। টান থেমে গেল এক সময়, বোঝা গেল হ্রদের তলায় পৌঁছেছে ভার।
এক হাতে ফিতে ধরে রেখে আরেক হাতে পকেট খুঁজল কিশোর। এক অলস মুহূর্তে একটা কর্ককে ছুরি দিয়ে কেটে চেচে একটা ঘোড়ার মাথা বানিয়েছিল, সঙ্গে নিয়ে এসেছে ওটা। বের করল পকেট থেকে। ফিতেটাকে টান টান করে এমন এক জায়গায় কর্ক বঁধল, যেন ওটা পানির সমতলের ঠিক নিচে ভাসে।
ভেসে রইল কর্কটা, দাঁড়ের নড়াচড়ায় আলতো ঢেউ উঠছে, তাতে লুকোচুরি খেলতে থাকল ঘোড়ার মাথা।
হয়েছে, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। চিহ্ন থেকে চোখ সরাতে পারো।
ঘোড়ার মাথাটার দিকে তাকাল মুসা। এত আগাম চিন্তা করো কিভাবে? বন্ধুর বুদ্ধির তারিফ করল সে। কিন্তু জিনিসটা বেশি ছোট। আবার খুঁজে বের করতে পারব? বড় কিছু হলে ভাল হত না?
সেটাই ভাবছি, বলল কিশোর। কিন্তু বড় আর কি আছে?
আমার মেকআপ বক্সটা ধার নিতে পারো, জিনা বলল। দাও, হাত বাড়াল কিশোর।
ব্যাগ খুলে বেশ বড় একটা প্লাসটিকের বাক্স বের করল জিনা। খুব শক্ত হয়ে লাগে ডালা, ভেতরে পানি তো ঢুকবেই না, বাতাসও ঢোকে না তেমন, বায়ুনিরোধকই বলা চলে। ভেসে থাকবে। এক এক করে লিপস্টিক, পাউডারের কৌটা, চিরুনি আর টুকিটাকি অন্যান্য জিনিস ব্যাগে রেখে বাক্সটা দিল সে।
মেয়েদের অকাজের বাক্সও অনেক সময় কাজে লাগে, ফস করে বলে ফেলল মুসা।
টান দিয়ে বাক্সটা সরিয়ে আনল জিনা। দেখো, ভাল হবে না। আমাকে রাগালে বাক্স দেব না আমি।
না না, দাও, এমনি ঠাট্টা করলাম, তাড়াতাড়ি বলল মুসা।
কর্কের পরে বাড়তি যে ফিতেটুকু রয়েছে, সেটা দিয়ে বাক্স বেঁধে পানিতে ছাড়ল কিশোর। ভেসে রইল। বোঝা যাচ্ছে, থাকবে।
ফাইন, বলল কিশোর। এবার দূর থেকেও চোখে পড়বে। দেখি তো, তলায় কি আছে?
ভেলার ধার দিয়ে ঝুঁকে চারজনেই নিচে তাকাল। কিছুই না বুঝে রাফিয়ানও গলা বাড়িয়ে দিল পানির দিকে।
অদ্ভুত এক দৃশ্য। হ্রদের তলায় বড় কালো একটা ছায়া। ছোট ছোট ঢেউয়ের জন্যে অস্পষ্ট লাগছে, কেমন কাপা কাপা, তবে নৌকা যে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ওয়াটার মেয়ার, বিড়বিড় করল মুসা।
জেরি ব্যাটা খুব চালাক, কিশোর বলল। লুটের মাল লুকানোর কি একখান জায়গা খুঁজে বের করেছে। নৌকার তলা ফুটো করে ডুবিয়েছে নিশ্চয়।
কিন্তু নৌকাটা তুলব কি করে?
তাই তো ভাবছি, থেমে গেল কিশোর। ঘেউ ঘেউ শুরু করেছে রাফিয়ান।
একটা নৌকা ছুটে আসছে এদিকে, লিটল মারমেইড। টিকসি আর ডারটি দুজনেই দাঁড় বাইছে। ভেলার দিকে খেয়াল নেই, হ্রদের চারপাশের তীরের দিকে চোখ, একবার এদিক চাইছে, একবার ওদিক। বোঝা গেল, চিহ্নগুলো খুঁজছে ওরা।
তৈরি হয়ে যাও, সবাই, আস্তে বলল কিশোর। আজ আমাদের বাধা না-ও মানতে পারে।