২. খুঁজে পেল গোলাঘরটা

0 Comments

সঙ্গে খাবার যা আছে খেয়ে নিল রবিন। ঢকঢক করে আধ জগ পানি খেয়ে মাদুরের ওপর কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। জিনা আর কিশোরের সাড়ার আশায় কান খাড়া। কিন্তু বেশিক্ষণ চোখ খোলা রাখতে পারল না। সারা দিন অনেক পরিশ্রম গেছে। ঘুমিয়ে পড়ল সে।

বাইরে বেশি হাঁটাহাঁটি করার সাহস হলো না মুসার। বৃদ্ধার ছেলের সামনে যদি পড়ে যায়? সহজেই খুঁজে পেল গোলাঘরটা। টর্চের আলো সাবধানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল।

ঘরের এক কোণে খড়ের গাদা। শোয়ার জায়গা পাওয়া গেল। ভাঙা একটা বাক্স দেখে সেটা তুলে এনে দরজার পাশে রেখে বসল। ভাঙা গেটটা দেখা যায়। কিশোর আর জিনা আসবে তো এই বৃষ্টির মাঝে? এলে কি ওই গেট দিয়েই ঢুকবে?

পেটের ভেতর ছুঁচো নাচছে। খাবার বের করে খেতে শুরু করল মুসা, একই সঙ্গে চোখ রাখল গেটের দিকে। বৃদ্ধার ছেলে এলে দেখতে পাবে।

ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ। ঘন ঘন হাই তুলছে। তবু জোর করে চোখ খোলা রেখে বসে রইল।

কেউ এল না। দরজা দিয়ে মুখ বাড়ালেই চোখে পড়ে বাড়ির জানালা। বৃদ্ধাকে দেখা যায়, সেলাই করছে।

দু-ঘণ্টা পেরোল। আটটা বাজে। জিনা আর কিশোরের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে মুসা।

ঝুড়িতে সেলাইয়ের সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখল বৃদ্ধা। মুসার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, ফিরে এল না। হারিকেনটা আগের জায়গায়ই জ্বলছে, ছেলের জন্যেই জ্বেলে রেখে গেছে বোধহয় বৃদ্ধা, মুসা ভাবল।

বৃষ্টি থেমেছে। আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। তারা ফুটেছে। ছুটে চলা মেঘের ফাঁকে উকিঝুঁকি দিচ্ছে চাঁদ। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসবে।

প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভয় অনেকখানি কেটে গেল মুসার। গোলাঘর থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে এগোল জানালার দিকে। মনে কৌতূহল। কি করছে বৃদ্ধা?

কোণের নড়বড়ে সোফাটায় শুয়ে পড়েছে মহিলা। গলা পর্যন্ত তুলে দিয়েছে কল। বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে।

আগের জায়গায় ফিরে এল মুসা। জিনা আর কিশোরের জন্যে বসে থেকে আর লাভ আছে? ভাবল সে। রাতে ওরা ফিরবে বলে মনে হয় না। রাফিয়ানকে ডাক্তার দেখিয়ে র‍্যাংকিন ভিলেজে ফিরে সরাইখানায় রাত কাটানোটাই স্বাভাবিক।

বৃষ্টি না হলে অবশ্য অন্য কথা ছিল।

বড় করে হাই তুলল সে। যাই, শুয়ে পড়িগে, মনে মনে বলল। যদি আসেই ওরা, সাড়া পাব।

দরজা বন্ধ করল মুসা। খিল-টিল কিছু নেই। দুটো করে আঙটা লাগানো আছে ভেতরে-বাইরে। ভেতরের আঙটা দুটোয় দুটো লাঠি ঢুকিয়ে আটকে দিল সে। খিলের বিকল্প। কেন এই সাবধানতা, নিজেই জানে না। হয়তো অবচেতন মনে রেখাপাত করেছে বৃদ্ধার ছেলের বদমেজাজের কথাটা।

খড়ের গাদায় শুতে না শুতেই ঘুমে অচেতন হয়ে গেল মুসা।

বাইরে আরও পরিষ্কার হয়েছে আকাশ। বেরিয়ে এসেছে সঁদ, পূর্ণতা পায়নি এখনও, তবে যথেষ্ট বড় হয়েছে। পাথরের পুরানো বাড়িটাকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে ঘোলাটে জ্যোৎস্না।

ঘুমাচ্ছে মুসা। স্বপ্নে দেখছে রাফিয়ানকে, জিনা, কিশোর আর ভাঙা বাড়িটাকে, কানে আসছে যেন ঘণ্টাধ্বনি।

হঠাৎ ভেঙে গেল ঘুম। প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় রয়েছে। আরি, খোঁচা লাগছে কেন? বিছানায় কাটা ছড়িয়ে দিল নাকি কেউ? তারপর মনে পড়ল, খোঁচা তো লাগবেই। শুয়ে আছে খড়ের গাদায়। কাত হয়ে শুলো, কুঁজো হয়ে।

একটা মৃদু শব্দ কানে এল। গোলাঘরের কাঠের বেড়ায় আঁচড়ের মত। উঠে বল মুসা। ইদুর?

কান পেতে আছে সে। শব্দ ঘরের ভেতর নয়, বাইরে থেকে আসছে। থেমে, একটা নির্দিষ্ট সময় বিরতি দিয়ে আবার শুরু হলো। তারপর, মুসার ঠিক মাথার ওপরে ভাঙা একটা জানালায় আলতো টোকা দিল কেউ।

চুপ করে আছে মুসা। ইঁদুরে আঁচড়াতে পারে, কিন্তু টোকা দিতে পারে না। তাহলে কে? দম বন্ধ করে পড়ে রইল সে।

রবিন! রবিন? ফিসফিসিয়ে ডাকল কেউ।

সাড়া দিতে গিয়েও দিল না মুসা। গলাটা অচেনা, কিশোরের মত লাগছে না। কিন্তু রবিনের নাম জানল কি ভাবে? কেউ যে শুয়ে আছে ঘরে, এটাই বা কি করে জানল?

আবার টোকার শব্দ হলো। গলা আরেকটু চড়িয়ে ডাকল লোকটা, রবিন। রবিন?

না, কিশোর নয়। জিনা তো নয়ই।

ওঠো, বলল নোকটা। অনেক দূর যেতে হবে আমাকে। ওই মেসেজটা নিয়ে এসেছি।

জানালার কাছে যাওয়া উচিত হবে না, ভাবল মুসা। কিন্তু এ-ও চায় না, কোন সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ুক লোকটা। জানালার চৌকাঠের কাছে মাথা তুলল সে, কিন্তু মুখ বের করল না। মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে কণ্ঠস্বর বিকৃত করে ফিসফিস করে জবাব দিল, আছি, বলো।

এত ঘুম? বিরক্ত হয়ে বলল লোকটা। কখন থেকে ডাকছি। শোনো, জেরি মেসেজ দিয়েছে। টু-ট্রীজ। ব্ল্যাক ওয়াটার। ওয়াটার মেয়ার। আরও বলেছে, টিকসি নোজ। তোমাকে এটা দিতে বলেছে, টিকসির কাছে আছে আরেকটা। নাও, জানালা দিয়ে এক টুকরো কাগজ ছেড়ে দিল সে ভেতরে।

বেড়ার ছোট একটা ছিদ্র দিয়ে দেখছে মুসা। বিষণ্ণ মুখ, কুতকুতে চোখ, মাথাটা দেখতে অনেকটা বুলেটের মত।

রবিন? আবার বলল লোকটা। সব মনে রাখতে পারবে তো? টু ব্রীজ। ব্ল্যাক ওয়াটার। ওয়াটার মেয়ার। টিকসি নোজ।…যাই তাহলে।

চলে গেল লোকটা।

কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে ভাবছে মুসা। কে লোকটা? রবিনের নাম জানল কিভাবে? আর তাকেই বা রবিন মনে করার কারণ কি? রবিনের নাম যখন জানে, তার নাম কি জানে না? রাত দুপুরে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কি এক

অদ্ভুত মেসেজ দিয়ে গেল, মাথামুণ্ড কিছুই বোঝা যায় না।

ঘুম আর আসবে না সহজে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মুসা। কিচ্ছু নেই, শুধু রহস্যময় বাড়িটার নির্জনতা, আর খোলা আকাশ।

খড়ের গাদায় বসে পড়ল সে। টর্চ জ্বেলে দেখল কাগজের টুকরোটা। ময়লা, এক পাতার ছেড়া অর্ধেক। পেনসিলে কিছু আঁকিবুকি রয়েছে, যার কোনই মানে বোঝা যায় না। কিছু শব্দ রয়েছে এখানে ওখানে, যেগুলো আরও দুর্বোধ্য।

আমার মাথায় কুলোবে না, আনমনে বলতে বলতে কাগজটা পকেটে রেখে দিল সে। শুয়ে পড়ল আবার।

জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা আসছে। কুকুর-কুণ্ডলী হয়ে গেল মুসা, গায়ের ওপর কিছু খড় টেনে দিল। ঠাণ্ডা কম লাগবে।

শুয়ে শুয়ে ভাবছে। তন্দ্রা লাগল একসময়।

কিন্তু পুরোপুরি ঘুম আসার আগেই টুটে গেল আবার। বাইরে সতর্ক পায়ের শব্দ। ফিরে এল লোকটা?

দরজার বাইরে এসে থামল পদশব্দ। ঠেলা দিল পাল্লায়। খুলল না দেখে জোরে ধাক্কা দিল। সে বোধহয়, ভাবছে, কোন কিছুর সঙ্গে আটকে গেছে পাল্লা। ঠেলাঠেলিতে আঙটা থেকে খসে পড়ল লাঠি, ভেতরে ঢুকল নোকটা। আবার

ভেজিয়ে দিল দরজা।

দরজার কাছে পলকের জন্যে লোকটার চেহারা দেখেছে মুসা। না, বুলেটমাথা নয়। এর মাথায় ঘন কালো ঝাঁকড়া চুল। ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভেতর। খড়ের গাদায় শুতে আসবে না তো লোকটা?

না, এল না। একটা চটের বস্তার ওপর বসে নিজে নিজেই কথা শুরু করল। হলো কি? আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে? বিড়বিড় করে আরও কিছু বলল, বুঝতে পারল না মুসা।

দূর কি হলো? বলে উঠল লোকটা। মাথার ওপর দু-হাত তুলে গা মোড়ামুড়ি করল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল আবার দরজার কাছে। বাইরে উঁকি দিয়ে কি দেখল, ফিরে এসে বসল আবার আগের জায়গায়।

বিড়বিড় করছে না আর, একেবারে চুপ। হাই তুলছে।

সত্যিই দেখছে তো, অবাক হয়ে ভাবল মুসা, নাকি স্বপ্ন?

চুপ করে পড়ে রইল সে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করল এক সময়, একটা বনের ভেতর দিয়ে চলেছে। যেদিকেই তাকায়, শুধু জোড়ায় জোড়ায় গাছ। বিচিত্র ঘণ্টার শব্দ কানে বাজছে একটানা।

দ্বিতীয়বার ঘুম ভাঙল মুসার। সকাল হয়ে গেছে। প্রথমেই চোখ গেল বস্তাটার দিকে। কেউ নেই। গোলাঘরে খড়ের গাদার ভেতরে শরীর ডুবিয়ে রয়েছে সে একা।

উঠে আড়মোড়া ভাঙল মুসা। সারা গায়ে ধুলো-মাটি, নোংরা। খিদেও পেয়েছে। আচ্ছা, পয়সা পেলে রুটি, পনির আর এক গেলাস দুধ দেবে তো বৃদ্ধা? রবিনেরও নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। কি অবস্থায় আছে কে জানে।

সাবধানে বাইরে বেরোল মুসা। চিলেকোঠার জানালার নিচে এসে দাঁড়াল। রবিনের উদ্বিগ্ন মুখ দেখা যাচ্ছে।

কেমন? হাত নেড়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা।

ভাল, হাসল রবিন। কিন্তু নিচে তো নামতে পারছি না। মহিলার ছেলে সাংঘাতিক বদমেজাজী। কয়বার যে গালাগাল করেছে বেচারী বুড়িটাকে। কানে শোনে না, এটা যেন তার দোষ।

তাহলে ও বেরিয়ে যাক, চট করে ফিরে তাকাল মুসা, কে জানি আসছে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে ঢুকল আবার গোলাঘরে।

বেড়ার ছিদ্র দিয়ে দেখল, বেঁটে এক লোক, চওড়া কাঁধ, সোজা হয়ে দাঁড়ালে সামান্য কুঁজো মনে হয়, মাথায় এলোমেলো চুলের বোঝ। গতরাতে দ্বিতীয় বার একেই ঢুকতে দেখেছে মুসা।

আরে, এদিকেই তো আসছে। কিন্তু না, গোলাঘরে ঢুকল না লোকটা। পাশ দিয়ে চলে গেল। গেট ভোলা আর বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে এল মুসার।

চলে গেছে, ভাবল মুসা। যাই এবার।

আবার বেরোল গোলাঘর থেকে।

দিনের আলোয় বড় বেশি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ছোট্ট সাদা বাড়িটাকে। নিঃসঙ্গ, নির্জন।

ঘরে ঢুকল মুসা। রান্নাঘরে পাওয়া গেল বৃদ্ধাকে। সিংকে বাসন-পেয়ালা ধুচ্ছে। মুসাকে দেখে অস্বস্তি ফুটল চোখে। ও, তুমি। ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাদের কথা।-জলদি তোমার বন্ধুকে নিয়ে চলে যাও। আমার ছেলে দেখলে

কিছু রুটি আর পনির দিতে পারবেন? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা। বুঝল, লাভ হবে না। গলা ফাটিয়ে চেঁচালেও শুনতে পাবে না মহিলা, একেবারেই কালা। হাত তুলে টেবিলে রাখা রুটি দেখাল সে।

না না! আঁতকে উঠল বৃদ্ধা। জলদি চলে যাও। আমার ছেলে এসে পড়বে।

ঠিক এই সময় পায়ের শব্দ হলো। মুসা কিছু করার আগেই ঘরে ঢুকল লোকটা, যাকে খানিক আগে বেরিয়ে যেতে দেখেছে।

হাতের ছোট ঝুড়িতে কয়েকটা ডিম।

চোখ গরম করে তাকাল লোকটা। এই ছেলে, এখানে কি? কি চাই?

না, কিছু না…মানে, এই…আমাদের কাছে কিছু রুটি বেচবে কি না…

আমাদের? তুমি একা নও?

নিজেকে জুতোপটা করতে ইচ্ছে হলো মুসার, মুখ ফসকে আমাদের বলে ফেলেছে। কিন্তু ফেলেছে তো ফেলেছেই, কথা ফিরিয়ে নেয়া আর যাবে না। চুপ করে রইল।

কি হলো? রা নেই কেন? গর্জে উঠল লোকটা। এতক্ষণে বুঝলাম, ডিম যায় কোথায়? তোমরাই চুরি করো রোজদাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা…

আর কি দাঁড়ায় মুসা? ঝেড়ে দিল দৌড়। গেট পেরিয়ে ছুটল। দুপদুপ করছে বুক, পেছনে তাকানোর সাহস নেই। ঘর থেকেই বোধহয় বেরোয়নি।

পায়ে পায়ে আবার গেটের কাছে ফিরে এল মুসা। উঁকি দিয়ে দেখল, একটা বড় কাঠের পাত্র হাতে নিয়ে উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে লোকটা, সাদা বাড়ির পেছনে। বোধহয় মুরগীর খাবার দিতে যাচ্ছে।

এই-ই সুযোগ। ঢুকে পড়ল মুসা। চিলেকোঠার জানালায় দেখা যাচ্ছে রবিনের মুখ। ইশারায় নেমে আসতে বলল তাকে মুসা।

রবিন নেমে আসতেই আর দাঁড়াল না। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল দুজনে। তাড়াতাড়ি পা চালাল।

আশপাশের অঞ্চল রাতে লেগেছিল এক রকম, এখন লাগছে আরেক রকম।

অনেকখানি আসার পর প্রথম কথা বলল রবিন, আরিব্বাপরে! সাংঘাতিক হারামী লোক। আর ওটা একটা ফার্ম হলো নাকি? গরু-শুয়োর কিছু নেই। একটা কুত্তাও না।

মনে হয় না ওটা ফার্ম, বেড়ার ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল মুসা, ফিরে তাকাল একবার বাড়ির ভাঙা গেটের দিকে। শিওর, পথ হারিয়েছিলাম কাল রাতে। ভুল জায়গায় উঠেছি। ইয়েলো পণ্ড ফার্ম হতেই পারে না।

কাজটা খারাপ হয়ে গেল তাহলে, জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল রবিন। কিশোর আর জিনা নিশ্চয় ফার্মে উঠেছে। আমাদের জন্যে খুব ভাববে।

হ্যাঁ, ছোট একটা পুকুর দেখে ঘুরল মুসা। চলো, হাত-মুখ ধুয়ে নিই। চেহারার যা অবস্থা হয়েছে একেকজনের। লোকে দেখলে পাগল ভাববে।

হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিল দুজনে। ময়লা কাপড় ভরে রাখল ব্যাগে, পরে সময়-সুযোগমত ধুয়ে নেবে।

পাড়ের ওপর উঠতেই একটা ছেলেকে দেখতে পেল, শিস দিতে দিতে আসছে। হাল্লো, বলল হাসিখুশি ছেলেটা। ছুটি কাটাতে বেরিয়েছ বুঝি?

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল মুসা। আচ্ছা ভাই, ইয়েলো পণ্ড ফার্মটা কোথায়? ওই ওটা? বৃদ্ধার বাড়িটা দেখাল।

আরে দূর, ওটা ফার্ম নাকি? ও-তো মিসেস হ্যাগার্ডের বাড়ি। নোংরা। নাক কুঁচকাল ছেলেটা। ওটার ধারে-কাছে যেয়ো না। বুড়ির ছেলে একটা ইবলিস, গাঁয়ের লোকে ওর নাম রেখেছে ডারটি রবিন।…ইয়েলো পণ্ড ওই ওদিকে। ব্যাংকিন রেস্ট ছাড়িয়ে গিয়ে, বায়ে। .

থ্যাংকু, বলল মুসা।

মাঠের পথ ধরে হেঁটে চলেছে রবিন আর মুসা। পেটে খিদে। মনে ভাবনা। কিশোর আর জিনা নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তা করছে।

সরু পথটার কাছে এসে থামল, সেই যে সেই পথটা, যেটার দু-ধারে পাতাবাহারের জঙ্গল পথকে সুড়ঙ্গ বানিয়ে দিয়েছে।

হাত তুলে দেখাল রবিন, ওই যে দেখো, কোথায় নেমে যাচ্ছিলাম। নালা।

নালায়েকের বাচ্চা, বিড়বিড় করে টমটমওয়ালাকে গাল দিল মুসা।

র‍্যাংকিন রেস্টের কাছে আসতেই কিশোর আর জিনার দেখা পাওয়া গেল। মুসা আর রবিনকে আগেই দেখেছে ওরা, নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসছে। তাদের সঙ্গে লাফাতে লাফাতে আসছে রাফিয়ান।

নাস্তা কেউই খায়নি। র‍্যাংকিন রেস্টে ঢুকল ওরা।

এগিয়ে এল সেই মহিলা, গতদিন ডাস্টার দিয়ে যে জানালা পরিষ্কার করছিল। কি চাই?

নাস্তা খাইনি এখনও, বলল কিশোর। কিছু আছে?

পরিজ আর মাখন, জানাল মহিলা। আর আমাদের নিজেদের কাটা গরু, নিজেদের মুরগীর ডিম। নিজেদের হাতে চাক ভেঙে মধু এনেছি আমরা, আর পাউরুটি আমি নিজে বানিয়েছি। চলবে? কফিও আছে।

ইস, আন্টি, জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে আপনাকে, দাঁত আর একটাও ভেতরে রাখতে পারছে না মুসা। জলদি করুন। এক বচ্ছর কিছু খাইনি।

হেসে চলে গেল মহিলা।

ছোট গোছানো ডাইনিং রুমে আরাম করে বসল অভিযাত্রীরা। খানিক পরেই রান্নাঘর থেকে ভেসে এল ভাজা মাংস আর কড়া কফির জিভে পানি আসা গন্ধ। লম্বা জিভ বের করে ঠোঁট চাটল রাফিয়ান।

কুকুরটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল মুসা, ও তো দেখছি ভাল হয়ে গেছে। মিস্টার নরিসের ওখানে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ, বলল কিশোর। গিয়ে দেখলাম বাড়ি নেই। তার স্ত্রী বললেন, এসে পড়বেন শিগগিরই। খুব ভাল মহিলা। বসতে দিলেন। বসলাম।

কিন্তু শিগগির আসেননি ভদ্রলোক, জিনা যোগ করল। কাজে আটকে গিয়েছিলেন। সাড়ে সাতটার পর এলেন। খুব খারাপ লাগছিল, তাদের খাওয়ার সময় তখন।

তবে মিস্টার নরিসও ভাল, বলল কিশোর। রাফির পা দেখল, চেপে ধরে কি জানি কি করল..এমন জোরে কাউ করে উঠল রাফি, যেন ছাত ছুঁড়ে বেরিয়ে যাবে…জিনা গিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল মিস্টার নরিসের ওপর…হাহ হাহ…ভদ্রলোক তো হেসেই বাঁচেন না…

যাব না, চোখমুখ ঘুরিয়ে বলল জিনা। যা ব্যথা দিয়েছে…

ডাক্তার যা করেন, বুঝেশুনেই করেন…

হ্যাঁ, তাই তো দেখছি, আবার রাফিয়ানের মাথায় হাত বোলাল মুসা। একেবারে ভাল হয়ে গেছে। তারপর কি করলে?

খাওয়ার জন্যে চাপাচাপি শুরু করলেন মিসেস নরিস, বলল কিশোর। কিছুঁতেই এড়াতে পারলাম না। খাওয়ার পর বেরোতেও দিতে চাইলেন না। বললেন, বৃষ্টিবাদলার মধ্যে গিয়ে কি করবে, শুয়ে থাকো এখানেই। তোমরা ভাববে বললাম। শেষে, ন-টা বাজার পর আকাশ পরিষ্কার হলে ছাড়লেন। ইয়েলো পণ্ডে গিয়ে তোমাদের পেলাম না। ভাবলাম, বৃষ্টিতে আটকে গেছ, অন্য কোথাও রাত কাটাতে উঠেছ। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। এতক্ষণে না পেলে পুলিশকে জানাতাম।

ফার্মটা কিন্তু দারুণ, মাথা কাত করল জিনা। ছোট একটা ঘরে থাকতে দিল আমাদের। বিছানা বেশ নরম। আমার বিছানার পাশে নিচে রাফি শুয়েছিল।

আর কি কপাল, কপাল চাপড়াল মুসা, আমি কাটিয়েছি খড়ের গাদায়…

মস্ত ট্রে-তে খাবার বোঝাই করে নিয়ে ঘরে ঢুকল মহিলা। পরিজ থেকে ধোঁয়া উঠছে। সাদা বিরাট বাটিতে সোনালি মধু। ইয়া বড় এক ডিশ ভরতি মাংস-ভাজা আর ডিম সেদ্ধ। আরেকটা বাসনে ভাজা ব্যাঙের-ছাতাও রয়েছে। .

খাইছে! হাততালি দিয়ে উঠল মুসা। ঢোক গিলল।

টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল মহিলা, এগুলো খাও। টোস্ট, ডিম ভাজা আর মাখন নিয়ে আসছি। দুধ-কফি পরে আনব। নাকি এখনি?

না না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল মুসা, পরেই আনুন। একটা ডিম তুলে নিয়ে আস্ত মুখে পুরল। সেটা অর্ধেক চিবিয়েই এক টুকরো মাংস নিয়ে কামড় বসাল। প্লেটে খাবার তুলে নেয়ার তর সইল না।

হেসে যার যার প্লেট টেনে নিল অন্যেরা। খাবার তুলে নিল প্লেটে। বাকি খাবার সহ ট্রে-টা মুসার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল জিনা, নাও, রাফিয়ানকেও কিছু দিয়ো।

কি আর বলব রে ভাই, ব্যাঙের ছাতার শেষ টুকরোটা মুখে পুরল মুসা। অন্ধকারে গিয়ে উঠেছিলাম এক বান্দরের বাড়িতে। রবিন, তুমি বলো। দরজায় দেখা দিয়েছে মহিলা, হাতে আরেক ট্রে, লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে গোয়েন্দা সহকারী।

সংক্ষেপে জানাল রবিন, পথ হারিয়ে কিভাবে গিয়ে উঠেছিল বাড়িটাতে।

বাধা না দিয়ে চুপচাপ শুনল কিশোর, তারপর বলল, ঘণ্টা শুনে ভয় পেয়েছে, নিশ্চয় মুসা ভূতের ভয় ঢুকিয়েছে তোমার মনে?

জোরে জোরে দুহাত নাড়ল মুসা, কি বোঝাতে চাইল সে-ই জানে। মুখ ভর্তি খাবার, কথা বলতে পারছে না।

অ, তোমরা তাহলে শোনননি কিসের ঘণ্টা, বলল কিশোর। পাগলা-ঘন্টি, মিসেস নরিস বলেছেন। জেল থেকে কয়েদী পালালে নাকি ওরকম বাজিয়ে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় গ্রামবাসীকে।

আর আমরা এদিকে কি ভয়ই না পেয়েছিলাম, মলিন হেসে মাথা নাড়ল রবিন।

নাস্তা শেষ হলো। এক টুকরো খাবারও পড়ে রইল না। উচ্ছিষ্টও না। যা ছিল, সাবাড় করে দিয়েছে রাফিয়ান।

কিছু স্যাণ্ডউইচ কিনে নেয়া দরকার, বলল কিশোর। দুপুরে খাওয়ার জন্যে।

হ্যাঁ, নাও, সঙ্গে সঙ্গে বলল মুসা।

বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে কিশোর বলল, মুসা, রবিনের কথা তো বললে। তুমি গোলাঘরে কিভাবে রাত কাটালে বললে না তো।

এতক্ষণে মনে পড়ল মুসার, রবিনকেও বলা হয়নি রাতের কথা। বলার অবকাশও পায়নি অবশ্য। দুজনে তখন ইয়েলো পণ্ড খোঁজায় এত ব্যস্ত, পেটে খিদে, আলাপ করার মানসিকতাই ছিল না।

এক কাণ্ড হয়েছে কাল রাতে, বলল মুসা। ওটা সত্যি ভূতের বাড়ি।

তোমার কাছে তো সবই ভূত, হাত নাড়ল কিশোর। চলো, কোথাও বসে শুনি। মনে হচ্ছে, অনেক কিছু বলার আছে তোমার।

নির্জন একটা জায়গা দেখে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসল ওরা।

সব খুলে বলল মুসা। চুপ করে শুনল সবাই।

পকেট থেকে কাগজটা বের করে দিল মুসা। ওটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল অন্যেরা। এমন কি রাফিয়ানও ফাঁক দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দিল, যেন মহা-পণ্ডিত।

আগামাথা কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। কিশোর। তবে নকশা-টকশা কিছু হবে। কিসের কে জানে।

ব্যাটা বলল, জানাল মুসা, টিকসির কাছে নাকি বাকি অর্ধেক আছে।

এই টিকসিটা কে? বলল জিনা। আল্লাহ মালুম।

রবিনের নামই বা জানল কিভাবে? এই কিশোর, কি ভাবছ? কনুই দিয়ে কিশোরের পাজরে তো দিল জিনা।

বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়ল কিশোর।

আমি পারছি, দু-আঙুলে চুটকি বাজাল হঠাৎ রবিন।

জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাল কিশোর।

মুসা, ছেলেটা কি বলেছিল? বলল রবিন। বলেছিল বুড়ির ছেলের নাম ডারটি রবিন রেখেছে লোকে। গতরাতে আমাকে নয়, ওকেই ডেকেছিল বুলেট-মাথা। বুড়ির ছেলে গোলাঘরে তার জন্যেই অপেক্ষা করেছে। জানে না, আগেই এসে তোমাকে ডারটি ভেবে মেসেজ দিয়ে চলে গেছে লোকটা।

ঠিক বলেছ, একমত হলো মুসা।

আনমনে বলল শুধু কিশোর, হুঁ। জেল পালানো কয়েদীর সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই তো? প্রশ্ন রাখল জিনা।

অসম্ভব না, বলল কিশোর। হতেও পারে। মেসেজটা সে-ই দিয়ে গেছে। হয়তো। কিন্তু কার কাছ থেকে আনল?

জেরি? মুসা বলল।

জেরি, না? হতে পারে। হয়তো সে এখন জেলে আছে, তার বন্ধু বুলেটমাথা, পালিয়েছে। বন্ধুর কাছেই মেসেজটা দিয়েছে সে। তাহলে ডারটি রবিন ওদেরই দলের কেউ। কোন বদ-মতলব আছে ব্যাটাদের।

কি মতলব?

তা জানি না। তবে হতে পারে, পাগলাঘন্টি শুনেই ডারটি বুঝেছে, যে তার বন্ধু পালিয়েছে। মেসেজ নিয়ে আসবে তার কাছে। তাই গোলাঘরে এসে বসেছিল মেসেজের আশায়।

হ্যাঁ, তাই হবে, মাথা দোলাল মুসা।

অথচ ভুলে মেসেজটা পড়ল এসে তোমার হাতে, রবিন বলল। মুসা, ভূতই মনে হয় গতরাতে আমাদেরকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল ওখানে, কোন একটা উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে…

ধ্যাত, সব বাজে কথা, হাত নেড়ে মাছি তাড়াল যেন জিনা। চলো, গিয়ে পুলিশকে জানাই। কয়েদী ধরতে সুবিধে হবে তাদের।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ছুটিতে এসেছি আনন্দ করতে, ডাকাত-টাকাতের খপ্পরে পড়তে চাই না। ম্যাপ বের করে নীরবে দেখল মিনিটখানেক। এই থানা-টানা থাকলে এখানেই থাকবে।

উঠল ওরা। খুশি হলো রাফিয়ান। নাস্তার পর পরই এত সময় ধরে বসে থাকাটা মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না তার। লাফাতে লাফাতে আগে আগে চলল সে।

পা তো একেবারে ভাল, ছুটিটা মাঠে মারা যায়নি বলে রবিনও খুশি। ভালই হয়েছে, শিক্ষা হয়েছে একটা। বোকার মত আর খরগোশের গর্তে ঢুকবে না।

হ্যাঁ, সত্যই শিক্ষা হয়েছে রাফিয়ানের। আর গর্তে ঢুকল না। তবে পরের আধ ঘন্টায় অন্তত ডজনখানেক বার মুখ ঢোকাল খরগোশের গর্তে। ধরা তো দূরের কথা, ছুঁতেও পারল না কোনটাকে। ওর চেয়ে খরগোশের পাল অনেক বেশি তাড়।

খোলা মাঠে বুনো ঘোড়া চরছে।

একবার একটা পাহাড়ী পথে মোড় নিতেই মুখোমুখি হয়ে গেল একপাল বুনো ঘোড়ার। অবাক চোখ মেলে অভিযাত্রীদের দেখল। তারপর একই সঙ্গে ঘুরে খুরের খটাখট তুলে দ্রুত হারিয়ে গেল পাহাড়ের ঢালের বনে। পিছু নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠল রাফিয়ান, জোর করে তার গলার বেল্ট টেনে ধরে রাখল জিনা।

খুব সুন্দর, না? বলল সে। আদর করতে ইচ্ছে করে।

গতদিনের মতই সকালটা সুন্দর, রোদে উজ্জল। পায়ের তলায় সবুজ ঘাস। একটা ঝর্নার পাড় দিয়ে হাঁটছে এখন। মৃদু ঝিরঝির করে বইছে টলটলে পানি, যেন গান গেয়ে নেচে নেচে ছুটে চলেছে মাতোয়ারা হয়ে।

দুপুরের দিকে জুতো খুলে ঝর্নায় পা ডুবিয়ে বসল ওরা। পায়ে হালকা পালকের মত পরশ বোলাচ্ছে পানি।

স্যাণ্ডউইচ দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে পেট পুরে খেলে ঝর্নার পানি।

পানিতে পা রেখেই নরম ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল জিনা। খোলা নীল আকাশের দিকে তামাটে চোখ। হলুদ রোদে যেন জ্বলছে তামাটে চুল। খুব সুন্দর লাগছে তাকে।

কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার শুরু হলো চলা।

ডিয়াটোতে কখন পৌঁছবে জানে না। তবে তাড়াও নেই। সাঁঝের আগে কোন ফার্মহাউস খুঁজে পেলেই হলো। রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

থানা থাকলে সেটা খুঁজে বের করতে হবে আগে, বলল কিশোর। তারপর ফার্ম…

ডিয়াটোতে থানা আছে। ছোট্ট থানা, একজন মাত্র গ্রামরক্ষী। আশপাশের চারটে গাঁয়ের দায়িত্বে রয়েছে সে, ফলে নিজেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট না ভাবলেও বেশ দামী লোক মনে করে। শেরিফ হলে কি করত কে জানে।

গ্রামরক্ষী সাহেবের বাড়িটাই থানা। আরামে বসে ডিনার খাচ্ছে, এই সময় এসে হানা দিল অভিযাত্রীরা। লোভনীয় সসেজ আর তাজা কাটা পেঁয়াজগুলোর দিকে তাকিয়ে উঠে এল বিরক্ত হয়ে।

কি চাই? কমবয়েসীদের দু-চোখে দেখতে পারে না লোকটা। তার মতে, সব ছেলেমেয়েই বিচ্ছু, গোলমাল পাকানোর ওস্তাদ। কিশোর-বয়েসীগুলো বেশি ইবলিস।

অদ্ভুত কতগুলো ঘটনা ঘটেছে, সার, ভদ্রভাবে বলল কিশোর। ভাবলাম, শেরিফকে জানানো দরকার। আপনি কি শেরিফ?

অ্যাঁ?…হা…না না, কি বলবে বলো জলদি। গতরাতে একজন কয়েদী পালিয়েছিল।

মরেছে, বলে উঠল লোকটা, তুমিও দেখেছ বলতে এসেছ। কতজন যে এল, সবাই নাকি দেখেছে। একজন লোক একসঙ্গে এতগুলো জায়গায় যায় কি করে, ঈশ্বরই জানে।

আমি না, শান্ত রইল কিশোর, আমার এই বন্ধু। গতরাতে সত্যি দেখেছে। একটা মেসেজ নিয়ে এসেছিল লোকটা।

তাই নাকি? তরল কণ্ঠে বলল গ্রামরক্ষী। তোমার বন্ধু তাহলে আরেক কাটি বাড়া। শুধু দেখেইনি, মেসেজও পেয়েছে। তা মেসেজটা কি? স্বর্গে যাওয়ার ঠিকানা?।

অনেক কষ্টে কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলল মুসা, টু-ট্রীজ, ব্ল্যাক ওয়াটার, ওয়াটার মেয়ার, টিকসি নোজ।

বাহ, বেশ ভাল ছন্দ তো, ব্যঙ্গ করল গ্রামরক্ষী। টিকসিও জানে। তাহলে টিকসিকে গিয়ে বললো, কি কি জানে এসে বলে যেতে আমাকে। তোমাদের আরেক বন্ধু বুঝি?

না, তাকে চিনি না, অপমানিত বোধ করছে মুসা। কড়া জবাব এসে যাচ্ছিল মুখে, কোনমতে সামলাল। আমার জানার কথা নয়, যদি না লোকটা এসে বলত। ভাবলাম, বুঝতে পারে এমন কাউকে জানিয়ে যাই। এই যে, এই কাগজটা দিয়েছিল।

ছেড়া পাতাটা হাতে নিয়ে দুর্বোধ্য আঁকিবুকির দিকে চেয়ে বাঁকা হাসল গ্রামরক্ষী। আরে, আবার কাগজও দিয়েছে। কি লেখা?

আমি কি জানি? হাত ওল্টালো মুসা। আর সহ্য করতে পারছে না। সেজন্যেই তো আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। কয়েদী ধরতে সুবিধে হবে ভেবে।

কয়েদী ধরব? কুটিল হাসি ফুটল লোকটার মুখে। এত কিছু জানো, আর আসল কথাটা জানো না? কয়েদী ব্যাটা ধরা পড়েছে ঘন্টাচারেক আগে। ঘোড়ার গাড়ি চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছিল। এতক্ষণে জেলে ঢোকানো হয়েছে আবার। কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল, হাসি হাসি ভাবটা উধাও হয়েছে চেহারা থেকে। আর শোনো, ছেলেছোকরাদের ভেঁপোমি আমি সইতে পারি না। আর কক্ষণো…

ভেঁপোমি করছি না, স্যার, কালো হয়ে গেছে কিশোরের মুখ। সত্যি-মিথ্যে বোঝার ক্ষমতা নেই, চোর ধরেন কি করে?

রাগে গোলাপী হয়ে গেল গ্রামরক্ষীর গাল। কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না। তার মুখের ওপর এভাবে আর কখনও বলেনি কেউ। দেখো খোকা…

আমি খোকা নই। বয়েস আরেকটু বেশি।

চড়ই মেরে বসবে যেন গ্রামরক্ষী, এত রেগে গেল।

পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে লোকটার প্রায় নাকের নিচে ঠেলে দিল কিশোর, নিন, এটা পড়লেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।

নিচের সই আর সীল দেখেই চেহারা অন্যরকম হয়ে গেল গ্রামরক্ষীর, সামলে নিল নিজেকে। কাগজটা নিয়ে পড়ল। লেখা আছে :

এই কার্ডের বাহক ভলানটিয়ার জুনিয়র, রকি বীচ পুলিশকে সহায়তা করছে। একে সাহায্য করা মানে পক্ষান্তরে পলিশকেই সাহায্য করা।
–ইয়ান ফ্লেচার
চীফ অভ পুলিশ
লস অ্যাঞ্জেলেস।

মুখ কালো করে কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল গ্রামরক্ষী, তা এখন কি করতে হবে আমাকে? রিপোর্ট লিখে নিতে হবে?

সেটা আপনার ইচ্ছে, ঝাল ঝাড়ল কিশোর।

ঠিক আছে, লিখে নিচ্ছি, পকেট থেকে নোটবই বের করল গ্রামরক্ষী, নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও। তবে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, এটা তোমাদের রকি বীচ নয়। এখানকার চোর-ছ্যাচোড়রা অন্যরকম। গলাকাটা ডাকাত। ওদের সঙ্গে গোলমাল করতে গেলে বিপদে পড়বে।

সে-ভয়েই বুঝি কেঁচো হয়ে থাকো, ব্যাটা, বলার খুব ইচ্ছে হলো কিশোরের। বলল, সেটা দেখা যাবে। দিন, আমাদের কাগজটা দিন।

কয়েকজন কিশোরের কাছে হেরে গিয়ে মেজাজ খিচড়ে গেছে গ্রামরক্ষীর, কি ভাবল কে জানে, দুই টানে ফড়তি ফড়াত করে চার টুকরো করে ফেলল মেসেজটা, ফেলে দিল মাটিতে। বলল, রিপোর্ট লেখা দরকার, লিখে নিয়েছি। কিন্তু বাজে কাগজ হেঁড়ার জন্যে কচুটাও করতে পারবে না কেউ আমার, বলে নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে, গটমট করে চলে গেল ঘরের দিকে।

আস্ত ইতর! লোকটা শুনল কিনা, কেয়ারই করল না জিনা। এমন করল কেন?

লোকটাকেও দোষ দিতে পারি না, কাগজের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে মুসা, সেদিকে চেয়ে বলল কিশোর। যা একখান গল্প এসে বলেছি, বিশ্বাস করবে কি? ওর জায়গায় আমি হলেও করতে চাইতাম না। এদিকের গায়ের লোক এমনিতেই বানিয়ে কথা বলার ওস্তাদ।

তবে একটা সুখবর দিয়েছে, রবিন বলল। কয়েদী ধরা পড়েছে। ডাকাতটা ছাড়া থাকলে বনেবাদাড়ে ঘুরে শান্তি পেতাম না, মন খচখচ করতই।

ভাবতে হবে, কিশোর বলল। তবে আগে খাবার ব্যবস্থা করা দরকার। এখানে অনেক ফার্মহাউস আছে, দেখা যায়।

গ্রামরক্ষীর বাড়ির কাছ থেকে সরে এল ওরা। ছোট একটা মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করল, এমন কোন ফার্মহাউস আছে কিনা, যেখানে খাবার কেনা যায়।

ওই তো, পাহাড়ের মাথায় একটা, হাত তুলে দেখাল মেয়েটা। আমার দাদুর বাড়ি। দাদী খুব ভাল, গিয়ে চাইলেই পাবে।

থ্যাংকস, বলল কিশোর।

ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে পথ। বাড়ির কাছাকাছি হতেই কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে পিঠের রোম খাড়া হয়ে গেল রাফিয়ানের, চাপা গোঁ গোঁ করে উঠল।

চুপ, রাফি, মাথায় আলতো চাপড় দিল জিনা। খাবারের জন্যে এসেছি এখানে। ওদের সঙ্গে গোলমাল করবি না।

বুঝল রাফিয়ান। রোম স্বাভাবিক হয়ে গেল আবার, গোঁ গো বন্ধ। রেগে ওঠা কুকুরদুটোর দিকে বন্ধু সুলভ চাহনি দিয়ে তার ফোলা লেজটা ঢুকিয়ে নিল দুই পায়ের ফাঁকে।

এই, কি চাও? ডেকে জিজ্ঞেস করল একজন লোক।

খাবার, চেঁচিয়ে জবাব দিল কিশোর। ছোট একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে বলল এখানে পাওয়া যাবে।

দাঁড়াও, মাকে জিজ্ঞেস করি, বলে বাড়ির দিকে চেয়ে ডাকল লোকটা, মা? মা?

সাংঘাতিক মোটা এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, চঞ্চল চোখ, আপেলের মত টুকটুকে গাল।

খাবার চায়, ছেলেদের দেখিয়ে বলল লোকটা।

এসো, ডাকলেন মহিলা। এই চুপ, চুপ, নিজেদের কুকুরগুলোকে ধমক দিলেন।

দেখতে দেখতে কুকুরদুটোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলল রাফিয়ান। ছোটাছুটি খেলা শুরু করল।

বেশ ভাল খাবার। পেট ভরে খেলো অভিযাত্রীরা। রাফিয়ান তো এত বেশি গিলেছে, নড়তে পারছে না, খালি হাঁসফাঁস করছে।

ওরা খাবার টেবিলে থাকতেই সেই ছোট মেয়েটা এসে ঢুকল। হাই, হাসল সে। বলেছিলাম না, আমার দাদী খুব ভাল। আমি নিনা। তোমরা?

একে একে নাম বলল কিশোর। তারপর বলল, ছুটিতে ঘুরতে এসেছি। খুব চমৎকার কিন্তু তোমাদের অঞ্চলটা। কয়েক জায়গায় তো ঘুরলাম, বেশ ভাল লাগল। আচ্ছা, টু-ট্রীজটা কোথায় বলতে পারো?

মাথা নাড়ল মেয়েটা। আমি জানি না। দাঁড়াও, দাদীকে জিজ্ঞেস করি। দাদী? ও দাদী?

দরজায় উঁকি দিলেন মহিলা। কি?

টু-ট্রীজ? খুব সুন্দর জায়গা। এখন অবশ্য নষ্ট হয়ে গেছে। একটা হ্রদের ধারে, জংলা জায়গা। হ্রদটার নাম যে কি…কি…

ব্ল্যাক ওয়াটার? কিশোর বলল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্ল্যাক ওয়াটার। ওখানে যাচ্ছে নাকি? খুব সাবধান। আশেপাশে জঙ্গল, জলা…তো, আর কিছু লাগবে-টাগবে?

আরিব্বাপরে। আরও? না, না, হাসল কিশোর, পেট নিয়ে নড়তে পারছি।। খুব ভাল বেঁধেছেন। বিলটা যদি দেন। আমাদের এখন যেতে হবে।

বিল আনতে চলে গেলেন মহিলা।

নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা, কোথায় যেতে হবে? ব্ল্যাক ওয়াটার?

হ্যাঁ-না কিছুই বলল না কিশোর, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে আনমনে বলল শুধু, কালোপানি।

ফার্মহাউস থেকে বেরিয়ে বলল কিশোর, টু-ট্রীজ কতদূরে, সেটা আগে জানা দরকার। সম্ভব হলে আজই যাব, নইলে কাল। বেলা এখনও আছে।

কতদূরে সেটা, কি করে জানছি? বলল মুসা। ম্যাপ দেখে বোঝা যাবে?

যদি ম্যাপে থাকে। থাকার তো কথা, হ্রদ যখন।

উপত্যকায় নেমে এল আবার ওরা। রাস্তা থেকে দূরে নির্জন একটা জায়গা দেখে এসে বসল।

ম্যাপ বের করে বিছাল কিশোর। চারজনেই ঝুঁকে এল ওটার ওপর।

সবার আগে রবিনের চোখে পড়ল। ম্যাপের এক জায়গায় আঙুলের খোঁচা মেরে বলল, এই যে, ব্ল্যাক ওয়াটার। কিন্তু টু-ট্রীজ তো দেখছি না।

ধ্বংস হয়ে গেলে সেটা আর ম্যাপে দেখানো হয় না, যদি কোন বিশেষ জায়গা না হয়। যাক, ব্ল্যাক ওয়াটার তো পাওয়া গেল। তো, কি বলল, যাব আজ? কত দূরে, বুঝতে পারছি না।

এক কাজ করলে পারি, জিনা প্রস্তাব দিল। পোস্ট অফিসে খোঁজ নিলে পারি, ডাকপিয়নের কাছে। সব জায়গায়ই চিঠি বিলি করে, কোথায় কি আছে, সে-ই সবচেয়ে ভাল বলতে পারবে।

সবাই একমত হলো।

সহজেই খুঁজে বের করা গেল পোস্ট অফিস। গাঁয়ের একটা দোকানের এক অংশে অফিস, দোকানদারই একাধারে পোস্টমাস্টার থেকে পোস্টম্যান। বৃদ্ধ এক লোক, নাকের চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন ছেলেদের দিকে।

ব্ল্যাক ওয়াটার? বললেন তিনি। ওখানে যেতে চাও কেন? সুন্দর জায়গা ছিল এককালে, কিন্তু এখন তো নষ্ট হয়ে গেছে।

কি হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

পুড়ে গেছে। মালিক তখন ওখানে ছিল না, শুধু দুজন চাকর ছিল। এক রাতে হঠাৎ জ্বলে উঠল বাড়িটা, কেন, কেউ বলতে পারে না। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দমকল যেতে পারেনি, পথ নেই। কোনমতে ঘোড়ার ছোট গাড়ি-টাড়ি যায়।

আর ঠিক করা হয়নি, না?

না, মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। বাকি যা ছিল, ওভাবেই পড়ে থাকল। এখন ওটা দাঁড়কাক, পেঁচা আর বুনো জানোয়ারের আজ্ঞা। অদ্ভুত জায়গা, ভূতের আগুন নাকি দেখা যায়। গিয়েছিলাম একদিন দেখতে। আগুন দেখিনি, তবে হ্রদের কালো পানি দেখেছি। যে রেখেছে, একেবারে ঠিক নাম রেখেছে।

কদ্দূর? যেতে কতক্ষণ লাগবে? জিজ্ঞেস করল জিনা।

ওরকম একটা জায়গায় কেন যেতে চাও? হ্রদের পানিতে গোসল করতে? পারবে না, পারবে না, নামলে জমে যাবে। ভীষণ ঠাণ্ডা।

নাম আর বর্ণনা শুনে খুব কৌতুহল হচ্ছে, বুঝিয়ে বলল কিশোর। কোনদিক দিয়ে যেতে হয়?

এভাবে তা বলা যাবে না। ম্যাপ-ট্যাপ থাকলে দেখে হয়তো…আছে তোমাদের কাছে?

ম্যাপ ছড়িয়ে বিছাল কিশোর।

কলম দিয়ে এক জায়গায় দাগ দিলেন বৃদ্ধ, একটা লাইন আঁকলেন, এখান থেকে শুরু করবে, এখানে, একটা ক্রস দিলেন, জায়গাটা। হুঁশিয়ার, ভয়ানক জলা। এক পা এদিক ওদিক ফেলেছ, হঠাৎ দেখবে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেছে পাকে। তবে হ্যাঁ, প্রকৃতি দেখতে পারবে, এত সুন্দর! হরিণও আছে। ভাল লাগবে তোমাদের।

থ্যাংক ইউ, স্যার, ম্যাপটা রোল করে নিতে নিতে বলল কিশোর। যেতে কত সময় লাগবে?

এই ঘণ্টা দুয়েক। আজ আর চেষ্টা কোরো না, বোধহয় সময় পাবে না। অন্ধকারে ওপথে যাওয়া?…মরবে!

হ্যাঁ-না কিছু বলল না কিশোর। আবার ধন্যবাদ দিয়ে বলল, আপনার দোকানে ক্যামপিঙের জিনিসপত্র পাওয়া যাবে? দিনটা তো ভারি সুন্দর গেল, রাতটাও বোধহয় ভালই যাবে। গোটা দুই শতরঞ্জি আর কয়েকটা কঙ্কলও ভাড়া নিতে চাই।

অবাক হয়ে গেছে অন্য তিনজন। কিশোর কি করতে চাইছে, বুঝতে পারছে না। হঠাৎ বাইরে রাত কাটানোর মতলব কেন?

উঠে গিয়ে তাক থেকে রবারের বড় দুটো শতরঞ্জি নামিয়ে দিলেন বৃদ্ধ। আর চারটে পুরানো কম্বল। নাও। কিন্তু এই অক্টোবরে ক্যামপিং করবে? ঠাণ্ডায় না মরো।

মরব না, বৃদ্ধকে কথা দিল কিশোর।

চারজনে মিলে জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে।

বাইরে বেরিয়েই জিজ্ঞেস করল মুসা, কিশোর, কি করবে?

এই একটু খোঁজাখুজি করব আরকি, বলল কিশোর। একটা রহস্য যখন পাওয়া গেছে…

কিন্তু আমরা এসেছি ছুটি কাটাতে।

তাই তো কাটাচ্ছি। রহস্যটা পেয়ে যাওয়ায় সময় আরও ভাল কাটবে।

কিশোর পাশার এহেন যুক্তির পর আর কিছু বলে লাভ নেই, বুঝে চুপ হয়ে গেল মুসা। অন্য দুজন কিছু বললই না। তর্ক করা স্বভাব নয় রবিনের, আর অ্যাডভেঞ্চার জমে ওঠায় মজাই পাচ্ছে জিনা। সে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি মনে হয়? টু-ট্রীজে কিছু ঘটতে যাচ্ছে?

এখনি বলা যাচ্ছে না। গিয়ে দেখি আগে। খাবার কিনে নিয়ে যাব। এখন রওনা দিলে পৌঁছে যাব অন্ধকারের আগেই। ওখানে কোথাও না কোথাও ক্যাম্প করার জায়গা নিশ্চয় মিলবে। সকালে দেখব কোথায় কি আছে।

শুনতে তো ভালই লাগছে, কুকুরটার দিকে ফিরল জিনা। কি বলিস, রাফি?

হউ, সমঝদারের ভঙ্গিতে লেজ নেড়ে সায় দিল রাফিয়ান।

যাচ্ছি তো, বলল মুসা, কিন্তু ধরো, গিয়ে কিছু পেলাম না। তাহলে? এই রহস্য-টহস্যের কথা…

আমার ধারণা, পাবই। যদি না পাই, ক্ষতি কি? ঘুরতেই তো বেরিয়েছি আমৱা, নাকি? পিকনিকের জন্যে ব্ল্যাক ওয়াটারের মত জায়গা এখানে আর কটা আছে?

রুটি, মাখন, টিনে ভরা মাংস ও বিশাল একটা ফুট কেক কিনে নিল কিশোর। কিছু চকলেট আর বিস্কুটও নিল।

মালপত্রের বোঝার জন্যে দ্রুত হাঁটা যাচ্ছে না, তবে অতটা তাড়াহুড়াও নেই ওদের। আঁধার নামার আগে গিয়ে পৌঁছতে পারলেই হলো। দেখতে দেখতে চলেছে।

পাহাড়ের চড়াই-উৎড়াই, সমতল তৃণভূমি, হালকা জঙ্গল, সব কিছু মিলিয়ে এক অপরূপ দৃশ্য। দূরে একদল বুনো ঘোড়া চড়ছে। কয়েকটা চিতল হরিণের মুখোমুখি হলো অভিযাত্রীরা। ক্ষণিকের জন্যে থমকে গেল হরিণগুলো, পরক্ষণেই ঘুরে দে ছুট।

আগে আগে চলেছে কিশোর, খুব সতর্ক, বৃদ্ধ পোস্টম্যানের হুঁশিয়ারিকে গুরুত্ব দিয়ে চলেছে সারাক্ষণ। বার বার ম্যাপ দেখে শিওর হয়ে নিচ্ছে, ঠিক পথেই রয়েছে কিনা।

পাটে বসছে টকটকে লাল সূর্য। ডুবে গেলেই ধড়াস করে নামবে অন্ধকার, এখানকার নিয়মই এই। তবে ভরসা, আকাশ পরিষ্কার, আর শরতের আকাশে তারাও হয় খুব উজ্জল, তারার আলোয় পথ দেখে চলা যাবে। তবু তাড়াহুড়ো করল ওরা, দিনের আলো থাকতে থাকতেই পৌঁছে যেতে পারলে ভাল, দুর্গম পথে অযথা ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না।

ছোট একটা সমভূমি পেরিয়ে সামনে দেখাল কিশোর, জঙ্গল। বোধহয় ওটাই।

হ্রদ কোথায়? বলল রবিন। ও হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে। কালো।

কি করে যেন বুঝে গেছে রাফিয়ান, গন্তব্য এসে গেছে। লেজ তুলে সোজা সেদিকে দিল দৌড়। ডেকেও ফেরানো গেল না। তার কাণ্ড দেখে সবাই হেসে অস্থির।

আঁকাবাঁকা পথটা গিয়ে মিশেছে আরেকটা সরু পথের সঙ্গে, তাতে ঘোড়ার গাড়ির চাকার গভীর খাঁজ। দু-ধারের ঘন আগাছা পথের ওপরও তাদের রাজ্য বিস্তৃত করে নিয়েছে।

জঙ্গলে ঢুকল ওরা। বন কেটে এককালে করা হয়েছিল পথটা, মানুষের অযত্ন অবহেলায় বন আবার তার পুরানো স্বত্ব দখল করে নিচ্ছে।

আমি আসছি, ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে অন্ধকার।

ঠিক এই সময় হঠাৎ করেই টু-ট্রীজের ধ্বংসাবশেষের ওপর এসে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল অভিযাত্রীরা।

কালো, নির্জন, নিঃসঙ্গ, পোড়া ধ্বংসস্তুপ। ভাঙা দু-একটা ঘর এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে, জানালার পাল্লা আছে, কাচ নেই, ছাতের কিছু কড়িবগী আছে, কিন্তু ছাত নেই। মানুষের সাড়া পেয়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উড়ে গেল দুটো দোয়েল।

বাড়িটা কালো হ্রদের ঠিক পাড়েই। নিথর, নিস্তব্ধ পানি, সামান্যতম ঢেউ নেই। যেন কালো জমাট বরফ…না না, কালো বিশাল এক আয়না।

মোটেই ভাল্লাগছে না আমার, নাকমুখ কোঁচকাল মুসা। কেন যে এলাম মরতে।

Categories: